হোটেলের লবিতে পৌঁছেই আমার তিন বছরের মেয়ে আহ্লাদে আটখানা। একটা গোলাপ দিয়েছিল ওর হাতে। সেটা হাতে নিয়েই সটান উঠে বসল হাই চেয়ারে। রিসেপশনের ফরম্যালিটি শেষ হলে, লিফটের দিকে যখন এগোচ্ছি, হাত ছাড়িয়ে ছুটে গেল ডান দিকে। রেস্তোরাঁর সামনে পিলারগুলো উপর থেকে নীচ পর্যন্ত আস্ত একেকটা অ্যাকোয়ারিয়াম। লাল, কমলা, নীল, সবুজ মাছেদের সঙ্গে যেন এখুনি বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলতে হবে।
দ্য কিংসবেরি হোটেল। ব্রিটিশ ঘরানার স্থাপত্য। তবে অন্দরসাজ কনটেম্পোরারি। আমাদের রুম সাত তলায় । এ মাথা থেকে ও মাথা কাচের জানালা। পর্দা সরিয়ে দিলে ডান দিকে গল ফেস গ্রিন, সমুদ্র। তার আগে একটা ছোট রাউন্ড অ্যবাউট। বাঁ দিকে, রাষ্ট্রপতির সচিবালয়। তার পরেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সাংগ্রি লা হোটেল।
কত দিনই বা হবে! ৬ মাসও হয়নি। ৩১ অক্টোবর ২০১৮। ওই জানালার পাশে চেয়ারে বসেই দুপুরের খাবার খেলো মেয়ে। তার পর সারা দুপুর সমুদ্র আর গল ফেস রোডের গাড়ির যাতায়াত দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল.. বিকেল হতেই দাপিয়ে বেড়াল গল ফেস গ্রিন। এটা চাই, ওটা চাই, সেটা চাই…
কলম্বোর সেই স্মৃতি এখনও তাজা। ক’দিন আগেও মোবাইলে সেই ছবি দেখেছি। রবিবার সকালে খবরটা পেয়েই ছ্যাঁৎ করে উঠল। পর পর ছ’টি বিস্ফোরণে কেঁপে গিয়েছে কলম্বো! ইস্টার সানডে-র সকালে দু’টি গির্জা ও তিনটি হোটেলে বিস্ফোরণ হয়েছে। আর সেই তিনটি হোটেলের একটি দ্য কিংসবেরি, অন্যটি সাংগ্রি লা। তৃতীয়টি গল ফেস রোডেই, সামান্য এগিয়ে সিনামন গ্র্যান্ড।
দুপুরের পর আরও দু’টি বিস্ফোরণ। রাত পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দু’শো ছাড়িয়ে গিয়েছে। আহত চারশোরও বেশি।
ভাবা যায়?
সত্যিই ভাবা যায়নি সে দিন। এখনও না। শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই সমস্যা মিটেছে ২০০৯ সালে। দশ বছর হয়ে গেল। তামিল জঙ্গিদের আত্মঘাতী হানা, নাশকতা, বিস্ফোরণ, শহর জুড়ে সেনাবাহিনী ও পিস কিপিং ফোর্সের দাপাদাপি পিছনে ফেলে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তামিল অধ্যুষিত জাফনায় পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া এখনও অনেক বাকি। আধুনিক সুযোগ সুবিধা এখনও সেখানে বিশেষ পৌঁছয়নি। স্থানীয় স্তরে উষ্মা থাকলেও, সেই অসন্তোষ জঙ্গিপনার চেহারা নেওয়ার শক্তি হারিয়েছে এতোদিনে। কিন্তু বাকি শ্রীলঙ্কা একেবারেই শান্ত। হই হট্টোগোল নেই। রাস্তা ঘাটে, ট্রেনে, বাসে, বাজারে অশান্তির চিহ্নমাত্র নেই। বরং দেখে মনে হবে দক্ষিণ এশিয়ায় এতো পরিপাটি, শান্ত, অতিথিবৎসল দেশ কমই রয়েছে।
ক্যান্ডি, অনুরাধাপুরা, এলা, নুয়ারা এলিয়া, বেনটোটা, নিগম্বোর গলি, তস্য গলি ঘুরলে বোঝা যাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ করে ফেলেছে দেশটা। পর্যটনের পরিকাঠামোয় বিন্দুমাত্র খামতি নেই। আর কলম্বো শহরের তো তুলনাই হয় না। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে শহরটা রীতিমতো কসমোপলিটন হয়ে উঠেছে এত দিনে। ব্রিটিশ স্থাপত্যের বাড়িগুলির কলকাতায় যেমন হতচ্ছেদ্দা অবস্থা, কলম্বোয় তার ঠিক বিপরীত। সেগুলির সংস্কার করে এমন ভাবে রাখা হয়েছে, দেখলে হিংসা হওয়ার মতোই।
গল ফেস রোড ও গ্রিন রাজধানী শহরের সব থেকে ‘হ্যাপেনিং’ এলাকা। ইদানীং যেমন বিদেশের ক্রিকেট টিম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনেতারা মোটামুটি ভাবে সাংগ্রি লা-য় এসে ওঠেন। আগে কৌলিন্য ছিল পাশেই তাজ সমুদ্র হোটেলের। এক সময়ে সার্ক সম্মেলনের ফাঁকে বাজপেয়ী-মুশারফের বৈঠক হয়েছিল সেখানে। পিছনের রাস্তায় নতুন কিছু বহুতল নির্মীয়মাণ। সেখানে নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে এল অ্যান্ড টি, টাটা হাউজিংয়ের মতো ভারতীয় নির্মাণ সংস্থাগুলি।
কাছেই ডাচ হসপিটাল শপিং প্রেকিংট ও আশপাশে অভিজাত সব রেস্তোরাঁ ও পানশালা। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার কুমার সঙ্গকারা ও মাহেলা জয়বর্ধনের রেস্তোরাঁ ‘মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব’-ও রয়েছে সেখানেই। ডাচ হসপিটাল চত্বরে প্রতি রাতে ওপেন এয়ার রক ব্যান্ডের গান ও উচ্ছ্বল ছেলেমেয়েদের দেখলে ঠাওর হবে সন্ত্রাস, নাশকতা কবে এ মুলুক ছেড়ে গেছে ভিন্ গ্রহে!
অক্টোবরের শেষ দিকে যখন সপরিবার শ্রীলঙ্কা বেড়াতে গিয়েছি, তখন রাজনৈতিক ভাবে অস্থির ভারত মহাসাগরের বুকে ছোট এই দেশ। প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিঙ্ঘেকে রাতারাতি সরিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মৈত্রিপালা সিরিসেনা। পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়ে দিয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মহিন্দা রাজপক্ষকে। সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে দেশে। সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছে গিয়েছে মামলা। অথচ খবরের কাগজ বা সংবাদমাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে টেরই পাওয়া যাবে না, এত বড় সংকট চলছে দেশে।
পথেঘাটে মানুষের মধ্যে কোনও আলোচনা নেই। কাউকে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলে বোঝা যাবে, কলম্বো শহরের বাইরে বাকি শ্রীলঙ্কায় রনিলের জনপ্রিয়তা কমছে। রাজপক্ষ তুলনায় জনপ্রিয়। কারণ, তাঁর জমানাতেই গোটা শ্রীলঙ্কা জুড়ে চওড়া সড়ক, বন্দর, পর্যটনের পরিকাঠামো বেড়েছে। খোদ কলম্বো শহরের ছবিটা ভিন্ন। সেখানে রাজপক্ষকে নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে।
অভিযোগ, গোটা দেশটাকে ক্রমেই তিনি বেচে দিচ্ছেন বেজিং তথা চিনের কাছে। যাবতীয় বড় বিনিয়োগ আসছে চিন থেকে। কলম্বো শহরে দামী সব রিয়েল এস্টেটের সিংহভাগ এখন চিনা ব্যবসায়ীদের দখলে। এমনকী সাংগ্রি লা হোটেলের উল্টো দিকে আটশো হেক্টর জমি নিয়ে ফাইনান্সিয়াল সিটি গড়ে তুলছে চিনা সংস্থা। সমুদ্রের মধ্যে পাথর ও বালি ফেলে তৈরি হচ্ছে সেই শহর। সিঙ্গাপুরের বিকল্প হবে নাকি শ্রীলঙ্কা।
তবু এ সবে সন্ত্রাসের সিঁদুরে মেঘ দেখা যায়নি। রবিবার কলম্বো থেকে যে ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ও সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, সেই মৃত্যুপুরীও আমি চিনি না। বরং কলম্বো পৌঁছতেই আমাদের ট্রাভেল এজেন্ট রোওয়ান জানিয়েছিলেন, শ্রীলঙ্কায় পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। সব থেকে বেশি বাড়ছে ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা। ‘বেশির ভাগই ফ্যামিলি ট্যুরিস্ট। এই যেমন আপনি মেয়ে, বউ নিয়ে এসেছেন।’
তা ছাড়া চেন্নাই থেকে অনেকেই এক দু’দিনের জন্য কলম্বো আসেন ক্যাসিনোয় জুয়া খেলতে। রোওয়ান এ-ও জানিয়েছিলেন, ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যেই প্রায় ৬ লক্ষ ভারতীয় পর্যটক বেড়াতে গিয়েছেন শ্রীলঙ্কায়। সংখ্যাটা ক্রমশ আরও বাড়বে।
তাই কি?
গত দশ বছরে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল শ্রীলঙ্কা। তার মূলত পর্যটনের উপর ভর করে। ইস্টার সানডের সকালে কলম্বোর যে ছবি দেখল গোটা বিশ্ব, তার পর এখুনি সপরিবার সেখানে বেড়াতে যাওয়ার সাহস পাবেন কি সবাই! কে জানে!