বছর তিন আগের কথা। তারিখটা ছিল ২০২১ সালের ১৯ মার্চ। সেদিন সকাল ১১টায় আলিপুর চিড়িয়াখানায় নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে শোরগোল শুরু হয়। কারণ, সিংহের খাঁচায় ঢুকে পড়েছেন এক যুবক! তড়িঘড়ি ওই যুবককে উদ্ধারের চেষ্টা হয়। সিংহের হামলায় পায়ে চোট পেলেও পরে সুস্থ হয়েই বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। তিন বছর পর ৩৫ বছরের সেই যুবকের কাণ্ডে শিহরিত সারা রাজ্য। তিনি গৌতম গুছাইত। পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর থানার চিস্তিপুর গ্রামের বাসিন্দা গৌতম বুধবার ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-তে স্ত্রীকে কাটারি দিয়ে খুন করেছেন বলে অভিযোগ। স্ত্রীর কাটা মুন্ডু হাতে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ইতিমধ্যে গৌতমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অভিযুক্ত যাতে কোনও ভাবেই না ছাড়া না পান সেই দাবিতে সরব হয়েছেন এলাকাবাসী। কিন্তু কেন এমন করলেন গৌতম? কী ঘটেছিল বাড়িতে?
অভিযুক্তের দাদা উত্তম গুছাইত বলেন, ‘‘বছর তিন আগে ভাই যখন সিংহের খাঁচায় ঢুকে পড়েছিল, সেই সময় ওর মানসিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়ে পড়েছিল। তবে পরে সুস্থও হয়ে যায়।’’ গৌতমের ভরা সংসার। নিজে হকারি করেন। ফুলরানির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। দম্পতির এক সন্তান পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, কয়েক দিন ধরে গৌতম এবং ফুলরানির মধ্যে খিটিমিটি লেগে ছিল। কিন্তু সে তো অনেক দম্পতির মধ্যেই হয়। সেখান থেকে কী ভাবে স্ত্রীকে এমন করে খুন করে ফেললেন গৌতম? এর নির্দিষ্ট জবাব মেলেনি। বস্তুত, গৌতনের পুরো পরিবারই হতভম্ব এই ঘটনায়। ইতিমধ্যে গৌতমের বাবা-মাকে আটক করেছে পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ধৃত গৌতমের ভাই উত্তমের অবশ্য দাবি, দাদার পরিবারে অশান্তি ছিল না। তাঁর কথায়, “ওদের পরিবারে তেমন কোনও সমস্যা কখনও নজরে আসেনি। আর পাঁচটা পরিবারের মতোই সব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার মাঝে ভাইয়ের এমন রূপ দেখতে হবে কল্পনাও করতে পারিনি।’’
প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, গৌতম আর্থিক ভাবে বিশেষ স্বচ্ছল ছিলেন না। থাকেন ছোট্ট ঝুপড়িতে। স্ত্রী এবং এক ছেলেকে নিয়ে সংসার। বাবা- মা ও দাদা-বৌদি সবাই আলাদা থাকেন। সংসার চালাতে চিপস্-সহ বিভিন্ন রকম মুখরোচক খাবার বানিয়ে রাস্তার ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন গৌতম। বুধবারও তাঁর বাড়িতে বেশ কিছুটা ভাজাভুজি তৈরি হয়েছিল। আরও কিছুটা চিপস্ ভাজার জন্য তৈরি করে রাখা ছিল। ঝুপড়ির বাইরে উনুনে এই চিপস ভাজার সময়ই কিছু একটা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বচসা বাধে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই সময় বাড়ির ভিতর থেকে কাটারি তুলে এনে স্ত্রীর গলায় বসিয়ে দেন গৌতম। তার পর ২৭ বছরের ফুলরানির কাটা মুন্ডু হাতে নিয়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে বলতে বাড়ি থেকে এক ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে যান।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তথা গৌতমের প্রতিবেশী রাখাল গুছাইতের কথায়, ‘‘বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ আচমকা গৌতমকে প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে ছুটতে দেখে সবাই চমকে ওঠে। তখনই দেখা যায় স্ত্রীর কাটা মাথা এক হাতে এবং অন্য হাতে ধারাল কাটারি নিয়ে গর্জন করছে ও। এলাকার কয়েক জন ওর পিছু নিই। তখন ছুটে গিয়ে বাস যাওয়ার বড় রাস্তায় চলে যায় ও। সেখানে নিজেই দড়ি দিয়ে চার পাশ বেঁধে একটি বেঞ্চে বসে ছিল। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘কখন পুলিশ আসে আমি দেখি। এই দেশ কতটা এগিয়েছে আমি দেখতে চাই।’’’ রাখাল আরও জানান, গৌতমের হিংস্র চেহারা দেখে সকলেই ঘাবড়ে যান। তাই কেউই আর কাছে যেতে সাহস পাননি। এলাকার কেউ পুলিশকে ফোন করে খবর দেন।
স্থানীয়দের দাবি, সকালেও কেউ কেউ গৌতমকে দেখেছেন। কিন্তু তখন কোনও অস্বাভাবিকতা নজরে আসেনি। তার মধ্যে কী ঘটেছে, কেউই জানেন না।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “পটাশপুরে স্ত্রীর মুন্ডু কেটে দেওয়ার ঘটনায় মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মৃতদেহ এবং কাটা মুন্ডুও উদ্ধার করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত চলছে। কী কারণে এমন ঘটনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’’