মোদীর বক্তৃতায় ‘মোদী’ নেই, ‘মোদীর গ্যারান্টি’-ও উধাও! প্রথম দফার ভোটের পরে কৌশল বদল বাংলায়?

তাঁর ভোটের বক্তৃতায় ‘মোদী’ শব্দকে অলঙ্কার বানিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। পশ্চিমবাংলায় লোকসভা ভোটের যত সভা তিনি করেছেন, তাতে বারংবার তাঁর ভাষণে ‘মোদী নে কিয়া’, ‘মোদী কা সপ্‌না’ শোনা গিয়েছে। কিন্তু শুক্রবার মালদহ উত্তরের সমাবেশে তিনি ‘মোদী’ অলঙ্কার খুলে রেখেই বক্তৃতা করলেন।

প্রধানমন্ত্রীর মিনিট পঁচিশেকের বক্তৃতায় এক বারের জন্যও ‘মোদী কি গ্যারান্টি’ শব্দবন্ধ শোনা গেল না। যদিও এই লোকসভা নির্বাচনে এটাই বিজেপির স্লোগান। একটা সময় পর্যন্ত ‘এ বার ৪০০ পার’ স্লোগানকে গুরুত্ব দেওয়া হবে বলা হলেও বিজেপি দলের ইস্তাহার প্রকাশ করার পরে দেখা যায় সেটির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘মোদী কি গ্যারান্টি ২০২৪’। কিন্তু বৃহস্পতিবার সেই স্লোগান একটি বারও মোদীর গলায় শোনা গেল না। তবে সেটা শুধুই মালদহে। এর পরে বিহারের পূর্ণিয়ায় সভা করেন মোদী। সেখানে তাঁর মুখে ‘মোদী’ বা ‘মোদীর গ্যারান্টি’ দুই স্লোগান শোনা গিয়েছে। তবে কি বাংলার জন্যই এই বদল?

শুক্রবার উত্তরবঙ্গের আটটি আসনের জন্য প্রচার শেষ হল মোদীর। মালদহ উত্তরের খগেন মুর্মু এবং মালদহ দক্ষিণের শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরীর হয়ে প্রচার করে ফিরে গেলেন তিনি। এর আগে আরও ছয় প্রার্থীর হয়ে প্রচারে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর বক্তৃতায় বারংবার শোনা গিয়েছিল ‘মোদী’ শব্দ। শুক্রবার যা শোনা গেল মাত্র একটি বার! প্রায় ২৪ মিনিটের বক্তৃতার একেবারে শেষে তিনি প্রতি বারের মতোই প্রধানমন্ত্রী সমাবেশের উদ্দেশে বললেন, ‘‘সকলে নিজের নিজের এলাকায় ফিরে সবাইকে মোদীর প্রণাম জানাবেন।’’

বার তিনেক ‘আমি’। কিন্তু ‘মোদী’ এক বারও নয়। বরং শুক্রবার ‘বিজেপি সরকার’ বলেছেন মোদী। কিন্তু কেন? প্রথম দফার ভোটের পরে কি প্রচারের ‘কৌশল’ বদল করলেন মোদী? রাজ্য বিজেপি অবশ্য সেটা মনে করছে না। দলের রাজ্যসভা সাংসদ তথা মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটা বড় পরিচয় হল তিনি সুবক্তা। আর সুবক্তারা একই কথা, একই ঢঙে বার বার বলেন না। পরিবর্তন করেন। সেটাই হয়েছে মালদহে।’’

তবে এই রাজ্যের মোদীর বক্তৃতায় এই আকস্মিক বদলের পিছনে অন্য জল্পনাও কাজ করছে। প্রথম দফা ভোটের পরেই এই আলোচনা শুরু হয়েছে। তা হল ভোটদানের হার। গোটা দেশে ২১ রাজ্যের ১০২টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছিল গত ১৯ এপ্রিল। সেটিই প্রথম দফা। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী প্রথম দফায় গড় ভোট পড়ে ৬৯.৩০ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালে প্রথম দফায় ভোট পড়েছিল ৬৯.৪৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে ভোটের হার খুব কমেনি। তবে গোটা দেশের গড় বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছে পশ্চিমবাংলা। রাজ্যের তিন আসনের গড় ৭৭.৭৫ শতাংশ ভোটই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিজেপির ‘শক্তি’ বেশি, এমন রাজ্যগুলির মধ্যে উত্তরপ্রদেশে ভোট পড়েছে ৫৭.৬১ শতাংশ, রাজস্থানে ৫০.৯৫ শতাংশ। গড় ভোট সব চেয়ে কম বিহারে। প্রথম দফায় রাজ্যের চারটি আসনে গড় ভোট পড়েছে ৪৭.৪৯ শতাংশ।

দেশের সর্বত্রই তীব্র গরম এবং তাপপ্রবাহ চলছে। সেই কারণেই কি ভোটদানের হার তুলনায় কম? এমন প্রশ্ন ছাড়াও দু’টি যুক্তি রয়েছে। অনেকে এমন মতামতও প্রকাশ করছেন যে, ২০১৪ বা ২০১৯ সালের মতো ভোট নিয়ে ‘আগ্রহ’ নেই ভোটারদের মধ্যে। কারণ, তৃতীয় বার মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা এক রকম নিশ্চিত বলেই প্রচার চলছে। তবে তৃতীয় প্রশ্নটি বিজেপির জন্য উদ্বেগের। বিরোধীরা এমন প্রশ্নও তুলছেন যে, এ বার ‘মোদী হাওয়া’ কম। তাই ভোটদানে উৎসাহও কম। সেটা সত্যি হলে মালদহে মোদীর বক্তৃতায় তারই ছাপ পড়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। সে জন্যই মোদীর মুখে ‘মোদী’-র পরিবর্তে ‘বিজেপি সরকার’। আর ‘আমি’ নেই। এ বার ‘সরকার’। বিহারের বক্তৃতাতেও মোদী বেশি করে ভোট দেওয়ার, সকাল সকাল ভোট দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন।

ভোটদানের হার বাড়ানোর জন্য এ বার অতীতের তুলনায় অনেক বেশি প্রচার করছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। সাধারণ প্রচারমাধ্যম তো বটেই, সেই সঙ্গে ‘বন্দে ভারত এক্সপ্রেস’ থেকে শুরু করে কলকাতা মেট্রোর কামরায় অনবরত গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগে উৎসাহবৃদ্ধির প্রচার চলছে। কিন্তু তার পরেও প্রধানমন্ত্রী মালদহের সভায় বক্তৃতার শুরুতে নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ বলে ব্যাখ্যা করে দ্বিতীয় দফায় যেখানে যেখানে ভোট, সেখানকার ভোটারদের আলাদা করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে দাবি করেন, প্রথম দফার ভোট বিজেপির পক্ষেই গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘বিরোধীরা প্রথম দফার ভোটেই ত্রস্ত হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ধ্বস্ত হয়ে যাবে।’’ মালদহে দুর্নীতি থেকে তোষণের রাজনীতির অভিযোগে কংগ্রেস-তৃণমূলকে এক সূত্রে গেঁথে আক্রমণ করেছেন মোদী। নিয়োগ দুর্নীতি থেকে সন্দেশখালি সবই ছিল তাঁর বক্তব্যে। শুধু ছিল না ‘মোদীর গ্যারান্টি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.