#দ্বিতীয়াংশ
শ্রী শ্রী চন্ডীতে রাজা সুরথমেধা ঋষির নিকট মহামায়া তত্ত্বব্যাখ্যা জানতে চাইলে সমগ্র চণ্ডীপুস্তকটির কাহিনির অবতারণা করা হয়। এই গ্রন্থে মোট আটবার মহামায়ার উল্লেখ করা হয়েছে।
ত্বয়ৈব ধার্য্যতে সৰ্ব্বং ত্বয়ৈতৎ স্বজাতে জগৎ । ত্বয়ৈতং পালাতে দেবি ত্বমৎস্তম্ভেচ সৰ্ব্বদা ॥বিস্তষ্ট্রে স্বষ্টিরূপ ত্বং স্থিতিরূপাচ পালনে । তথা সংহতিরূপাহন্তে জগতোহস্য জগন্ময়ে|।মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ । মহামোহাচ ভবতী মহাদেবী মহাস্থরী ॥ প্রকৃতিস্তৃঞ্চ সৰ্ব্বস্য গুণত্রয়বিভাবিনী ।
মহামায়া ত্রিকালাবাধিতসত্তারূপিণী ব্রহ্মময়ী। তিনি নিত্যা, তিনি নিরাকারা আবার সাকারাও বটে। তবে বেদান্তের ব্রহ্ম এবং তন্ত্রের মহামায়া স্বরূপত অভিন্ন। রামপ্রসাদের একটি গানে আছে—‘‘কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি।’’
আদ্যাশক্তি মহামায়া স্বরূপত নিত্যা, নির্গুণা এবং নিরাকারা হলেও দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য কখনো কখনো তাঁকে সগুণা সাকারা হয়ে জগতে আবির্ভূতা হতে হয়। দেবী ভাগবতে এর একটি সুন্দর উপমা আছে। সেখানে বলা হয়েছে—অভিনেতা একই ব্যক্তি হলেও লোকরঞ্জনের নিমিত্ত তাকে যেমন রঙ্গস্থলে নানা বেশে, নানা চরিত্রের অভিনয় করতে হয়, সেরূপ দেবী মহামায়া নির্গুণা নিরাকারা হলেও দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য স্বীয় লীলায় তাঁকে নানাবিধ রূপ ধারণ করতে হয়।
মোট তেরোটি অধ্যায়ে বিভক্ত চণ্ডীগ্রন্থের প্রধান বর্ণিত বিষয় দুটি: রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও দেবীস্তুতি। গ্রন্থের সিংহভাগ জুড়ে আছে দেবীর যুদ্ধলীলা। এই অংশে ফুটে উঠেছে তাঁর অসুরদলনী রূপ। পূর্ব-অধ্যায়ে অসুরবধপ্রসঙ্গে তাঁর যুদ্ধোন্মাদনার আভাস আমরা পেয়েছি। এবারে আমরা পরিচয় পাব স্তবের মাধ্যমে উদ্ঘাটিত মহামায়ার সামগ্রিক সত্তার। গ্রন্থের সূচনাপর্বেই আছে ব্রহ্মার স্তব। সেখানে মহামায়ার তামসী প্রকাশ; তিনি যোগনিদ্রাস্বরূপা মহাকালী।
পদ্মাসীন ব্রহ্মা প্রথম শ্লোকেই দেবীর স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে বললেন: তুমি নিত্যা, তুমি অক্ষরা। মহামায়া অবিনাশী। যদিও পাষণ্ড-দলন ও জগদুদ্ধারলীলায় তিনি একটি বিশেষ রূপে আত্মপ্রকাশ করেন, কিন্তু তাঁর সেই রূপ অপ্রাকৃত। রূপধারণ করলেও তিনি মূলত অরূপ। তাই দেশ-কাল-বস্তুগত কোনও পরিচ্ছেদ বা সীমা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে—তাঁর নিত্যত্ব কি পরিণামী নিত্যত্ব অর্থাৎ স্বভাবে পরিণামী হয়েও কি তিনি নিত্যা; যেমন, প্রকৃতি জগতের পরিণামী কারণ হওয়া সত্ত্বেও নিত্যা বা চির বর্তমান? মহামায়ার নিত্যত্ব যে সেরকম নয়, এই বিষয়টিই বোঝাতে গিয়ে বললেন—অক্ষর। কোন রকম ক্ষরণ অর্থাৎ পরিবর্তন বা বিনাশ তাঁর নেই। চারটি স্তবেই দেবীর কূটস্থ নিত্যতা উপস্থাপিত হয়েছে ব্যতিক্রমহীনভাবে।
দেবী মহামায়া পরব্রহ্মস্বরূপিণী হলেও চণ্ডীগ্রন্থে মহাশক্তি রূপেই তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি চৈতন্যময়ী চিতিশক্তি ও স্বাধীন। চিতিরূপে তিনি সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত। চিতিশক্তির বিকাশে জগতের উন্মেষ ও স্থিতি; চিতির সংকোচেই জগতের বিলয়।
ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণেও সহজভাবে এ কথা বলে দিয়েছেন
‘যোগেশাত্মা স্মৃষ্টিবিধৌ দ্বিধারূপো বভূব সঃ’।
আর সেই পরমা প্রকৃতি মহামায়ার পরিচয়েও বলেছেন “সা চ ব্রহ্মস্বরূপা চ মায়া নিত্যা সনাতনী। “অর্থাৎ তিনি হলেন ব্রহ্মরূপিণী সনাতনী….
হ্যাঁ , এই ব্রহ্মরূপীনি মহামায়া সনাতনী দেবীই মাঘী পূর্ণিমায় মহামাঞ নামে পূজিতা হন রঘুনাথপুর ২ নম্বর ব্লকের চেলিয়ামার অন্তর্গত চাতরমহুল মৌজাতে। পূর্বের পর্বেই আমি বলেছি যে মাঘ মাসের পূর্ণিমায় দেবীর পূজা এই স্থানে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাধান্য প্রদান মাধ্যমে তা পালন করা হয়। এই পূজাকে সুচারু রূপে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রায় ১৫ দিন আগে থেকে তার প্রচেষ্টা চলে। মহামায়া প্রাঙ্গনটির ঘাস , আগাছা প্রভৃতি সমস্ত পরিষ্কার করে গোবর দিয়ে স্থানটি শুদ্ধ ও পরিষ্কার করা হয়।মায়ের ক্ষুদ্র মন্দিরটিও ধুয়ে মুছে ,চুনকাম করে ও রং দিয়ে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়। অবশ্য মন্দিরের মধ্যে মহামাঞ দেবীর কোনো মূর্তি বা প্রতীক নেই। কোনো দিনই ছিল না। কারন তিনি পরম ব্রহ্ম স্বরূপ। ঘটে পূজা করুন বা পটে বা মূর্তিতে তিনি ভক্তের বিশ্বাসে সারা দেন।
প্রয়োজন মত গাই গরুর দুধ, গাওয়া ঘি, হাঁড়ি কলসী, খাপরি, ধূপাসি, শুষ্ক কাষ্ঠ, পেরেক দেওয়া কাঠের আসনের জন্য কামারকে বলে রাখা , ইত্যাদি দ্রব্যকে যথাসময়ে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সমষ্টিগতভাবে পূজা কমিটির হাতে দেওয়া হয়। পূজার তিন দিন আগে থেকে ধুমূল দিয়ে অর্থাৎ প্রতি টি সন্ধ্যায় ঢাক বাজিয়ে ,প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে মাকে আবাহন করা হয়। এই বাজনদারের ব্যবস্থাও করেন পূজা কমিটির হাতেই ন্যস্ত থাকে।
মহামাঞ পূজা ও উৎসবটি প্রতি বছর ১ লা মাঘই হয়ে থাকে। কিন্তু প্রতি ছয় বছর অন্তর ২ রা মাঘ অনুষ্ঠিত হয়। কারন এই গ্রামেরই রাজোয়াড় পরিবারদের মধ্যেএকটি ধর্ম বা সূর্য পূজা প্রতি ছয় বছরের মাথায় ওই তারিখেই গাঁয়ের বাইরে ধর্ম আখড়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং ঐ পূজার প্রসাদ মাংস – ভাত খাওয়ার জন্য তাদের নিজেদের আত্মীয় – কুটুম্ব , বন্ধু , ফুল পরাণ, সহ গ্রামের প্রতিটি পরিবারের নিমন্ত্রণ থাকে। কাজেই ভোর থেকেই সেদিন গ্রামে ঐ আখড়ায় মেলার একটি বাতাবরণ তৈরি হয়। এই কারনেই ওই বছর গুলিতে ১ লা মাঘের বদলে ২ রা মাঘ মহামাঞ পূজা ও অন্যান্য গ্রাম্য দেবতার স্থানে পূজা হয়।
মহামাঞ পূজার দিনের ভোরবেলা থেকেই গ্রামের ছেলে মেয়ে , যুবক যুবতীর অনেকেই পুকুরে স্নান সেরে শুদ্ধ ভাবে ভিজে কাপড়ে দন্ডি দিতে দিতে মায়ের থান অবধি যান। এটি প্রায় দুপুর পর্যন্ত চলে এবং চাতরমহুল ও তার পাশ্ববর্তী এলাকার শত শত মানুষ জন এতে অংশ গ্রহন করেন।
আষাঢ়ী পূজার মতই লায়াগন যথারীতি নিয়ম পালন করে কয়েকজন গরাম থানে এবং কয়েকজন মহামাঞ থানে উপস্থিত হন সমস্ত উপকরণাদি সহ। মহামাঞ থানে লায়া বাড়ির এক মহিলা পূর্ববর্ণিত চালের গুড়া দুধে গুলে পিঠে তৈরি করে সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলে এবং গরাম থানেও আষাঢ়ী পূজার ন্যায় দুধে আতপ চাল সিদ্ধ করে জুড়ি তৈরি করা হয় । ইতিমধ্যে পাতার খোলায় পাঁচটি পিঠে নিয়ে লায়া মহামাঞ থান থেকে গরাম থানে যান এবং গরাম থান থেকে এক পাতার খোলায় ওখানকার সিদ্ধ করার কিছু জুড়ির অংশ নিয়ে মহামাঞ থানে ফিরে আসেন।
গরাম থানের লায়ারা মহামাঞ থান থেকে আসা পিঠে এবং অন্যান্য উপকরণাদি দ্বারা আষাঢ়ী পূজার মতোই যথানিয়মে পূজা এবং ছাগল বলি ও মোরগ উৎসর্গ করে পূজাকে সম্পন্ন করেন। এবারে কিন্তু শূকর বলি হয়না । গরাম থানে পূজা শেষ করে তাঁরা আষাঢ়ী পূজার মতই যথাক্রমে গোঁসাই ঠাকুর , ঢাঙ্গামহুল ও ডুংরি থানে পূজা ও মোরগ উৎসর্গ করেন।
গ্রামে প্রায় প্রতি পরিবার থেকেই এই পূজায় পোড়ামাটির তৈরি বিভিন্ন আকারের ঘোড়ার সাথে সামর্থ্য অনুযায়ী দুধ, বাতাসা, আতপ চাল , ফলমূল মিষ্টি ইত্যাদি উপকরণ মহামাঞ থান ও গরাম থানে প্রেরণ করতে দেখা যায় । গরাম থান থেকে আসা জুড়ি পেয়েই মহামাঞ থানের পূজারী বা লায়া ঐ জুড়ির সাথে পিঠে , মিঠাই , বাতাসা, আতপ চাল ,নানাবিধ ফলমূল প্রভৃতি উপকরণ এবং জল পুষ্প সহযোগে মায়ের পূজা সম্পন্ন করেন। এরপর ওই প্রাঙ্গণে আরো ছয় থেকে সাত স্থানে ওইভাবে পূজা করে থাকেন।
এদিকে মেলাতেও ধীরে ধীরে ভিড় জমতে থাকে। বহু দর্শনার্থী ধুপ, দীপ, ফল ,বাতাসা, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে মাকে প্রণামের জন্য মন্দিরে ভিড় করে । এই অবসরে গ্রামে তিন-চারজন গ্রাম্য অধিবাসী স্নান করে নতুন কাপড় পরে কেউ টলমল পায় ,কেউবা ধীরে ধীরে চুপে চুপে মায়ের কাছে এসে বসে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস এদের উপর সেদিন দেবী ভর করেন। ওই সময় মেলার ব্যবস্থা কারীরা ধুপাসি বা ধুনুচি তে ধুনো আগুনের ধোঁয়া বাতাস করতে করতে ওসব ঝুপানদারদের সামনে রাখেন।বাজনদারও ঢাক, ঢোলের শব্দে মন্দির প্রাঙ্গন মুখরিত করে উৎসাহ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে থাকেন। এইসময় ঝুপানদার রা মহামাঞ স্থানে নানা কৃচ্ছ সাধনাদি , অঙ্গভঙ্গি, নানা ঝুপান প্রদর্শন করেন। প্রায় ঘণ্টা তিনেক এসবেই দর্শকগন মোহিত থাকেন। ঝুপানান্তে ঝুপানদার গন মায়ের মন্দিরের সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণামের ন্যায় শুয়ে পড়েন….ঝুপান শেষ হয়েও হয় না শেষ…..
এই দিন মায়ের কাছে সমষ্টিগত ভাবে গ্রামের শুভকামনায় লায়া ফুল চাপায়- বেলপাতা ধুয়ে একের উপর এক পর পর রেখে ,তার উপরে আতপ চাল রেখে আস্তে আস্তে সেটিকে পিরামিডের আকার দান করেন। তার শীর্ষে একটি সুপারি ও ফুল রাখেন এবং দুই হাতে অঞ্জলি করে একাগ্র মনে মায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে থাকেন। ওই ফুল পড়লে বিশ্বাস করেন যে মা আশীর্বাদ করেছেন । একেই ফুল চাপা বা ফুল পড়া বলে। প্রসঙ্গত বলে রাখি মহানির্বান তন্ত্রানুসারে পিরামিড হল শিবের প্রতীক। এছাড়াও পিরামিড কে তন্ত্রের যন্ত্র হিসাবে পূজা করা হয়।
আচারে-অনুষ্ঠানে, আয়োজনে, অংশগ্রহণে, আকারে-আঙ্গিকে, আনন্দ-উৎসবে নানা রূপে শক্তি পূজা আজ ব্যক্তি ও পরিবারের সংকীর্ণ গন্ডী পেরিয়ে পেয়েছে সার্বজনীনরূপ। মায়ের আগমনী ছন্দে ছন্দায়িত হয় ভক্তজনের তনুমন। মঙ্গলালোকে উচ্ছ্বসিত, সমুদ্ভাসিত ও উদ্বেলিত হয় শরণাগতের অন্তরাকাশ। মায়ের পূজা মূলতঃ শক্তিপূজা। শুভশক্তি আবাহনার্থেই মায়ের পূজানুষ্ঠান।
নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা আর শক্তি পূজার মধ্যে নেই কোন প্রভেদ। কারণ ‘এক ও অদ্বিতীয় নিরতিশয় চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম অনাদিসিদ্ধ মায়ার আবরণে ধর্ম ও ধর্মীরূপে প্রতিভাসিত হন।’
অগ্নি ও তার উত্তাপকে যেমন পৃথক করা যায় না, ধর্ম ও ধর্মীকে যেমন স্বতন্ত্র ভাবা যায় না, তেমনি ব্রহ্ম আর শক্তিও অভিন্ন।
দেবী ভগবতে আছে-
“সদৈকত্বং ন ভেদোহস্তি সর্বদৈব মমাস্য চ।
যোহসৌ সাহম্ অহং যাসৌ ভেদোহস্তি মতিবিভ্রমাৎ”
অর্থাৎ “আমি ও ব্রহ্ম এক। উভয়ের মধ্যে ভেদ নেই। যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি। আমি যাহা, তিনিও তাহাই। এই ভেদ ভ্রমকল্পিত, বাস্তব নহে।” ‘আমি’-ই দুর্গা বা শক্তি। সচ্চিদানন্দরূপিণী মহামায়া পরাশক্তি অরূপা হয়েও ভক্তপ্রাণের পরিত্রাণ রূপে ধরা দেন। যিনি সর্বশক্তিমান সব কিছুই তাঁর ইচ্ছাধীন, সব কিছুই তাঁর আয়ত্তাধীন। তাই তিনি নিরাকার পরব্রহ্ম হয়েও স্বেচ্ছায় সাকারে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন।
মায়ের পূজা ভাবের পূজা। আমরা আগেই বলেছি আতিশয্য পূজার অত্যাবশ্যকীয় কোন অঙ্গ নয়। ভক্ত হৃদয়ের ভাবের উদ্বোধনে মোক্ষ লাভ করবে, অন্তরাত্মায় জানবে পরমব্রহ্মময়ী রূপকে।তাই শাক্ত মতে বা তন্ত্রমতে যে পূজা পদ্ধতি সেখানে যন্ত্রের ব্যবহার ই শেষকথা।
যন্ত্রের উপর পূর্ন ঘট স্থাপনা করা তাই পূর্ণতার প্রতীক। যে কোন পূজার সময় ঘট স্থাপন করতে হয়। ঘট কোন দেবী বা দেবতার প্রতিমা নয়। ঘট ভগবানের নিরাকার অবস্থার প্রতীক। হিন্দুরা পূজার সময় যেমন ভগবানের সাকার স্বরূপ কে পূজা করে তেমনি নিরাকার স্বরূপকেও পূজা করেন। তাই ঘট স্থাপন প্রতি পূজাতে একান্ত আবশ্যক। ঘট স্থাপন ছাড়া পূজা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। প্রায় সব পূজায় ঘট লাগে। ঘটের মধ্যে অনেক উপাদান ব্যবহার হয়। যেমন- পঞ্চশস্য, পঞ্ছগুড়ি,পঞ্চপল্লব,পঞ্চরত্ন, জল,মাটি,নারিকেল,গামছা,কান্ডকাঠি ইত্যাদি।
মহামাঞ বা নানা গ্রাম দেব দেবীর পুজোতে কোন শোনা সাধারণত শোনা যায় না অথবা ব্যবহার করা হয় না। যাহোক , এরপর ব্যষ্টিগত ভাবে ফুল চাপান হয় কেউ সন্তান কামনায়, কেউ পরিবারের শান্তি কামনায় বা মনস্কামনা পূরণের নিমিত্ত….. এই অবসরে আরেকটি প্রথা চলতে দেখা যায় , যে সমস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ঝুপান হয় তাঁদের অধিকতর পুরাতনের হাতে মন্দিরের কিছু আতপ চাল দেওয়া হলে তিনি নিকটের বেদীতে রক্ষিত পেরেক সহ কাষ্ঠাসনে গিয়ে বসেন। তখন পূজার পরিচালকমণ্ডলীর তাঁর কাছে গ্রামের শুভাশুভ সম্বন্ধে কিছু জানতে চাইলে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেযন এবং তাদের কিছু উপদেশ প্রদান করেন। এইভাবে ব্যক্তিগতভাবে কারো কিছু জানার থাকলে তিনিও জিজ্ঞাসা করে থাকেন। এসব শেষ হলেই শুরু হয় উৎসর্গ। প্রতিবছর প্রায় ১৫ থেকে ১৬ টি পাঁঠা ও ভেড়াকে উৎসর্গ করা হয়। এরপরে উপস্থিত জনদের মধ্যে যথারীতি ফল, মিষ্টি,পিঠে ইত্যাদি মহামায়ের প্রসাদ বিতরণ করা হয় ।
মহামাঞ পূজার রীতিনীতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি পর্যালোচনা করে অনেকেই ধারণা করেন এক একটি সুপ্রাচীন তান্ত্রিক ধারণা। অনেকে ধারণা করেন এটি একটি তান্ত্রিক সাধনার বিবর্তিত রূপ। এইযে পিরামিড তৈরি করা হয় কিন্তু সেই পিরামিডের বিশেষ উল্লেখ রয়েছে মহানির্বান তন্ত্রে। সেখানে পিরামিড শিব , সেখানে পিরামিড হল যন্ত্র। এখানে আমি বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেবো না …. পরে কোনো দিন আলোচনা করব।
এই অঞ্চলে বহু জনগোষ্ঠী মহামায়া বা মহামাঞের উপাসক। বলতে পারেন এখানে মহামায়া কাল্ট চলে। রাঢ়বঙ্গ সুপ্রাচীন তান্ত্রিক সাধনার পীঠস্থান…. মহামায়ার হলেন আদি শক্তি । তিনিই আদিম। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা হোক বা বৈদিক যুগ অথবা সুমেরিয়ান সভ্যতা অথবা আসিরীয় সভ্যতা, বা প্রাচীন চৈনিক সভ্যতা এ সকলের ধর্ম ও দর্শন চিন্তার সঙ্গে বিশেষ করে সম্পর্কিত হলেন সেই আদি শক্তি। সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার কথা কেবল কেন বলি…. তারও আগে যখন মানুষ যখন গুহায় বাস করত ,যখন সে প্রকৃতির শক্তির ব্যাপকতাকে উপলব্ধি করতে শিখল , ঠিক তখন থেকেই সে কিন্তু শক্তিকেও সাধনা করতে শুরু করেছিল । সেখান থেকেই কিন্তু প্রাচীনতম ধর্ম বা তন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে সে কথা আগেই বলেছি । হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় ধ্বংসস্তূপে অসংখ্য মৃন্ময়ী দেবীর মূর্তি পাওয়া যায় দেবী ছিলেন হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতা ও শহরের কুলদেবী ও প্রধান দেবতা ছিলেন পশুপতি।
সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম দর্শন চিন্তার সাথে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় আবিষ্কৃত চর্যাপদ এর দেহতত্ত্ববাদ ও সহজিয়া সাধনার প্রচ্ছন্ন ধারাবাহিকতাও লক্ষ্য করা যায়। শাস্ত্রী মহাশয় চর্যাপদের কুক্কুরীপাদ কে মহামায়ার উপাসক বলে স্বীকার করেছেন । সিন্ধু সভ্যতার শক্তি-সাধনা, পশুপতি লিঙ্গ-পুজা ও প্রাচীন তন্ত্র মতবাদের ক্রমবির্বতনের রূপই যে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীদের মহামাঞ উপাসনা এবং চর্যাপদের দেহতত্ত্ববাদ বা সহজিয়া সাধনার ধারণাটি অনুমান করা অধিক কষ্টের নয়।
কূর্মপুরাণে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে যে , ভিতরের ধ্যান সাধকের সামর্থ অনুসারে চিত্তবৃত্তির নিরোধের ফলে আপনি ফুটে ওঠে । এই উদ্বোধনের প্রকৃষ্ট সময় হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিলেন শরৎকাল অর্থাৎ দক্ষিণায়নের সময়কে। এই হচ্ছে দেবনিদ্রার কাল।তাই এই সময় কুলকুন্ডলিনীও থাকেন নিদ্রিতা । তাঁকে জাগানোই, তাঁকে জাগিয়ে অন্তত রহস্যময় এই পৃথিবী, প্রকৃতি ও সুবিশাল ব্রম্ভান্ডকে আবিষ্কার করে পরম মোক্ষকে লাভ করাই এই সাধনার উদ্দেশ্য। যা আছে দেহভান্ডে তাই আছে ব্রম্ভান্ডে । দেহস্থ কুলকুন্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে ব্রম্ভাণ্ডব্যাপিনী কুলকুন্ডলিনী শক্তির সঙ্গে মেলাতে পারলে তবেই সিদ্ধিলাভ সম্ভব।
কিন্তু তন্ত্রমতে দেহভান্ড ই ব্রম্ভান্ডের স্বাদ দেয়। সেখানেই সন্ধানের আকাঙ্খা করতে হয়। নিজের দেশ , নিজের অঞ্চল ,নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিকে না জানলে বিশ্বকে কি করে জানবে মানুষ? এখনো চর্যাপদের কবিদের কথামত উচ্চবিত্তের প্রতি নিম্নবিত্তের সচেতন দূরত্ব বা অবজ্ঞা…..
ডক্টর অতুল সুর মহাশয় “বাংলা ও বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি” গ্রন্থে বলেছেন তন্ত্র ঠিক কত সুপ্রাচীন সে কথা বলেছেন । অতি প্রাচীন তন্ত্রের আচার-অনুষ্ঠান পদ্ধতি অত্যন্ত দৃঢ় ও গূঢ় সাধন পদ্ধতি।এই পদ্ধতি সাধারণ জন মানুষ থেকে শুরু করে সব সকল শবর , দ্রাবিড়, কলিঙ্গ এবং গৌড় দেশবাসীর ও গন্ধর্বদের মধ্যে প্রচলিত ছিল । শৈব উপাসনা পদ্ধতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে কাপালিক সম্প্রদায় অংশের কথা আমরা জানতে পারি । শিবকে অনেকেই কাপালিক বলে চিহ্নিত করে থাকেন। আবার প্রাচীন ভারতের দেহ সম্পর্কিত শাস্ত্রের নামও কাপালিক। তন্ত্রশাস্ত্রর প্রতিপাদ্য বিষয় মহামায়া তত্ত্ব। তন্ত্রশাস্ত্রের সারস্বরূপা চন্ডীর প্রতিপাদ্য বিষয়ও মহামায়াই।
অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসুনাম চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্য্যাবেশয়ন্তীম্।
অর্থাৎ, আমি জগতের ঈশ্বরী, ধনপ্রদায়িনী। ব্রহ্মকে জ্ঞাতা আমার আমিই যাঁদের জন্য যজ্ঞ করা হয় তাদের মধ্যে প্রথমা। বহুরূপে সর্বভূতে প্রবিষ্টা সেই আমাকে বহুস্থানে বা সর্বদেশে আরাধনা করা হয়।
মহামায়া শব্দ চন্ডীতে আটবার ব্যবহৃত হয়েছে সে কথা আমি আগেই বলেছি ।মহামায়া ,যোগমায়া, বিষ্ণুমায়া যোগনিদ্রা একার্থক । শ্রীরামকৃষ্ণ মহামায়া তত্ত্বটি অতি সুন্দররূপে পরিস্ফুট করেছেন…. তাঁর মতে ” ব্রহ্ম কালী, কালীই ব্রহ্ম, যাঁকে বৈদান্তিকগণ ব্রহ্ম বলেন, তান্ত্রিকগন তাঁকেই জগৎজননী মহামায়া বা মহামাঞরূপে উপাসনা করেন। ব্রহ্ম ও মহামায়া অভেদ।” শ্রীরামকৃষ্ণের তন্ত্রসাধনার অভূতপূর্ব সুদূরপ্রসারী । ভৈরবী ব্রাহ্মনীর উপদেশে ৬৪ তন্ত্রের সব গুলিতে সিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি ।
মহামায়া পরমেশ্বরী শক্তি । ঘটনা – অঘটন- পটিয়সী ব্রহ্মাত্মিকা শক্তি । এই মহাশক্তি দ্বারাই ঈশ্বর বা প্রকৃতি সৃষ্টি ও সংহারাদি ও জন্মমৃত্যু লীলাদি কার্য করে থাকেন।
অহমেব স্বয়মিদং বদামি জুষ্টং দেবেভিরুত মানুষেভিঃ।
যং কাময়ে তং তমুগ্রং কৃণোমি তং ব্রহ্মাণং তমুষিং তং সুমেধাম্।
অর্থাৎ ,ব্রহ্মবিদ্বেষীকে বধ করার জন্য সংহারকারী রূদ্রের ধনুকে আমিই জ্যা পরিয়ে দিই।সৎ ব্যক্তিগণের বিরোধী শত্রুগণের সাথে সংগ্রাম করে আমিই তাদের পরাজিত করি। দ্যুলোক ও পৃথিবীতে আমি অন্তর্যামিনী রূপে পরিচিতা।
অহং রুদ্রায় ধনুরাতনোমি ব্রহ্মদ্বিষে শরবে হন্তবা উ।
অহং জনায় সমদং কৃণোম্যহং দ্যাবাপৃথিবী আবিবেশ।
অর্থাৎ, আমি সেই পরম তত্ত্বের উপদেশ দিচ্ছি, দেবতা ও মানুষ যাঁর সেবা করেন। আমি স্বয়ং ব্রহ্মা। আমি যাঁকে রক্ষা করি সে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বানিয়ে দিই, যাঁকে ইচ্ছা করি তাকে বৃহস্পতির মত মেধাবান বানিয়ে দিই। আমি স্বয়ং ব্রহ্মাভিন্ন আত্মা, যে আমারই স্বরূপ, তার গান করি।
#সমাপ্ত
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি
পুরুলিয়ার লৌকিক দেবদেবী