প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক বরুণ দাসগুপ্ত। বয়স হয়েছিল ৮৬।
বর্ণময় জীবন ছিল বরুণদার। অসমে চার দশকের সংগ্রামের একটা অধ্যায়ে যতিচিহ্ণ পড়তে চলেছে। গত শতকের ছয়ের দশকে বড়োরা স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরির জন্য তাদের বিপ্লব শুরু করেছিল। বিভিন্ন সময় দফায় দফায় দীর্ঘ আলোচনার পর তৈরি হল বড়োল্যান্ড। তারিখটা ছিল ২০০৪-এর ৫ ডিসেম্বর। তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী-সহ তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রমুখয়ছিলেন ওই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে।
সরকারের তরফে বাছাই কিছু সাংবাদিককে কোকরাঝাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল খবর করার জন্য। অনুষ্ঠান শুরুর বেশ কিছুটা আগে সাংবাদিকরা একটি ঘরে গল্প করছেন। হঠাৎ ২-৩টি ছাত্র এল। অসমে বড়ো-আন্দোলনের উদ্ভব ও বিবর্তনের বিশদ জানতে চায় তারা। সাংবাদিকরা চোখ বন্ধ করে পাঠিয়ে দিল অপর একটি নির্দিষ্ট ঘরে, বরুণদা-র নাম করে।
ওই ঘরে আমি একা নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছি বরুণদার সঙ্গে। ছাত্ররা এসে নিবেদন করলেন। টানা এক ঘন্টার ওপর কোনও বই না দেখে দিন-সালের উল্লেখ করে বরুণদা ওদের বোঝালেন বড়ো-আন্দোলন সম্পর্কে। প্রথমে আমিও কিছু নোট নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। অচিরেই কলম গুটিয়ে নিলাম। আলোচনা শেষে শুধু বললাম, “বরুণদা যদি আপনার বক্তব্যটা টেপ করে রাখা যেত, একটা দূর্মূল্য দলিল হত।”
একটি নামী দৈনিকের সাংবাদিক হিসাবে প্রায় দেড় বছর গুয়াহাটিতে ছিলাম। বরুণদা একটি সর্বভারতীয় দৈনিকের প্রতিনিধি হিসেবে বেশ ক’বছর ছিলেন গুয়াহাটিতে। তাই নানা সময় প্রমাণ পেয়েছি একটি মানুষের জ্ঞান এবং স্মৃতিশক্তি কতটা প্রখর হতে পারে। ক’বছর আগে ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টসের স্মরণিকায় ‘আমার চোখে দুই সেরা সাংবাদিক’ শীর্ষক প্রতিবেদন লিখেছিলাম। দুই সেরা সাংবাদিকের একজন ছিলেন বরুণ দাসগুপ্ত।
মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় তাঁর অনুগামী সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত সোদপুরে একটি আশ্রম তৈরি করেছিলেন। প্রায় সেখানেই ছেলেবেলায় থাকতেন সতীশবাবুর ভাইপো বরুণদা। বাচ্চা বরুণদা-র কাঁধে হাত রেখে হাঁটছেন গান্ধীজী— অনেকে সেই ছবির সঙ্গে পরিচিত। বরুণদার ঘনিষ্ঠ ছিলেন অশীতিপর আর এক প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক হিমাংশু হালদার। এই প্রতিবেদককে জানালেন, “একবার গান্ধীজী সোদপুরে গিয়ে বরুণদার দেখা পেলেন না। গান্ধীজী সোদপুর থেকে ট্রেনে শিয়ালদহে আসবেন বলে রওনা হয়েছেন। সে সময় শুনলেন বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে বরুণদা শয্যাশায়ী। আবার তিনি ফিরে এলেন আশ্রমে। বরুণদার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ফের রওনা দিলেন।
কোনওদিন স্কুলে পড়েননি। কিন্তু জ্ঞানের ভান্ডার ছি অফুরন্ত। বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি তো বটেই দক্ষ ছিলেন ওড়িয়া-অসমীয়া-উর্দূতেও। পরে জড়িয়ে পড়েন আরসিপিআই-এর সঙ্গে। পান্নালাল দাশগুপ্তর ঘনিষ্ঠ অনুগামী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে জরুরি অবস্থায় গৌরকিশোর ঘোষ বেশ কিছুকাল জেলে ছিলেন। সাতের দশকের মাঝপর্বে কারামুক্তির পর তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশ হয় ‘আজকাল’। সে সময় কয়েক বছর বরুণদা ওই পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। এর পর সাংবাদিকতা করেছেন একাধিক নামী ইংরেজি দৈনিকে। মননশীল এবং বিশ্লেষণমূলক লেখায় দাগ রেখেছেন পাঠকমহলে।
বরুণদা-র জীবনও ছিল যেন অ্যাডভেঞ্চারের মত। লরিবোঝাই টিনের ক্যানেস্তারার ফাঁকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে মণিপুরের এক গ্রামে গিয়েছিলেন। নানা অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ছিল তাঁর জীবন। কয়েক বছর আগে প্রয়াত হন তাঁর স্ত্রী রুচিরা শ্যাম। এর পর একাকীত্ব অনেকটাই গ্রাস করে তাঁকে। হিমাংশু হালদার জানান, “পান্নালাল দাশগুপ্ত একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। রুচিরা সেই পত্রিকায় কাজ করতেন। সেই সুবাদে ওঁদের পরিচয় হয়। ঘর বাঁধেন।”