মুখ্যমন্ত্রীর আসনে থাকাকালীন কমঃ জ্যোতি বসু (Jyoti Basu) এক শিল্পপতির ঘেরাও আন্দোলন তুলে নেওয়ার কাতর আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন “Capitalist are class enemies and he should expect no sympathy.” বাম জমানার ঠিক পূর্বে কলকারখানায় কর্ম সংস্থানের নিরিখে যে রাজ্য প্রথম সারিতে ছিল, সেই রাজ্য এখন তালিকায় ১২ নম্বরে। মালিকপক্ষকে শ্রেণী শত্রু ঘোষনা করে ক্রমাগত ঘেরাও এবং হিংসাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে এই বাংলার বুকে যে রাজনৈতিক অশুভ শক্তির উত্থান হয়েছিল তার অবশ্যম্ভাবী ফলস্রুতিতে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়েছিল, বিনিময়ে উল্কার গতিতে বেড়ে উঠেছিল পার্টির সদস্য সংখ্যা।
১৯৬৭ সালে কমঃ জ্যোতি বসু (Jyoti Basu) ডেপুটি চিফ মিনিস্টার হিসাবে শপথ নিলেন এবং রাজনৈতিক ডামাডোলের সুযোগে স্বামী বিবেকানন্দের পরম অনুরাগী মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি (Ajay Mukherjee) কে কার্যত পাশে সরিয়ে রেখে ডিক্টেটরশিপের অশুভ সূচনা করলেন এই রাজ্যের বুকে। মুখ্যমন্ত্রীর থেকেও অধিক ক্ষমতাবান হয়ে দায়িত্বহীন ক্ষমতা ও বিকৃত রাজনৈতিক আদর্শের অভাবিত মেলবন্ধন একেরপর এক শিল্প বিরোধী নির্বোধ আইন পাস করতে লাগল। ফল স্বরূপ শ্রমিক মালিক সংঘাত নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাড়ালো। রাজ্যজুড়ে ঐ বছরই মোট ১৩৭২ বার ঘেরাও আন্দোলন হল এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের মন এমনভাবে বিষিয়ে দেওয়া হল যে কোথাও একদিন, কোথাও দুই দিন জল ও খাদ্য না দিয়ে মালিকপক্ষ কে আটকে রাখা হল। একটার পর একটা কলকারখানা বন্ধ হওয়া শুরু হল। একটা একটা করে বাম আমলে মোট ৫৬০০০ কারখানা বন্ধ হল। কিছু ছোট কোম্পানী অন্য রাজ্যে বাধ্য হয়ে পালালো। ১৯৬৬ সালে সমগ্র দেশের শিল্প উৎপাদনের ২০.১% যেখানে এই রাজ্যে হত, তা বাম জমানায় কমতে কমতে শেষে ২.৯% এ পৌঁছাল। স্বাভাবিক ফলস্রুতিতেই কোলকাতা বিমানবন্দরে বৈদেশিক বিমান অবতরণ কমতে লাগল। সত্তরের দশকে যেখানে সপ্তাহে ১৮ টি বিমান লন্ডন থেকে কোলকাতায় আসতো, তা কমতে কমতে মাত্র ৮ এ গিয়ে ঠেকল। ধর্মঘট, ঘেরাও থেকে কোলকাতা নদী বন্দরও মুক্তি পেল না। ষাটের দশকে যেখানে ৯.৪ মিলিয়ন টন মাল পরিবহন করে দেশের এক নম্বর বন্দর ছিল, তা রাজনৈতিক হিংস্র আন্দোলনের কারনে সারা দেশের নিরিখে সপ্তমে নেমে আসল। অসংখ্য শ্রমিক কাজ হারালেন। বাংলার আপামর জনতা এই নির্লজ্জ অবিবেচক পুঁজি খেদানোর আন্দোলন চরম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সামনে অসহায় ভাবে দেখতে থাকলেন। ক্রমাগত পুঁজির পলায়ন ও বাজারী ঋণের ফাঁদে পরে শ্রমিক শ্রেণির নাভিশ্বাস উঠল, তাদের ক্রয় ক্ষমতা তলানিতে পৌছালো।১৯৬০-৬১ সালে বাংলা মাথাপিছু ইনকামে সারা দেশে প্রথম স্থানে ছিল, আর আজ ২৩ তম স্থানে। জিডিপির ক্ষেত্রে শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রের শেয়ার ক্রমাগত কমতে কমতে নব্বইয়ের দশকে তলানিতে ঠেকল। জন প্রতি জিডিপি তে আজ আমাদের রাজ্য ২০ তম স্থানে। বাম আমলে ভন্ড শ্রেণি শত্রুতা ও ধ্বংসাত্মক হিংস্রতার মাধ্যমে পুঁজির যে পলায়ন শুরু হয়েছিল, আজ ভ্রান্ত জমি নীতি, তোলাবাজি ও সিন্ডিকেট রাজ সেই কফিনে শেষ পেরেক পুতেছে।
২০২০ এর শ্রমিক দিবসের প্রাক্কালে এই তথ্যগুলি প্রতিটি সচেতন নাগরিকের হৃদয় ভারাক্রান্ত ও অনুশোচনায় বিদ্ধ করে তুলবে, সন্দেহ নেই। পরিশেষে এটা লিখতেই হয়, যে বিকৃত রাজনৈতিক আদর্শ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিল্প মাত্রেই শোষণের হাতিয়ার, পুঁজির হাত সর্বদাই কালো আর ধ্বংস করাটাই চরম মোক্ষ, তাদের শ্রমিক দরদী সাজাটা সত্যিই হাস্যকর। ভ্রান্ত দর্শন সম্বল করে কায়েমি স্বার্থে মেকি শ্রেণী শত্রুতার নাম নিয়ে এবং পরবর্তীকালে আদর্শ শূন্য রাজনীতির তোলাবাজি ও সিন্ডিকেট রাজের মাধ্যমে অর্থনীতির মূলভিত্তি ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে শ্রমিক সমাজ কে আবশ্যিক ভাবে “রিক্শাই আমাদের ভিত্তি, টোটোই আমাদের ভবিষ্যৎ” এর পথে ঠেলে দেওয়া ভন্ডদের প্রতি শ্রমিক দিবসে রইল একরাশ ঘৃণা।
ডঃ তরুণ মজুমদার (Dr. Tarun Majumdar)