গত ১১ ফেব্রুয়ারি উত্তর প্রদেশের লখনৌতে গান্ধী পরিবারের নতুন উত্তরাধিকারী রাজীব তনয়া প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর (বঢরা) কংগ্রেসের সম্পাদক পদে অভিষিক্ত হবার পর প্রথম রোড শোতে বড় সংখ্যক জনসমাগম লক্ষ্য করে মিডিয়া সহ কংগ্রেস সমর্থকদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা জেগে উঠেছে। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে সদ্য নিযুক্তা গান্ধী পরিবারের সদস্যের এহেন জনপ্রিয়তা দেখে কংগ্রেস ভক্তরা তার মধ্যে পিতামহী ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। স্বাধীনোত্তর ভারতে ছয় দশক রাজপাট চালিয়ে আসা শতাব্দী প্রাচীন ক্রমক্ষয়িষ্ণু দলটির কর্মী সমর্থকরা নাতনি প্রিয়াঙ্কার মধ্যে ইন্দিরার চেহারাগত সাদৃশ্য দেখে নতুন করে আশায় বুক বাধছেন। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও গান্ধী নেহরু পরিবারের পরিচিতিকে মূলধন করে ভারতীয় রাজনীতি এই শতায়ুপ্রাচীন দলটি টিকে থাকতে চাইছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইন্দিরার প্রতিচ্ছবিকে আশ্রয় করে কংগ্রেস দল কতটা উজ্জীবিত হতে পারবে আগামী দিনে?
এই প্রসঙ্গে এখন কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রের ইতিহাসটা একটু ফিরে দেখা যাক। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তিম পর্বে মহাত্মা গান্ধীর অন্ধস্নেহের আশ্রয়ে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিয়ে পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর কংগ্রেস তথা ভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার কথা সর্বজনবিদিত। স্বাধীন ভারতে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রায় দের দশক রাজত্ব করার পর নেহরুর সুপ্ত বাসনা ছিল কন্যা ইন্দিরাকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যাওয়া। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে নেহরু তার বিখ্যাত ‘কামরাজ প্ল্যানের’ মাধ্যমে দলের অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত নেতাদের ডানা ছেঁটে আগামী দিনে কন্যা ইন্দিরার রাজ্যাভিষেকের পথটিকে অত্যন্ত সুকৌশলে কন্টকমুক্ত করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কাঠামোকে চিরতরে ধ্বংস করে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন দলের মধ্যে পরিবারতন্ত্র, সামন্ততান্ত্রিকতা এবং গোষ্টীতন্ত্রের—যা তার উত্তরাধিকারীগণ সযত্নে অনুসরণ করে চলেছে।
ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরেই ইন্দিরা তার পিতা নেহরুর সমসাময়িক নেতৃবৃন্দকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার পথে পা বাড়ান। ফলে দলের মধ্যে সৃষ্টি হয় গভীর অসন্তোষ যার থেকে পরবর্তীকালে কংগ্রেস দলের চিরকালীন ভাঙ্গনের রাজনীতির সূত্রপাত ঘটে। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়স্তরে একসঙ্গে অনেক পুরানো ও প্রতিষ্ঠিত নেতার আকস্মিক অপসারণের ফলে কংগ্রেস দলের সাংগঠনিক স্তরে বড় ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এই সময় ইন্দিরা গান্ধী অতিদ্রুত এবং বিচার বিবেচনা ছাড়াই তার নিজের পছন্দের ‘ইয়েস ম্যান’দের সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে নিযুক্ত করেন। তখন থেকে সাংগঠনিক দক্ষতা, জনপ্রিয়তা বা ব্যক্তিগত যোগ্যতা নয় গান্ধী পরিবারের নেক নজর লাভই কংগ্রেস দলে বিভিন্ন স্তরে পদ লাভের প্রধান মাপকাঠি হয়ে দাড়ায়। ফলস্বরূপ কংগ্রেস তার যুক্তরাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক কাঠামো হারিয়ে একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়। আর এক শ্রেণীর মেরুদণ্ডহীন, গান্ধী নেহরু পরিবারের তল্পিবাহক, জনভিত্তিহীন সুযোগ সন্ধানী ধান্দাবাজ ভূঁইফোর নেতা দলের মধ্যে ভিড় জমাতে শুরু করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের দল হিসাবে যে বিরাট সুনাম, জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা কংগ্রেস ভোগ করত তার থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। কংগ্রেস এখন গান্ধী নেহরু পরিবারের নিজস্ব দলে পরিণত হয়।
১৯৭১ সালে আমেরিকার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিশ্বব্যাপী ঠান্ডাযুদ্ধের আবহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ও রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জনমনে গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’ সমর্থকদের এই অভিধায় ভূষিত হয়ে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রাজনীতিতে তার চুড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্র পরিষদ, যুবকংগ্রেস ইত্যাদি সংগঠনের নামে এমন এক তরুণ প্রজন্মকে সামনের সারিতে তুলে আনেন তিনি, যাদের অনেকেরই সামাজিক স্তরে গ্রহণযোগ্যতার অভাব ছিল। দলের সাংগঠনিক স্তরে ‘স্তাবকতা’, ‘পদলেহন’ ইত্যাদি গুণের অধিকারী ব্যক্তিদের বাড়বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। অন্ধ ইন্দিরা অনুগামীদের দুষ্কর্মের প্রতিবাদ করা বা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার মতো মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে ফেলা হয় এই পথেই নষ্ট করে দেওয়া হয় দলের মধ্যে বহু স্বাধীনচেতা যোগ্য ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
ইন্দিরা গান্ধীর কঠোর স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের নগ্নরূপ দেখা দিল ১৯৭৫ সালের জাতীয় জরুরী অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে। বিরোধী দল, সংবাদ মাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও কণ্ঠরোধের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চলল। এই সময় ভারতে নেমে আসে গণতন্ত্রের এক কালো অধ্যায়। এই পর্বেই ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবল দাপট যথেষ্ট লক্ষণীয় ছিল।
অতপর ১৯৮৪ সালে ইন্দিরার হত্যাকান্ড ঘটল। মায়ের সহানুভূতির আবেগকে পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কংগ্রেস তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘রাজনীতিতে পুরোপুরি অনভিজ্ঞ’ রাজীব গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় সভাপতি পদে অভিষিক্ত করে আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্যান্য সম্ভবনাময় নেতাদের অনৈতিকভাবে সরিয়ে দেয়। আবার রাজীব হত্যার পরবর্তী অল্প কিছুকাল কংগ্রেস নেতৃত্ব গান্ধীপরিবারের নেতৃত্বের বাইরে থাকলেও অটল বিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এন ডি এ সরকারের আমলে নরসীমা রাও, সীতারাম কেশরী প্রমুখের মতো প্রবীণ নেতাদের অসম্মানজনক ভাবে অপসারিত করে রাজীব পত্নী সোনিয়া গান্ধীকে সভাপতি পদে আনা হয়। একে কেন্দ্র করে কংগ্রেস দলের মধ্যে পুনরায় ভাঙন ধরে।
ইউ পি এ সরকার গঠনের সময় জনমতের চাপে বিদেশিনী ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী পদে না বসতে পারলেও সোনিয়া গান্ধী তার বশংবদ মনমোহন সিংহকে শিখণ্ডী রূপে দাড় করিয়ে বকলমে ‘কংগ্রেসের অন্তরাত্মা’ সোনিয়া গান্ধী নিজ শাসন কায়েম রাখেন। এবং অতি সুদক্ষভাবে পুত্র রাহুলের জন্য কংগ্রেসের রাজ সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার সকল পথ প্রসস্থ করেন।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বি জে পি শুধু এককভাবে ক্ষমতা দখলই নয় শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস দলের আসন সংখ্যা ৫০-এর নিচে নামিয়ে আনে। দলের পুনরুত্থানের জন্য কংগ্রেসের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয় রাজীব-সোনিয়া পুত্র রাহুলের হাতে। আসন্ন ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে রাহুলের হাত শক্ত করার জন্য বোন প্রিয়াঙ্কাকে দলের সাধারণ সম্পাদক পদে নিযুক্ত করে সামনে আনা হচ্ছে। আজ থেকে ৬০ বছর আগে ১৯৫৯ সালে বসন্তকালের শুরুতে নেহরু কন্যা ইন্দিরাকে কংগ্রেস সভাপতি পদে অভিষিক্ত করেন সকলকে হতচকিত করে দিয়ে। আর উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ ও লখনৌতে সমাবেশের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন ইন্দিরা। সেই ট্রাডিশন অনুসরণ করে কংগ্রেস তার পরম্পরাগত পরিবারতন্ত্রের নিদর্শন স্বরূপ উত্তর প্রদেশের লখনৌ শহরে জমকালো রোড-শো-এর মাধ্যমে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে তুলে ধরতে চাইছে। এখন প্রশ্ন হল ৬০ বছর পর একই চিত্রনাট্য তৈরি করে ইন্দিরা গান্ধীর নাতনি ভারতের জরাগ্রস্থ গ্রান্ড ওল্ড পার্টিকে চাঙ্গা করে তুলতে কত দুর সক্ষম হবেন।
একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, গত ষাটের দশক আর একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের ভারতের রাজনৈতিক চালচিত্রে বিস্তর ফারাক। সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে ইন্দিরা গান্ধীকে অনেক সুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে হয়েছিল। সদ্য স্বাধীন দেশটিতে কংগ্রেস দলের যে অবিসংবাদী প্রাধান্য বিদ্যমান ছিল তাকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই ইন্দিরার পক্ষে শক্তিশালী বিরোধী দলের চ্যালেঞ্জ ছাড়াই উঠে আসা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের গান্ধী পরিবারের সদস্যদের বি. জে. পি-র মতো শক্তিশালী দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। মুখোমুখি হতে হচ্ছে কঠিন চ্যালেঞ্জের। তদুপরি ছয় দশকের অধিক সময় ধরে দলের অবিরাম ভাঙ্গা গড়ার পরিণামে কংগ্রেসের একক প্রাধান্য আজ ইতিহাস। এর সঙ্গে রাজ্যস্তরে আঞ্চলিক দলগুলির বাড়বৃদ্ধি (যেগুলির অধিকাংশ কংগ্রেস ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে) কংগ্রেসের শক্তিকে অনেকাংশে খর্ব করে দিয়েছে। তাই একক ক্যারিশিমায় নাতনি শ্রীমতী গান্ধীর পক্ষে কংগ্রেসকে টেনে তোলা অনেকটা দিবাস্বপ্নের মতো। তাছাড়া তিনি এখন এক্ষেত্রে পরীক্ষিতাও নন।
উল্লেখ্য যে, ইন্দিরা ও প্রিয়াঙ্কার মধ্যে প্রজন্মগত ব্যবধান অনেক। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ভারতবাসী আগের মতো গান্ধী ও নেহরু পরিবারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শনে রাজি নয়। সচেতন, যুক্তিশীল বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ সামন্ততান্ত্রিকতার প্রতিভূ পরিবারতন্ত্রে কতটা আস্থা দেখাবে তা বলা শক্ত। বরং তারা এখন ভ্রষ্টাচারমুক্ত স্বাভিমান সম্পন্ন দৃঢ় ও শক্তিশালী বিকল্প শাসন ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল ভারতের সুপ্রাচীন দলটি এই আধুনিক গণতন্ত্রের যুগেও গান্ধী-নেহরু পরিবারের বাইরে কোনও সর্বজনগ্রাহ্য সর্বভারতীয় নেতৃত্ব তুলে আনতে ব্যার্থ। ফলে আজকের দিনে বারে বারে ব্যার্থ হওয়া সত্ত্বেও গান্ধী পদবির অধিকারী একটি পরিবারকে কেন্দ্র করেই কংগ্রেসি রাজনীতি অবিরাম আবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতি ত্রিধা বিভক্ত। একদিকে বি. জে. পি আর অন্যদিকে কংগ্রেস আর বহু আঞ্চলিক দলের ঐক্য স্থাপনে অক্লান্ত প্রচেষ্টারত তৃতীয় বিকল্প। এই ত্রিমেরু প্রবণ ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে রাজীব তনয়ার পক্ষে ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসের মরা গাঙে জোয়ার আনা সহজ কাজ হবে না। লখনৌ শহরে একটি রোড শোয়ে সাময়িক লোক সমাগম দেখে প্রিয়াঙ্কার বিরাট রাজনৈতিক সাফল্যের ভবিষ্যৎবাণী করা কঠিন। বিশেষ করে প্রিয়াঙ্কার মধ্যে প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গঠনগত সাদৃশ্যকে মাথায় রেখে তো নয়ই।
সৌমেন ঘোষ