এই পরিবর্তনশীল মহাবিশ্বে সমস্ত কিছুর। পরিবর্তন হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেই এককোষী জীব হতে লক্ষ কোটি বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা আজকের মানবে উত্তীর্ণ হয়েছি। মানুষের বিবর্তনের ধারা আজও অব্যাহত আর তা ঘটে চলেছে। মানবের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের মধ্য দিয়ে। মানবের এই বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের ফল হলো আধুনিকালের প্রযুক্তিগত উন্নতি। প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে আজ বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রের উদ্ভাবন হয়েছে। তবে বিজ্ঞানের বিবর্তনের শুরুটা হয়েছিল খুবই সাধারণভাবে খুবই সাধারণ সূত্রের উপর ভিত্তি করে। গত শতাব্দীতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের বেশিরভাগই ছিল মেকানিক্যাল মুভমেন্ট নির্ভর, আর তার ফলে এদের আকার অনেক বড় হতো। আর আকার অনেক বড় হওয়াতে এদের বৈদ্যুতিক শক্তির চাহিদা ছিল অনেক বেশি। যেমন প্রথম যুগের রেডিয়ো রিসিভার এত বড় হতো যে সহজে বহন করা যেত না। বর্তমানে তা এতই ছোট যে পকেটে বহন করা যায়। এরূপ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অপরিবহণযোগ্য প্রযুক্তির দ্রুত বিবর্তন ঘটেছে পরিবহণযোগ্য (Portable) প্রযুক্তিতে।
একবিংশ শতাব্দীর শুরু হতে এই বিবর্তন এক অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির রূপ নিয়েছে। আর তার ফলে পরিবহণযোগ্য যন্ত্রাদির কলেবর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম রূপ নিয়েছে, আর তার সঙ্গে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের শক্তির চাহিদাও ক্রমাগত কমেছে। পরিবহণযোগ্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির বেশিরভাগই এখন ব্যাটারি নির্ভর। কারণ ব্যাটারির উল্লেখযোগ্য কোনো সহজলভ্য বিকল্প আজও পাওয়া যায়নি। কিন্তু আজ আমরা যুগের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি যেখান হতে অদূর ভবিষ্যতে প্রযুক্তির বিবর্তন অন্যমাত্রা পেতে চলেছে। আমরা ক্রমাগত পরিবহণ-অযোগ্য প্রযুক্তি হতে পরিধানযোগ্য (Wearable)। প্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করতে চলেছি। সম্প্রতি এই পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি । হয়েছে বিভিন্ন অত্যাধুনিক ব্যবহারে, যেমন : স্মার্ট টেক্সটাইল, হেলথকেয়ার নেভিগেশন সিস্টেম, অ্যাক্টিভিটি ট্রাকিং সিস্টেম, ইত্যাদিতে। বর্তমানে অনেক ইলেকট্রনিক । মাইক্রোসিস্টেমের আকার এতই ছোট যে । এদের শক্তির চাহিদা খুবই কম, মিলিওয়াট এমনকী মাইক্রোওয়াটের পরিধির মধ্যে। আর তার ফলে শক্তি সরবরাহকারী ব্যাটারির । আকার সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছুপরিধানযোগ্য প্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসাক্ষেত্রে হয়েছে। এতে রোগীর বিভিন্ন শারীরিক তথ্য সংগ্রহের জন্য, যেমন হার্ট রেট (ECG ও HRV), ব্রেনওয়েভ (EEG), । মাসল বায়োসিগন্যাল (EMG), ব্লাড প্রেসার। ইত্যাদি। এই পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির প্রধান : অন্তরায় হলো এদের শক্তি সরবরাহকারী পাওয়ার ডিভাইসের সীমাবদ্ধতা। বর্তমানে সমস্ত ধরনের পরিবহণযোগ্য ও পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি মূলত ব্যাটারি নির্ভর, আর ব্যাটারির মূল সমস্যা হলো এদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর চার্জের প্রয়োজন হয়। এছাড়া ব্যাটারির পরিবেশগত প্রভাব যথেষ্ট ক্ষতিকর। এমতাবস্থায় বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়বস্তু হলো পুনর্নবীকরণ বিকল্প শক্তির উদ্ভাবন করা। পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির জন্য উল্লেখযোগ্য শক্তির উৎস হতে পারে আমাদের শরীর থেকে উৎপন্ন তাপ। আমাদের শরীর কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট হতে মেটাবলিজমের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত তাপ উৎপন্ন করে চলেছে। মানব দেহে উৎপন্ন মোট তাপশক্তির পরিমাণ আনুমানিক ১০০ ওয়াট। এই তাপশক্তির কিছুটা অংশ বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারলেই পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির শক্তি-সমস্যার সমাধান হতে পারে। শরীরের তাপ হতে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হতে পারে থার্মোইলেকট্রিক টেকনোলজি। সুইডেনের লিংশপিং ইউনিভার্সিটিতে আমাদের বর্তমান গবেষণা ঠিক এই পরিধানযোগ্য থার্মোইলেকট্রিক টেকনোলজির উপর। আমাদের নিরন্তর গবেষণার ফলে এক। নমনীয় থার্মোইলেকট্রিক সিরামিক পদার্থের উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। আমাদের এই উদ্ভাবন সম্প্রতি ইউরোপিয়ান থার্মোইলেকট্রিক সোসাইটি দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছে।
থার্মোইলেকট্রিক ডিভাইস যে কোনো উত্তপ্ত পৃষ্ঠতল থেকে শক্তি উৎপাদন করতে পারে। আর এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো যে এটা বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘকাল কর্মক্ষম। এর বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি কোনো মেকানিক্যাল মুভমেন্টের উপর নির্ভরশীল নয়, আর এই কারণে এর কর্মকাণ্ড শব্দহীন। শক্তি উৎপাদনের জন্য থার্মোইলেকট্রিক ডিভাইসের এক প্রান্ত উত্তপ্ত পৃষ্ঠতলের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখতে হয়, আর এর ফলে ডিভাইসের আড়াআড়িভাবে তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হয়। এই তাপমাত্রার পার্থক্যের ফলে থার্মোইলেকট্রিক পদার্থের মধ্য দিয়ে তাপের পরিবহণ শুরু হয়, যা পদার্থের মধ্যে তড়িৎ বাহকের সঞ্চালন শুরু করে। আর এর ফলস্বরূপ বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন শুরু হয়। থার্মোইলেকট্রিক টেকনোলজির সবচেয়ে সফল প্রয়োগ এখনো পর্যন্ত হয়েছে মহাকাশ গবেষণায়, যেখানে রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া দীর্ঘকাল নিরবচ্ছিন্ন শক্তির প্রয়োজন, বিশেষত যেখানে সৌরশক্তি সহজলভ্য নয়।
আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (NASA) মহাকাশ গবেষণার জন্য এক। বিশেষ ধরনের রেডিও আইসোটোপ থর্মোইলেকট্রিক জেনারেটর তৈরি করেছে। এই জেনারেটরে একটি রেডিও অ্যাকটিভ কোর থাকে যা তাপের উৎস হিসেবে কাজ করে। রেডিও অ্যাকটিভ কোরকে ঘিরে অজস্র থার্মোইলেকট্রিক ডিভাইস সংযুক্ত করা থাকে। থার্মোইলেকট্রিক ডিভাইসগুলির আড়াআড়ি ভাবে প্রায় ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হয় যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাহায্য করে। রেডিও আইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটরের ব্যবহারের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ক্যাসিনি (Cassini) মহাকাশযান। ক্যাসিনি মহাকাশযান ১৯৯৭ সাল থেকে দীর্ঘ ২০ বছর শনিগ্রহের চারিদিকে প্রদক্ষিণরত ছিল যা রেডিও আইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর দ্বারা পরিচালিত হতো। অন্য একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ২০১১ সালে নাসা দ্বারা প্রেরিত মঙ্গল যান কিউরিওসিটি (Curiosity)। এই মঙ্গলযান হলো মঙ্গলের পৃষ্ঠে চলনক্ষম একটি রোবট যা মঙ্গলের ভূপ্রকৃতির বিশ্লেষণের কাজে ব্যবহৃত এবং এখনো কর্মক্ষম। এই মঙ্গলযানও রেডিও আইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর দ্বারা পরিচালিত। এই সমস্ত ব্যবহারে মূলত ম্যাক্রোসাইজের থার্মোইলেকট্রিক ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির জন্য থার্মোইলেকট্রিক টেকনোলজির ম্যাক্রো হতে মাইক্রো ডাইমেনশনে বিবর্তন একান্ত আবশ্যক আর তার জন্য বিজ্ঞানীরা অবিরত গবেষণা করে চলেছেন।
পরিধানযোগ্য মাইক্রো-থার্মোইলেকট্রিক ডিভাইস আমাদের শরীর হতে মিলিওয়াট পাওয়ার উৎপাদন করতে সক্ষম যা বর্তমানে অনেক বৈদ্যুতিন ডিভাইসের চাহিদার জন্য যথেষ্ট। যেমন ECG এর জন্য ০.২ মিলি ওয়াট পাওয়ার যথেষ্ট। কিছু মার্কেট বিশ্লেষণ ইতিমধ্যেই পূর্বাভাস দিয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির বাজার ৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। আর এই বৈপ্লবিক বিবর্তনের জন্য থার্মোইলেকট্রিক টেকনোলজির বৈপ্লবিক বিকাশ প্রয়োজন। আর এই লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা অবিরত গবেষণা করে চলেছেন। তারা বিভিন্ন ধাপে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে চলেছেন। প্রথম ধাপ হলো এমন ধরনের পদার্থের উদ্ভাবন করা যার কর্মদক্ষতা বেশি হবে, অর্থাৎ কম তাপমাত্রা হতে বেশি পরিমাণ বৈদ্যুতিক শক্তির উৎপাদন করতে পারবে। দ্বিতীয় ধাপের চ্যালেঞ্জ হলো উদ্ভাবিত পদার্থের মধ্যে নমনীয়তা নিয়ে আসা যাতে করে এরা পরিধানযোগ্য ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। তৃতীয় ধাপের চ্যালেঞ্জ হলো এমন। কোনো পদ্ধতির বিকাশ করা যাতে করে ল্যাব স্কেল হতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে থার্মোইলেকট্রিক পদার্থের উৎপাদন করা সম্ভব হয়। আর সর্বশেষ ধাপ হলো থার্মোইলেকট্রিক ডিভাইসের ডিজাইন ও তার নির্মাণ করা। বর্তমান গবেষণা এমন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে যে আগামী এক দশকেরমধ্যে অনেক পরিধানযোগ্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস তাদের প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করে নিতে পারবে শরীরের তাপ থেকে, আর তা থার্মোইলেকট্রিক প্রযুক্তির মাধ্যমে।
ড. বিপ্লব পাল
(লেখক সুইডেনের লিংশপিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক)
2019-09-06