কাঁটাতারের বেড়া টপকানো কাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে? সোনারপুরে কি ব্যাখ্যা দিলেন শুভেন্দু?

মালদহের সভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যে মন্তব্য করেছিলেন, তা দলের ‘ঘোষিত অবস্থান’ নয় বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। পাশাপাশিই, বিরোধী দলনেতা নিজের মালদহে করা মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন রবিবার সোনারপুরে। তবে তাতেও বিতর্ক পুরোপুরি মিটবে কি না, তা নিয়ে বিজেপির অন্দরে প্রশ্ন রয়েছে। তাদের আশঙ্কা, প্রথম বক্তব্যের ভিডিয়ো ক্লিপ যে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে শাসক তৃণমূল সেটি ব্যবহার করতে পারে। যদিও পাশাপাশিই তারা মনে করছে, শনিবার মন্তব্যের পরে দলে যে ‘অস্বস্তি’ তৈরি হয়েছিল, তার অনেকটাই কেটে গিয়েছে স্বয়ং শুভেন্দু বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়ায়।

শনিবার মালদহের জনসভায় শুভেন্দু বলেছিলেন, কাঁটাতার পেরিয়ে আসা সকলকেই কাঁটাতারের ওপারে ফিরে যেতে হবে। হিন্দু বা মুসলমান সকলকেই। তিনি বলেছিলেন, ‘‘যে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকেছো, তাকে কাঁটাতারের বেড়ার ও পারে যেতে হবে। সে হিন্দু হোক আর মুসলিম। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে এলে তার সঙ্গে কোনও ব্যাপার নেই।’’ যদিও বিজেপির চোখে বিষয়টা এত সরল নয়। গেরুয়া শিবির কাঁটাতার পেরিয়ে আসা মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ মনে করলেও ও পার থেকে আসা হিন্দুদের ‘শরণার্থী’ মনে করে। তা হলে কি দলের ঘোষিত নীতির বাইরে শুভেন্দুর বক্তব্য? রবিবার প্রশ্ন করা হলে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত বলেছিলেন, ‘‘আমরা কাউকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চাই না। অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে সিএএ (সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন)-র মাধ্যমে বাকিদের নাগরিকত্ব দিতে চাই। এটাই আমাদের দলের অবস্থান।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘বিরোধী দলনেতা ঠিক কী বলেছেন আমি জানি না। তিনি ব্যক্তিগত মত দিয়ে থাকতে পারেন। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলে জানব, তিনি কোন পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা বলেছেন। তবে রাজ্যবাসীর উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই।’’

তবে তার আগেই রবিবার সোনারপুরের জনসভায় শনিবারের মন্তব্যের ব্যাখ্যা দেন শুভেন্দু। তিনি বলেন, ‘‘২০১৪ সালে বেড়া হয়েছে। ২০১৪ সালের পর বেড়া ডিঙিয়ে জামাত, জেএমবির লোকেদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢোকাচ্ছেন। আপনারা শুনে রাখুন, অমিত শাহজি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পরে গরুপাচার যেমন বন্ধ হয়েছে, তেমনই বর্ডারে (সীমান্তে) পারাপারও অনেক কমে গিয়েছে।’’ শুভেন্দু আরও বলেন, ‘‘গোসাবায় ১৪টা দ্বীপ। একটা দ্বীপে বিএসএফ রয়েছে। জলপথ দিয়ে ঢুকছে। আর বারুইপুর-কামালগাজির রাস্তা দিয়ে ও দিকে বাসন্তী এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বাংলাদেশ থেকে এসে ঢুকছে। যাঁরা বাংলাদেশে ‌মৌলবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চান, যাঁরা রাজাকারের পার্টি, যাঁরা শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চান। সেই জামাত, রাজাকার, জেএমবির লোকেরা ভারতে ঢুকছে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের ঢোকাচ্ছেন। তাদের সবাইকে ফেরত যেতে হবে।’’

প্রসঙ্গত, গত বছর সোনারপুর থেকে দুই জঙ্গিকে ধরা হয়েছিল। সেই ঘটনার উল্লেখ করে শুভেন্দু রবিবার বলেন, ‘‘গত বছর এই সোনারপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে আত্মগোপন করে থাকা আব্দুল মান্নান ও লাল্টু শেখ ধরা পড়েছিল। মনে আছে তো? তাই বিজেপি ছাড়া এই ভারতভূমিকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।’’

সিএএ নিয়ে এমনিতেই রাজ্য বিজেপি ‘বিব্রত’। করোনাসঙ্কট মিটে গেলে তা কার্যকর হবে বলে গত বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে রাজ্যে এসে বলেছিলেন শাহ। কিন্তু এখন আর সেই বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার সে ভাবে উচ্চবাচ্য করছে না। গেরুয়া শিবির সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনও ভাবনাচিন্তা করছেন। কারণ, তৃণমূল পাল্টা প্রচারে নামবে। আপাতত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকারের ন’বছর পূর্তি নিয়েই প্রচারে ঝাঁপাতে চায় বিজেপি। মোদী সরকার ন’বছরে কী কী উন্নয়নমূলক কাজ করেছে, কোন কোন প্রকল্পে দেশে সাফল্য এসেছে, সেটা ‘হাতিয়ার’ করেই লোকসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চাইছে তারা। ইতিমধ্যেই সেই প্রচার জোরকদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে রাজ্য বিজেপির নেতারা সিএএ কার্যকর হোক চাইছেন। সম্প্রতি এ নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বলে দলের সাংসদরা শাহকে জানিয়েছেন। সব শুনে শাহ তাঁদের অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। কিন্তু সেই অপেক্ষার সময় পার হয়ে গিয়েছে। এমনকি, সম্প্রতি রাজ্যসফরে এসেও শাহ সিএএ নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেননি।

রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের মনে পড়ছে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে রাজ্যে এসে মোদী শ্রীরামপুরের একটি সভায় বলেছিলেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশিদের পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে ফিরে যেতে হবে। পরে বিজেপির তরফে দাবি করা হয়, ‘বাংলাদেশি’ বলতে মোদী ‘অনুপ্রবেশকারী’ বুঝিয়েছেন। তবে তৃণমূল অনেক বেশি শক্তি নিয়ে এটা প্রচার করেছিল যে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা সকলকেই চলে যেতে হবে। নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে অনেক পুরনো নথিপত্র দেখাতে হবে। রাজ্য বিজেপি নেতারা আশঙ্কা করছেন, সামনেই পঞ্চায়েত ভোট এবং তার পরেই লোকসভা নির্বাচন। তখন ফের তৃণমূল বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি শুরু করলে দলের উপর প্রভাব পড়তে পারে। তবে স্বয়ং শুভেন্দু সোনারপুরে বিষয়টির খোলসা করে দেওয়ায় তাঁদের উদ্বেগ কিছুটা হলেও কমেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.