গুলিকাণ্ডের পর হুমকি ২০ লক্ষ টাকা চেয়ে! বিরিয়ানির সেই দোকানই কেন বার বার দুষ্কৃতীদের লক্ষ্য হয়?

দু’বছর আগে গুলি চলেছিল বিরিয়ানির দোকানে। গুলিবিদ্ধও হয়েছিলেন দু’জন। উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগড়ের প্রসিদ্ধ সেই বিরিয়ানির দোকান ‘ডি বাপি’র মালিক-পুত্রের কাছে ২০ লক্ষ টাকা চেয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠল! অভিযোগ, ‘তোলা’ না-দিলে গুলি চালানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে। কয়েক দিন আগেই ব্যারাকপুরের ব্যবসায়ী অজয় মণ্ডলের গাড়িতে গুলি ছুড়ে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে টানাপড়েন অব্যাহত। সেই আবহেই এলাকার আরও এক ব্যবসায়ীকে হুমকি দেওয়ায় শোরগোল পড়েছে। ব্যারাকপুর-টিটাগড় চত্বরে একাধিক নামী বিরিয়ানির দোকান রয়েছে। কিন্তু কেন বার বার ‘ডি বাপি’ দুষ্কৃতীদের লক্ষ্য হয়ে উঠছে, সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে এলাকায়।

বুধবার বিরিয়ানির দোকানের মালিক বাপি দাসের পুত্র অনির্বাণ দাস অভিযোগ করেছেন, তাঁর কাছে ২০ লক্ষ টাকা ‘তোলা’ চেয়েছিল দুষ্কৃতীরা। তিনি সেই টাকা দিতে রাজি না-হওয়ায় তাঁকে এ বার হুমকি দেওয়া শুরু হয়েছে। তাঁকে কখনও ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে, কখনও ব্যক্তিগত বার্তায়। নম্বরপ্লেটহীন দু’টি বাইকে চার জন তাঁর গাড়ির পিছু নিয়ে ‘রেকি’ও করেছে বলে অভিযোগ করেছেন অনির্বাণ। হোয়াট্‌সঅ্যাপে কথোপকথনের কয়েকটি স্ক্রিনশটও প্রকাশ্যে এনেছেন তিনি। সেগুলির সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যদিও যাচাই করেনি। অনির্বাণের দাবি, হোয়াট্‌সঅ্যাপ চ্যাটে তাঁকে হুমকি দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘জিত, দুবারা কুছ করনে পর মজবুর নেহি করো।’’ বাংলা তর্জমা— জিত, দ্বিতীয় বার কিছু করতে বাধ্য কোরো না। তার উত্তরে লেখা হয়েছে, ‘‘কেয়া দুসমনি হ্যায় ভাই তুমসে! কাঁহে অ্যায়সা কর রহে হো।’’ বাংলা তর্জমা— ‘‘আপনার সঙ্গে কী শত্রুতা? কেন এটা করছেন?’’

অনির্বাণ দাবি করেন, নিজেকে বাঁচাতে দিনের পর দিন গৃহবন্দি থেকেছেন তিনি। কখনও বাড়ি পাল্টেছেন, কখনও গাড়ি! তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসা করলেই কি টাকা দিতে হবে তোলাবাজদের? এ ভাবে কদ্দিন বাঁচব?’’ অনির্বাণ জানান, গোটা ঘটনা পুলিশকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তার কোনও সুরাহা হয়নি এখনও।

২০২২ সালেও ‘ডি বাপি’র বিরিয়ানির দোকানে কয়েক রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল কয়েক জন দুষ্কৃতী। ওই ঘটনায় বিরিয়ানির দোকানের এক কর্মচারী এবং এক জন ক্রেতা জখম হন। সেই সময় বাপি পুলিশকে জানিয়েছিলেন, মোবাইলে একটি হুমকি ফোন এবং মেসেজ আসে। পুলিশ সূত্রে খবর, হুমকি বার্তার সূত্র ধরে দমদম জেলে বন্দি সুজিত রায় নামে এক আসামির নাম উঠে এসেছিল। দাবি, জেলবন্দি সুজিতই তোলা চেয়ে হুমকি দিয়েছিলেন বাপিকে। তাতে পাত্তা না দেওয়ায় সুজিতই তার বশংবদ দুষ্কৃতীদের পাঠিয়েছিলেন গুলি চালানোর জন্য। এ বারও তোলা নিয়ে বিবাদের জেরে গুলি চলতে পারে বলে আতঙ্কিত দোকানের কর্মীরা।

এখন প্রশ্ন উঠছে, ব্যারাকপুর ও তার সংলগ্ন এলাকায় একাধিক নামী বিরিয়ানির দোকান থাকা সত্ত্বেও কেন ‘ডি বাপি’ই নিশানা হয়ে ওঠে? পুলিশের একটি অংশের মত, ওই এলাকায় তোলাবাজির বড় চক্র চলে। তা রুখতে পুলিশ নিজের মতো করে পদক্ষেপ করে। কিন্তু তার পরেও সেই চক্র সক্রিয় থাকে। হতে পারে, এলাকার বাকি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সেই চক্রের ‘ভাল বোঝাপড়া’ রয়েছে। তাই সেই ভাবে তাঁদের উপর হামলার ঘটনা দেখা যায় না। কিন্তু সময় মতো তোলা না দিলে বিবাদ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘সাম্প্রতিক কালে ব্যবসা বাড়িয়েছে ডি বাপি। টিটাগড় ছাড়াও এখন ব্যারাকপুর, বারাসত, মধ্যমগ্রাম ও সোদপুরে তাদের আউটলেট খুলেছে। ফলে তোলাবাজদের দাবিদাওয়া বাড়বেই। বিরিয়ানির প্রতি প্লেটের উপর এদের তোলা ধরা থাকে। সময় মতো তা না দিলেই হুমকি দেয়!’’

তদন্তকারীদের একটি সূত্রে খবর, দীর্ঘ দিন ধরে এলাকায় তোলাবাজির যে সব উঠেছে, তার অধিকাংশ ঘটনাতেই বিহারের জেলে বন্দি ‘কুখ্যাত দুষ্কৃতী’ সুবোধ সিংহের নাম উঠে এসেছে। এক সময়ে বিহারে অপরাধ করে টিটাগড়ে এসে লুকোতেন সুবোধ। ২০১৯-এ ব্যারাকপুরে মণীশ শুক্লকে খুন, ২০২০ সালে আসানসোলে একটি স্বর্ণ ঋণ প্রদানকারী সংস্থায় ডাকাতি, ২০২২ সালে রানিগঞ্জে একটি গয়নার দোকানের মালিকের বাড়িতে হানার ঘটনায় তাঁর নাম উঠে এসেছিল। চলতি মাসে রানিগঞ্জ ও হাওড়ার ডোমজুড়ে সোনার দোকানে ডাকাতি হয়। দু’টিতেই তাঁর নাম জড়িয়েছে। রানিগঞ্জে সুবোধের দলের সদস্য সোনু সিংহের নেতৃত্বে ডাকাত দল হানা দিয়েছিল। ওই ঘটনায় সোনু-সহ পাঁচ জনকে গ্রেফতারও করা হয়। এর পরেই ব্যারাকপুরের ব্যবসায়ী অজয়ের গাড়িতে হামলার ঘটনায় নাম জড়ায় সুবোধের।

পুলিশে একাংশের দাবি, সুবোধ ফের টিটাগড়ে ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছেন। অজয়ের গাড়িতে গুলি চালিয়ে তিনি বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে, তাঁর কথা মতো কাজ না করলে বড় বিপদ হবে! হতে পারে, শুধু অজয়কেই নয়, অনেকের কাছেই সেই বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন সুবোধ। এ বার তাঁর নজরে ছিল ‘ডি বাপি’। ফলে শুধু ‘ডি বাপি’ই যে তাঁর নিশানায় রয়েছে, সে কথা বললে ভুল হবে! এ-ও হতে পারে, ‘ডি বাপি’র মালিকপুত্রকে হুমকি দিয়ে তাঁদের সমগোত্রীয় ব্যবসায়ীদের বার্তা দেওয়া হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের তরফে এখনও সরকারি ভাবে কিছু বলা হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.