ভারতীয় গণতন্ত্র-নির্মাণের ভিতে ধাক্কা মারা বুলডোজ়ার-রাজ অবশেষে ‘গুঁড়িয়ে দিল’ সুপ্রিম কোর্ট। স্পষ্ট করে দিল, প্রশাসনও পারে না আইন হাতে তুলে নিতে। উত্তরপ্রদেশ-সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ‘অপরাধী’ বা অভিযুক্তদের বাড়ি বুলডোজ়ারে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় প্রশাসনের সাংবিধানিক এক্তিয়ার স্মরণ করিয়ে দেশের শীর্ষ আদালত স্পষ্ট করে দিল, আদালতের স্থান প্রশাসন নিতে পারে না।
বুলডোজ়ার মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, পুলিশ-প্রশাসন থেকে পুর-প্রশাসন কেউ ‘বিচারক’ নন। কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার এক্তিয়ার প্রশাসনের নেই। রয়েছে শুধু আদালতেরই। কোনও বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে হলে প্রশাসনকে কী কী নিয়ম মেনে করতে হবে, তা-ও নির্দিষ্ট করে দিল সুপ্রিম কোর্ট।
দীর্ঘ দিন ধরেই দেশের বিরোধী দলগুলির অভিযোগ ছিল, বিজেপি পরিচালিত একাধিক রাজ্য সরকার আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই বুলডোজ়ার নিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর। বিচারাধীন বিষয়ে কাউকে এ ভাবে ‘শাস্তি’ দেওয়ার সাংবিধানিক এক্তিয়ার বা অধিকার কোনও সরকারের আছে কি না, এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন মানবাধিকার কর্মীরাও। মামলা হয় সুপ্রিম কোর্টে।
সেই মামলাতেই বুধবার রায় শোনাল শীর্ষ আদালত। বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ জানিয়ে দিল, বাসস্থানের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার থেকে কোনও মানুষকে বঞ্চিত করা ‘অসাংবিধানিক’। এমনকি কেউ অপরাধ করলেও তাঁর বাড়ি ভেঙে ফেলা যায় না। এটি অসাংবিধানিক।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশাসন যে ভাবে ‘বিচারক’-এর ভূমিকা পালন করে কাউকে ‘দোষী সাব্যস্ত’ পর্যন্ত করে ফেলছে, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। আইনের ঊর্ধ্বে উঠে কাউকে শাস্তি দেওয়ার এক্তিয়ার প্রশাসনের নেই। বুধবার বিচারপতিগাভাই বলেন, ‘‘এই ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না। কে দোষী আর কে দোষী নয়, তা কোনও ব্যক্তি বিচার করতে পারেন না। কেউ এ ভাবে আইন হাতে তুলে নিতে পারেন না।’’ আইন গণতন্ত্রের ভিত বা ভিত্তি, মনে করিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট।
একই সঙ্গে আদালত জানিয়েছে, কোনও বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে হলেও তা করতে হবে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই। এ বিষয়ে সংবিধানের ১৪২ ধারা অনুযায়ী নির্দেশিকা জারি করেছে দুই বিচারপতির বেঞ্চ। শীঘ্রই সারা দেশে কার্যকরী হবে এই নিয়মবিধি। বলা হয়েছে, নির্দেশগুলির একটিরও লঙ্ঘন হলে দায়ী থাকবেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকেরাই। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পত্তি পুনর্নিমাণের জন্য আধিকারিকদের নিজের বেতন থেকে ক্ষতিপূরণও দিতে হতে পারে! তবে রাস্তা ও ফুটপাতের মাঝে, কিংবা নদীর ধারে অবৈধ ভাবে তৈরি কাঠামোগুলির ক্ষেত্রে এই নির্দেশিকা প্রযোজ্য হবে না।
নয়া নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, কোনও বেআইনি কাঠামো ভেঙে ফেলার নির্দেশ পাশ হলেই তা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করা যাবে না। অভিযুক্তকে ওই নির্দেশের বিরুদ্ধে আবেদন করার জন্য সময় দেওয়া হবে। শুধুমাত্র কারও বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বাড়ি ভাঙা যাবে না। আগে থেকে শোকজ় নোটিস দিতে হবে। কোনও বাড়ি ভাঙার নির্দেশ এলে আগে ওই বাড়ির মালিককে লিখিত আকারে নোটিসটি পাঠানো হবে। নোটিসের একটি অনুলিপি বাড়ির বাইরেও সেঁটে দেওয়া হবে। সেই নোটিস পাঠানোর পর ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে। তার পরে আরও এক সপ্তাহ অতিরিক্ত সময় পাবেন বাড়ির মালিক। ওই সময়সীমা শেষ হলে তবেই বিষয়টি জেলাশাসককে জানানো হবে। এর মাঝে আদালতের নির্দেশ-সহ বিস্তারিত নোটিসটি একটি নির্দিষ্ট ডিজিটাল পোর্টালে আপলোড করতে হবে। কী কারণে ওই কাঠামো ভাঙা হচ্ছে, কবে আবেদনের শুনানির তারিখ নির্ধারিত হয়েছে, নোটিসে সে সবের বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে। এর পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আবেদন শুনে চূড়ান্ত নির্দেশ পাশ হবে। যদি ওই নির্মাণ সত্যিই বেআইনি না-হয়, তা হলে কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শাতে হবে। শেষ নির্দেশ আসার পর ১৫ দিন পর্যন্ত বাড়ির মালিককে অবৈধ কাঠামোটি সরানোর সুযোগ দেওয়া হবে। এর মাঝে যদি আপিল বিভাগ ওই রায়ের উপর স্থগিতাদেশ জারি না-করে, শুধুমাত্র তা হলেই বাড়িটি ভাঙতে পারবে প্রশাসন। ভাঙার গোটা প্রক্রিয়াটির ভিডিয়ো রেকর্ড করা বাধ্যতামূলক। ওই ভিডিয়ো সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। গোটা প্রক্রিয়ার রিপোর্ট পুরসভার কমিশনারের কাছে পাঠাতে হবে।
‘বুলডোজ়ার নীতি’ নিয়ে এর আগেও প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট। এই মামলায় গত ১ অক্টোবর অন্তর্বতী আদেশের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়ে আদালত জানায়, পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কোনও বাড়ি কিংবা দোকান বুলডোজ়ার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কেন্দ্রের উদ্দেশে দুই বিচারপতি তখনও প্রশ্ন ছুড়ে দেন, কোনও ব্যক্তি অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর বাড়ি বুলডোজ়ার দিয়ে ভেঙে ফেলা হবে কেন? আদালত বলেছিল, যে কোনও বাড়ি ভাঙার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকা উচিত।
গত কয়েক বছরে একাধিকবার বুলডোজ়ার নীতির পথে হেঁটেছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সরকার। উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রশাসনের বিরুদ্ধে এই ধরনের কাজের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালে বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে উত্তরপ্রদেশের আটটি জেলায় হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে ৩৩৩ জনের নামে এফআইআর দায়ের হয়েছিল। তার পরেই ভাঙা হয় বেশ কয়েক জন অভিযুক্ত এবং তাঁদের আত্মীয়দের বাড়ি। মধ্যপ্রদেশেও শিবরাজ সিংহ চৌহান মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন একই ভাবে বুলডোজ়ার দিয়ে অভিযুক্তদের বাড়ি ভাঙার অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগ ছিল উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামীর সরকারের বিরুদ্ধেও। এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনের ঠিক এক বছরের মাথায় বুলডোজ়ার চলেছিল দিল্লির শাহিনবাগে। সেই বুলডোজ়ার-রাজেই ইতি টানতে চাইল শীর্ষ আদালত।