শ্রীরামকৃষ্ণ মা কৌশল্যার মতোই রামলালার যত্ন করেছেন

একবার শ্রীরামকৃষ্ণ বাগবাজারে বলরাম ভবনে এসেছেন। সেদিন তিনি নিজেই রামলালার কথা তুললেন। কেমন করে রামলালাকে স্নান করাতেন, রামলালা কেমন দুরন্তপনা ক’রত ইত্যাদি লীলা-বৃত্তান্ত বলতে লাগলেন। বললেন, একদিন খই খাওয়াতে গিয়ে একটা ধান রামলালার মুখে লেগে গেল, “যে মুখে মা কৌশল্যা কত ক্ষীর সর ননী দিতেও সঙ্কোচ বোধ করতেন, আজ আমি সেই মুখে ধান দিলাম।” এই বলে শ্রীরামকৃষ্ণ কাঁদতে লাগলেন এবং ভাবস্থ হয়ে গেলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ সেই অষ্টধাতুর রামলালার শৈশব মূর্তিটি পেয়েছিলেন জটাধারী রামাইত সাধুর কাছ থেকে। সাধু দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন এবং তখন সেই মূর্তিতে রামপূজন করতেন, সাধন-ভজন-আরাধন করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ নিবিষ্ট মনে চেয়ে চেয়ে দেখতেন। মন চাইলো, মায়ের স্নেহে, কৌশল্যা মায়ের মতোই রামলালাকে সেবা করবেন। গদাইয়ের আগ্রহ দেখে সাধু রামলালার মন্ত্র দিলেন। রামের অনুসারী হলেন গদাধর। তখন রামলালাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান; শিশুমূর্তিতে প্রেমাকূল তিনি। অনুভব করলেন, জ্যোতির্ময় শ্যামবর্ণ শ্রীরামচন্দ্র নিত্য পুজো নিচ্ছেন তাঁর। অবশেষে আবির্ভূত হলেন স্বয়ং দশরথ-তনয় রঘুপতিরাম। সাধনায় সিদ্ধ হলেন। দিব্যলীলা দেখে সাধু শ্রীরামকৃষ্ণকেই দিয়ে গেলেন বিগ্রহ। এক উপযুক্ত উত্তরাধিকার বটে!

শ্রীরামকৃষ্ণের পিতা ক্ষুদিরাম এক গ্রীষ্মের দুপুরে দূর গ্রামে গেছেন। ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত। পথে বড় এক গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়লেন। দেখলেন বিচিত্র স্বপ্ন। এক শ্যামলা ছেলে সঙ্গে যেতে চায়!:ক্ষুদিরামের তখন নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কিন্তু এ যে শ্যামলসুন্দর! এ যে বালক রঘুবীর! দেবসেবার সামর্থ্য তাঁর কোথায়! বালক বললে, “যেভাবে রাখবে, সেভাবেই থাকবো।” ঘুম ভেঙ্গে গেল তাঁর। স্বপ্ন নির্দেশে পাশের ধানক্ষেতে গেলেন। মাটির ঢিপি, পাশে শালগ্রামশিলা। তার পাশে ফণীধর সাপ। তিনি যেতেই সাপ সরে গেল। আনন্দে মাথায় তুলে নিলেন রামলালারূপ শিলাখণ্ড। চিনতে ভুল হল না তাঁর। এ যে রঘুবীর শিলা! এই রঘুবীরই হয়ে উঠলেন আদরের রামলালা, শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহদেবতা।

শ্রীরামকৃষ্ণের পিতামহ মানিকরামেরও দিন কাটতো রঘুবীরের সেবায়। পিতা ক্ষুধিরাম রঘুবীরের পুজো না করে জলস্পর্শ করতেন না। বাসভূমি ‘দেড়ে’ গ্রাম ছেড়ে জমিদারের অত্যাচারে যখন কামারপুকুর আসতে হল, তখন প্রায় কর্মহীন ক্ষুদিরামের সিংহভাগ কাটতো আরাধ্য রঘুবীরকে নিয়ে। রামই তখন তাঁর একমাত্র শান্তি, প্রাণের আরাম।

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাসমণির ঘরেও ছিল রঘুবীর। একবার গ্রীষ্মে এসে হাজির হলেন এক অপরিচিত সন্ন্যাসী। তাঁর স্বামী রাজচন্দ্রের সাক্ষাৎ চান। পীড়াপীড়ি করছেন দেউড়িতে। অবশেষে অনুমতি পেলেন। সন্ন্যাসী দোতালায় গেলেন রাজচন্দ্রের কাছে, “আমার কাছে রঘুনাথজিউ শিলা। আপনাকে দেবো। আপনি সেবা করবেন। মঙ্গল হবে। আমি বহুদূর তীর্থদর্শনে যাবো; ফিরবো কিনা জানি না।” সন্ন্যাসী রাজচন্দ্রকে শিলা অর্পণ করলেন। বিনিময়ে তিনি কিছুই নিলেন না। বিদায় নিলেন তিনি। সেই থেকে রঘুনাথজী প্রতিষ্ঠিত হলেন রাসমণির ঠাকুর ঘরে। রাজচন্দ্র পাশে রুপোর হনুমান মূর্তি গড়ে দিলেন। মাহিষ্য জমিদারিতে কুলদেবতা হলেন রঘুনাথজিউ৷

শ্রীরামকৃষ্ণের দাদা রামকুমার কেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সেবাকাজের ভার পেলেন? দুজনেই রঘুবীরের উপাসক, এক আশ্চর্য সমাপাতন। রাসমনি কী চান নি শ্রীরাম ঘরানার কোনো পুরোহিতই আদ্যাশক্তির ভার নিন! রাম যোদ্ধা, ক্ষত্রিয় বীর। মা-কালী অসুর-দলনী। দেশপ্রেমী জমিদার গিন্নীর নেপথ্য ভাবনা কী ছিল না, বাঙলায় বীর সাধনার পীঠ তৈরি হোক! সমন্বয় হোক রাম-কালীর!

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
(ছবি: শীর্ষ আচার্য)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.