#চতুর্থার্ধ : #কৃষ্ণনগর_পোস্টাল_ডিপার্টমেন্ট_অর্থ_লুন্ঠন
বিপ্লবী অনন্তহরি মিত্র নদীয়ার বেগমপুর গ্রামের ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামলাল মিত্র। বিপ্লবী অনন্তহরি মিত্র ১৯২১ সালে প্রথম অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পাওয়ার পরও তিনি বিপ্লবের কাজে লেগে রইলেন । তবে তার অহিংস থেকে সহিংস.. নীতির পরিবর্তন ঘটল ।কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলনের পথ ছেড়ে #অগ্নিপথ না গ্রহণ করলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্ভব নয় ।তিনি কৃষ্ণনগর থেকে এসে যোগ দিলেন কলকাতার #রেড_বেঙ্গল_পার্টিতে। তখন বাংলার বিভিন্ন জেলায় সংগঠন গড়ার ডাক দিয়েছে রেড বেঙ্গল পার্টি। অনন্ত দায়িত্ব নিলেন কৃষ্ণনগরের, সেখানে গড়ে তুলেছিলেন সংগঠন।
অনন্তহরি মিত্রে উপরই পুনশ্চ ডাকাতির দায়িত্ব প্রদান করা হলো । নিখুঁত পরিকল্পনা এবং সতর্কতায় ঠিক সিনেমা চিত্রের মনেই ডাকাতি হয়েছিল এবং পাওয়া গিয়েছিল মোটা টাকা …..পূর্বেই বলেছি বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি টাকা এবং তারা কোন ভাবে সাধারন মানুষের সম্পত্তির উপর ডাকাতি করতে চাননি ,কারণ তাতে দেশের মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাত। একজন বিপ্লবী পরামর্শ দিলেন , #পোস্টাল_ডিপার্টমেন্ট এর টাকা লুট করার জন্য । অনন্তহরি মিত্র রাজি হলেন সেই প্রস্তাবে।
কৃষ্ণনগরে তখন হেড পোস্ট অফিস । বিভিন্ন সাব পোস্ট অফিস থেকে দিনের কাজের শেষে সেখানে টাকা আসত এবং জমা রাখা হতো ।নবদ্বীপ সাব পোস্ট অফিস থেকেও প্রতিদিন কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিসে টাকা আসত। সুতরাং সেই টাকা লুুুঠ করা সবথেকে সহজ ছিল ।
নবদ্বীপ শহর ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে । গঙ্গার পূর্ব পাড়ে, গঙ্গা হতে আটমাইল ভিতর কৃষ্ণনগর শহর। নদী পার হয়ে এসে এপাড়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে কৃষ্ণনগর পোস্ট অফিসে টাকা রাখতে যাওয়া হত। যে পথ দিয়ের যাওয়া হত সে পথ ছিল একেবারেই নির্জন, আমবাগান আর কৃষি ক্ষেত রাস্তার দু’পাশে …..মাঝে মাঝে দু একটা কাঁচা বাড়ি। রাস্তার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে #মার্টিন_কোম্পানির ছোট ট্রেন।তাও সংখ্যায় খুব কম ।সেই ট্রেন চড়ার জন্য কেউ প্রায় টিকিটই কাটত না আর ট্রেনের গতি ছিল ভীষণ কম। অনেকেই চলন্ত ট্রেন থেকে ইচ্ছা করলে ওঠানামা করতে পারতেন ।
এই আটমাইল রাস্তার মাঝে #শিমুলতলা বলে একটি জায়গা ছিল। সেটি ছিল আরো নির্জন। ব্লুপ্রিন্টে নির্ণয় হল যে, সেখানে ডাকাতি করা হবে। ডাকাতির স্পট ঠিক হওয়ার পর টিম তৈরি করা হলো। নেয়া হলে পোড় খাওয়া বাছা বাছা ছেলেদের । তাঁদের বলা হল এই কাজে বিপদ অনেক, ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, ধরা পড়লে জেল হতে পারে, ফাঁসি ও হতে পারে ।কিন্তু দেশমাতৃকার কাজে যারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন তাঁদের কি মৃত্যু, কি অত্যাচারের ভয়? মায়ের জন্য সব কিছু করতে রাজি তাঁরা।
অনন্তহরি মিত্র একদিন সমস্ত রাস্তা ঘুরে দেখে এলেন। পরে ঠিক করে দিলেন ডাকাতি কিভাবে হবে… নির্দিষ্ট দিনে বিপ্লবীরা তাঁদের নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করতে লাগলেন। শিমুলতলার আশেপাশের সবাই গাছের আড়াল থেকে তাকিয়ে ছিলেন রাস্তার দিকে । কখন ডাক বিভাগের ঘোড়ার গাড়ি যায়…. কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল নবদ্বীপ ঘাট থেকে ঘোড়ার গাড়ি এগিয়ে আসছে । তৈরি হয়ে গেলেন বিপ্লবীরা। কাছে আসতেই তারাদাস মুখার্জি গাড়োয়ানকে গাড়ি থামানোর জন্য হাঁক পাড়লেন । গাড়োয়ান কোন উত্তর দিল না। তারাদাস মুখার্জি বারবার গাড়ি থামানোর জন্য হাঁক দিতে লাগলেন এবং গাড়োয়ান তাতে কোন গ্রাহ্য করল না বরং সে আরো জোরে গাড়ি ছোটালো …..কিন্তু গাড়ি তো রুখে দিতেই হবে…সিন্দুক টা চাই। গরিব দেশওয়ালী গাড়োয়ানকে মারা কোনো ইচ্ছা নেই বিপ্লবীদের….
বাধ্য হয়ে তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় গাড়োয়ানের পা লক্ষ্য করে শুট করল….ফলে গাড়োয়ান গাড়ি থামাতে বাধ্য হল । বিপ্লবীরা আর সময় নষ্ট না করে গাড়ি থেকে টাকার সিন্দুক নিয়ে সরে পড়লেন নির্বিঘ্নে । এমন একটা দেশের কাজ তাঁরা করলেন প্রায় বিনা বাধায় ?কেউ নেই? যেমন চেয়ে ছিলেন তেমন স্মুথলি কাজটা হয়ে গেল? বিপ্লবীরা ভীষণ খুশি হলেন। এরমই চেয়েছিলেন তাদের নেতা অনন্তহরি মিত্র।
কিন্তু এত সোজা ব্যাপারটা নয়। একটু দূরে গাছের আড়াল থেকে পুরো ঘটনাটা লক্ষ্য করে ছিল বসন্ত চৌধুরী নামে স্থানীয় এক লোক ।সে অবশ্য ভেবেছিল যে এটা সাধারন ডাকাতদের কাজ। তাঁর মোটা গ্রাম্য বুদ্ধিতে সেদিন এটুকু মনে হয়নি যে সাধারণ ডাকাত আর এই ডাকাতদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। …অবিশ্যি মুখে গামছা বাঁধা ব্যক্তি গুলি চালায়… বড় মাপের ডাকাত হবে…তাই সে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ঘোড়ার গাড়ির চালক কে নিয়ে থানায় গিয়ে বড়বাবুকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে জানায়। চালকও ঘটনার বিবরণ দেয়। তাদের কথা শুনে থানার বড়বাবু এদিকে কি বুঝেছিলেন কে জানে? উল্টে দুজনকে চালান করে দিলেন কোর্টে। দুবার বার কোর্টের তারিখ পড়ল। কিন্তু তারা বেকসুর খালাস পেয়ে গেল । কারন ততদিনে খোঁজ নিয়ে পুলিশ জানতে পেরেছে এটা কোন সাধারন ডাকাতি নয়। সরকারি অর্থ ডাকাতি করা হয়েছে স্বদেশীর কাজের জন্য…..
ঘটনার কথা কৃষ্ণনগরের আই. বি ডিপার্টমেন্টে পৌঁছতে তারা খবর খোঁজ করতে শুরু করলো। পুলিশের খাতায় যেসব বিপ্লবীদের নামের তালিকা রয়েছে তা দেখে তাদের মনে হল এটা অনন্তহরির কাজ ।কারণ অনন্তহরি মিত্র এরআগে স্বদেশী করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন ।সুতরাং প্রথমেই খোঁজ শুরু করা হলো অনন্তহরি মিত্রের।
এদিকে কৃষ্ণনগরের পোস্টাল অর্থ লুঠের পর সেই অর্থ নিয়ে অনন্ত কলকাতায় চলে এলেন। যে জন্য পুলিশ সারা কৃষ্ণনগর , নবদ্বীপ খুঁজেও অনন্তের কোনো সন্ধান পায়নি। তাঁর গ্রামের বাড়ি বেগমপুর এ গিয়েও তাকে ধরতে পারেনি। অনন্তহরি মিত্র তখন দক্ষিণেশ্বরে বাচস্পতি পাড়ার বোমা তৈরীর কারখানায়। পুলিশ অবশ্য খোঁজ নিয়ে ক’দিন পরেই জানতে পারল অনন্তহরি কৃষ্ণনগর ছেড়ে কলকাতায় চলে গেছে । কলকাতায় কোথায় গেছে? তখনও পুলিশ জানতেই পারেনি …..
জেল থেকে এবার তদন্তের দায়িত্বভার চলে এলো কলকাতা পুলিশের হাতে। কলকাতা শহর কি এইটুকু নাকি? একজন অনন্তহরিকে কোথায় খুঁজবে পুলিশ ? তবে পুলিশ দক্ষিণ কলকাতাকে প্রাথমিক তদন্তে তেমন গুরুত্ব দিলো না ….কারণ পুলিশ রেকর্ড থেকে জানতে পারা গিয়েছিল ১৯০২ সালে বাংলার বিপ্লবের যত কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে তা #উত্তর_কলকাতা থেকে সম্পন্ন হয়েছে । #অনুশীলন_সমিতির অফিস, #মুরারি_পুকুর বাগানবাড়ি , #যুগান্তর, #ধর্ম, #বন্দেমাতরম_পত্রিকার অফিস , #গ্রে_স্ট্রিট থেকে #অরবিন্দকে গ্রেফতার করা, #প্রফুল্ল_চাকী কে ধরিয়ে দেওয়া পুলিশ অফিসার #নন্দলাল_ব্যানার্জিকে হত্যা , #রডা_কোম্পানির_মাউজার_পিস্তল লুঠ,সেই মাল লুকিয়ে রাখা …..সমস্ত ঘটনা ঘটেছে #উত্তর_কলকাতা কে কেন্দ্র করে।
সুতরাং পুলিশের ধারণা হলো অনন্তহরি মিত্র কলকাতা এসে থাকলে নিশ্চয়ই উত্তর কলকাতার কোন স্থানে গা ঢাকা দিয়ে আছে। উত্তর কলকাতা বাড়ানো হলো পুলিশি নজরদারি। এর মধ্যে একদিন পুলিশ #হেদোয় কয়েকজন ছোট মাপের বিপ্লবীদের একত্রিত হতে দেখেছে। পুলিশ তাঁদের ঘাটায় নি কারন তাহলে খবর জেনে আসল লোক অন্যত্র পালাবে । কলকাতা পুলিশের প্রধান অসুবিধা হলো তারা অনন্ত কেমন দেখতে জানত না…..কলকাতা পুলিশের খাতায় তাঁর কোনো ছবি নেই। কৃষ্ণনগর থেকে কয়েকজন পুলিশকে আনা হল অনন্তকে যাঁরা চিনত… তাদের ছড়িয়ে দেওয়া হলো কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে।
স্বাভাবিকভাবে উত্তর কলকাতাতে বেশি সংখ্যক পুলিশ ছাড়া হল। চিৎপুর , শোভাবাজার অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হল নীলকান্ত রায় নামে এক সিআইডি অফিসারকে ।
তারপর ?
ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা ২. ভারতের সশস্ত্র বিপ্লব ৩. দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলা থেকে কাকোরি ট্রেন ডাকাতি