ভারতে মুস্লিমদের চাপে থাকার তত্ত্ব আর সেন্সাসের হিসেব— একটি পর্যালোচনা

ভারতের অনেকের দাবি, এদেশে ভাল নেই মুসলমানেরা। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা কী? সেন্সাস এবং সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজের বিভিন্ন রিপোর্ট কী বলছে?

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫১-র প্রথম
জনগণনায় দেখা যাচ্ছে ভারতে মুস্লিমদের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৫৮ লক্ষ ৫৬ হাজার ৪৭। ২০১১-তে তা বেড়ে হয়েছে ১৭ কোটি ২২ লক্ষ ৪৫ হাজার ১৫৮। ১৯৬১, ’৭১, ’৮১, ’৯১, ২০০১ ও ২০১১— এই ছয় জনগণনায় ভারতে মুস্লিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৩১.১%, ৩০.৭%, ২৬.২%, ৩২.২%, ৩৪.৭%, ও ২৪.৭% শতাংশ। প্রশ্ন উঠেছে, ভারতে মুস্লিমরা যথেষ্ঠ ভাল না থাকলে তাঁদের এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হত? কিন্তু কী বলছেন মুস্লিম বিশিষ্টরা?

শফিক মহম্মদ কাসমি
(ইমাম, নাখোদা মসজিদ)

“সামাজিক মাধ্যমেই বোঝা যায়, ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর এক ধরণের অত্যাচার চলছে। উত্তর প্রদেশ-সহ দেশের কিছু রাজ্যে যেখানে সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রভাব বেশি, সেখানে রাষ্ট্রের পাশাপাশি বজরং দল, হিন্দু সেনার মত সংগঠন উৎপাত করছে।“ কিন্তু সংখ্যাতত্ব যে বলছে ভারতে মুস্লিমদের সংখ্যা বাড়ছে? “হ্যাঁ, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ। ২০ শতাংশ হিন্দু-মুস্লিম বিভেদ চাইছে। যেখানে সাম্প্রদায়িক শক্তি দুর্বল, সেখানে সেরকম সমস্যা নেই।
*

তাহেরুল হক
(সাধারণ সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শরিয়তি পঞ্চায়েত)

অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় ভারতে সংখ্যালঘুরা যথেষ্ঠ সুবিধা ভোগ করে এসেছে। সংবিধানে তাদের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ দেওয়া আছে। ভারতের বিচারব্যবস্থাও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সমাধান করে। তবে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার মুস্লিমদের সম্পর্কে কিছুটা বিরূপ হওয়ায় দেশের নানা স্থানে বহিরাগত তকমা দিয়ে গণধোলাইয়ের প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। সামনে আসছে মুস্লিম নির্যাতনের ছবি। মনে রাখা ভাল, ইসলাম কোনও নির্দিষ্ট দেশের বা ভৌগলিক গন্ডীর নয়।
*

ফুয়াদ হালিম
(চিকিৎসক এবং সমাজকর্মী)

ভারতের গরিব মানুষরা ভাল নেই। আর, দেশের গরিবদের বড় অংশ যেহেতু সংখ্যালঘু , তাঁরা ভাল নেই। এরা যাতে ঐক্য গড়ে তুলতে না পারে, বিভেদকামী শক্তি দিয়ে তাদের ধর্মের পরিচয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সংখ্যালঘু দরিদ্ররা সমস্যায় পড়ছে। প্রায় গোটা দেশে এই অবস্থা। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা বলা হয়েছে। এটা দেখা কেন্দ্র-রাজ্য উভয় তরফের দরকার।

প্রতীকুর রহমান
(রাজ্য সভাপতি, এসএফআই)

ভারতে সংখ্যালঘুরা কেমন আছে? ভালা থাকার বিষয়টা তো আপেক্ষিক! বলা যায়, নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ বাংলাদেশে হিন্দুদের অবস্থানের তুলনা টানছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ইসলামিক রাষ্ট্র হয়েছে। আর ভারত বরাবর ধর্মনিরপেক্ষ। দুই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের অবস্থার তাই তুলনা করা যায় না। আসলে ভারত বা বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বে গরীব মানুষ ভালো নেই, আর এই কথা যাতে সামনে না আসে তার জন্য হিন্দু, মুসলমান, সংখ্যা গুরু, সংখ্যালঘুতে ভাগ করা।
*

মহম্মদ আলি জিন্না
(সর্বভারতীয় সম্পাদক, রাষ্ট্রীয় লোক জনশক্তি পার্টি)

নিরাপত্তাহীনতার চেয়েও ভারতে সংখ্যালঘুদের বড় সমস্যা অজ্ঞানতা। তাদের জন্য কত রকম প্রকল্প আছে। কিন্তু না জানার জন্য সেগুলোর সুফল তারা ঠিকমত পায় না। ভারতে মুস্লিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে হার, সেটাও সুখকর নয়। এটা বেশি হচ্ছে দরিদ্রতরদের মধ্যে। এটা নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার।
*

আব্দুল মান্নান
(প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা)

আমার চোদ্দ পুরুষের জন্ম এদেশে। ছেলেবেলা থেকে আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি বড় হয়েছি। জনগণের কাছে মুস্লিমরা নিরাপদ। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে কিছু ধর্মান্ধ এই সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যে চিড় ধরানোর চেষ্টা করছে। অধিকার থেকে বঞ্ছিত করার চেষ্টা করছে। চেষ্টা হচ্ছে ভারতের সংস্কৃতি নষ্ট করার।

প্রভাবশালী মুস্লিমদের নানা দাবির পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে ২০০১ থেকে ২০১১— এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ও মুস্লিমদের প্রবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১০.৮১% ও ২১.৮১%। ‘সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ‘-এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ১৯৫১ থেকে ২০১১—ছয় দশকে এ রাজ্যে হিন্দুদের তুলনায় মুস্লিমদের জনস্ফিতীর হার অনেক বেশি, পুঞ্জীভূত প্রবৃদ্ধির ব্যবধান হয়েছে ১০১.৮%।

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.