খুলনার গীতারানী সমাদ্দারের বয়স এখন সত্তরের ঘরে। তিনি লিখেছেন–
১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহ।
মোটে ন-মাস বিয়ে হয়েছে। ভালই আছি। হঠাৎ পৌসমাসের দশ এগার তারিখের দিকে আমার স্বামী হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। অতবড় বাড়িটায় একটা চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। ভারতের জম্মু-কাশ্মীরের হযরত বাল মসজিদ থেকে হযরত মুহাম্মদের চুল চুরি হয়ে গেছে।
“তাতে আমাদের কী! জম্মু-কাশ্মীরের চোর চুল চুরি করেছে, পুলিশের কাজ চোর ধরা। আমরা তো জম্মু-কাশ্মীর থেকে হাজার মেইল দূরে আছি।”
পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী সবুর খান খুলনার লোক। উনি বিহারী মুসলমানদের মিটিং ডেকে বললেন– হযরত মহম্মদের চুল চুরি করেছে হিন্দুরা। এটা ওদেরই চক্রান্ত।
পূর্ব পাকিস্তানের কোনো এক কমিটির সদস্য হিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন।
আমাদের বাড়ির পুরুষেরা কেউ ভয়ে বাইরে বের হল না কদিন। শোনা গেল সবুর খান মিটিং করছেন বহু জায়গায়। সবখানেই এককথা, হিন্দুদের খতম কর। ওদের আর এদেশে থাকতে দেওয়া হবে না।
চারদিন বাদে খুলনা শহরে হাজার হাজার মুসলমান তার মধ্যে বিহারী মুসলমান বেশি, তারা সবুর খানের পরিকল্পনা মত একটা শোক মিছিল বের করল। আমরা দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘরে বসে আছি। জীবনের অনেক পথ পেরিয়ে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, দেশের শাসক না চাইলে দাঙ্গা হয় না। সবুর খানের উস্কানিতে মুসলিম লীগের দাঙ্গাবাজ নেতা, মোল্লা, মৌলবি, বিহারী মুসলিম শ্রমিকরা চাঙ্গা হয়ে উঠল। খালিসপুর-দৌলতপুর অঞ্চল থেকে তারা লরিতে করে খুলনা শহরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল হিন্দু এলাকার উপর। মুহুর্মুহু ‘নারায়ে তকবির–আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিতে দিতে দাঙ্গাবাজরা একের পর এক এলাকা রক্ত গঙ্গায় ভাসিয়ে দিল।
দাঙ্গাকারীরা হিন্দুদের দেখামাত্র খুন করেছে। খুলনার লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন, বাজার, রাস্তাঘাড়ে প্রাণ হারাল শত শত মানুষ। সব হিন্দুপাড়া লুটপাট করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। খুলনা শহর ও শহরতলীর একটা হিন্দু এলাকাও রেহাই পেল না। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সমানে চলল নির্বিচারে নারীধর্ষণ ও অত্যাচার। হিন্দু মেয়েদের ধরে নিয়ে নিজেদের মধ্যে লুটের মালের মত ভাগ করে নিল!
খুলনা শহর থেকে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল মোংলা বন্দরে। এই সুদীর্ঘ পথের পাশে প্রতিটা হিন্দু গ্রাম আক্রান্ত হল। সমস্ত গ্রামগুলোই ছিল হিন্দু প্রধান।
খুলনার সুপ্রাচীন কালীমন্দিরের কালীমূর্তিটি ভেঙ্গে চুরমার করে মন্দিরে আগুন লাগিয়ে দিল। খুন করে ফেলল মন্দিরের সেবাইতদের। ছোটখাট দেবালয়, প্রতিটি বাড়ির তুলসিমঞ্চ, ঠাকুরঘর ধ্বংস করা হল। খুলনা, যশোর, গোপালগঞ্জ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি জায়গায় একইরকমভাবে হিন্দুরা আক্রান্ত হল।
শনিবারই জানা গেল, হযরত মহম্মদের কেশ ফিরে পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে কোনো হিন্দু জড়িত ছিল না।
আরো কয়েকটি ঘটনা দেখা যাক-
১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল দশটার সচিবালয়ে রক্তমাখা কাপড় পরিহিত একজন মহিলাকে হাজির করা হয়। গুজব রটানো হয়, এই মহিলাকে কোলকাতায় হিন্দু ধর্ষণ করেছে। সচিবালয় থেকে কর্মচারি ও কর্মকর্তারা বেরিয়ে এসে নবাবপুরের দিকে মিছিল বের করে। দুপুর একটার দিকে এই উগ্র মুসলিমরা হিন্দু বাড়ি-ঘর ও দোকানপাট-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুট করে আগুন ধরিয়ে দিতে শুরু করে। যেখানেই হিন্দুদেরকে পাওয়া যাচ্ছিল সেখানেই তাদেরকে হত্যা করা করেছে তারা। সাতঘণ্টায় ৫০০০০ হিন্দু বাস্তুচ্যুত হয়।
পরে জানা যায় দাঙ্গা করার জন্যই ঐ মহিলাকে ধর্ষিতা হিসবে সাজিয়ে আনা হয়েছিল। ঘটনা সত্যি নয়।
১৯৫০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে বরিশাল শহরে ‘কোলকাতায় শেরে বাংলা ফজলুল হককে হত্যা করা হয়েছে’ বলে দুজন মুসলমান যুবক গুজব রটায়। সন্ধ্যা নেমে আসতেই কমপক্ষে আট জায়গাতে হিন্দুদের দোকানপাটে আগুন লাগানো হয়। ত্রিশটি হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দশজন হিন্দুকে আগুনে ফেলে মেরে ফেলা হয়।
ফজলুল হক কোলকাতা থেকে ফিরে এসে জানান, তাকে কোলকাতায় কেউই গায়ে ফুলের আচড়টুকুও দেয়নি।
১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে বরিশাল শহর ও গ্রামে নানা গুজব রটিয়ে ২৫০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয়। সাড়ে ছয় লাখ হিন্দুকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।
2012 সালে কক্সবাজারের রামুতে, 2013 সালে রংপুরের গঙ্গাচড়ায়,2016 সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, 2017 সালে রংপুরে গঙ্গচড়ায়, দিনাজপুরে, 2021 সালে মার্চে শাল্লায়, আগস্ট মাসে
খুলনায় হিন্দু তথা সংখ্যালঘুদের উপর দেশব্যাপী সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর সহায়সম্পদ লুটপাট করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। হিন্দুদেরকে হত্যা করা হয়েছে। দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
এসব ঘটনাই করা হয়েছে ফেসবুকে উস্কানী দিয়ে। কোন এক এলাকার কোনো এক হিন্দুর নাম দিয়ে অভিযোগ করা হয়েছে–এই হিন্দু লোকটি পবিত্র কোরান, হযরত মোহাম্মদ, কাবা শরীফকে অবমাননা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। এর সত্যমিথ্যা যাচাই না করে সংঘবদ্ধভাবে দেশব্যাপী হিন্দুদেরকে আক্রমণ করেছে। তাদের কলেপড়া ইঁদুরের মতো মেরেছে। এবারের এই অক্টোবরে কুমিল্লায় একইভাবে হিন্দুদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। ধীরে ধীরে আক্রমণটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
অথচ সেই পাকিস্তান আমল থেকে এই 2021 সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত হিন্দু তথা সংখালঘুরা কখনোই ফেসবুকে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করার মতো কোনো কাজ, লেখা বা পোস্ট দেয়নি। দিয়েছে — এমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রতিটি ঘটনাই ছিল সাজানো। পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদেরকে নির্যাতনের জন্য হিন্দুদের নাম ব্যবহার করে ফেসবুকে আক্রমণকারীরা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গুজব ছড়িয়েছে। যাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে সেইসব হিন্দুর অধিকাংশেরই ফেসবুক নেই, ফেসবুক কী জিনিস তারা জানে না। জানলেও তারা এমন কোনো কিছু করেনি।
এইসব হিন্দু নির্যাতনের ঘটনার কোনো কোনটিতে মামলা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনোটিরই বিচার করা হয়নি। শাস্তির বদলে আক্রমণকারীদেরকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি নাসিরনগরের আক্রমণকারী তিনজনকে জামিন দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়েছিল।
একাত্তর সালে পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিল হিন্দুরা। সারাদেশে খুঁজে খুঁজে হিন্দুদেরকেই হত্যা করেছিল। সে সংখ্যা 15 থেকে 20 লক্ষ হবে। এক কোটি হিন্দুদেরকে দেশ থেকে গুলির মুখে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
এরপর এই পঞ্চাশ বছরে হিন্দুরাই সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এরা তাদের পিতৃপুরুষের ভূমিতে শুধু মানুষের মতো বাঁচতে চেয়েছে। কখনোই হিন্দুরা প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করার মতো কোনো সংগঠনও তাদের নেই। সংগঠক নেই–নেতা নেই। নির্যাতনগুলোকে নিয়তি হিসেবে মেনে মার খাচ্ছে। তবুও মাটি কামড়ে থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোভাবেই টিকতে না পেরে চোখের জল ফেলতে ফেলতে দেশত্যাগ করছে। নি:স্ব হচ্ছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং প্রতিবছরই বাড়ছে। দেশকে হিন্দু তথা সংখ্যালঘু শূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ চলছে। এর সঙ্গে পাকিস্তানপন্থী জামায়াত, হেফাজত, বিএনপি, জাতীয়পার্টি এবং এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ– সবাই জড়িত। হিন্দুদের উপর একদা সহানুভূতিশীল আওয়ামী লীগ এখন মৌলবাদীদের খুশি করতে তাদের গা থেকে হিন্দুসহানুভূতির পরিচয়টি ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। চীনাপন্থী বামেরা পাকিস্তানপন্থীদের মতো বাংলাদেশটিকে সংখ্যালঘু শূন্য দেশ হিসেবে দেখতে চায়। ক্ষমতায় টিকে থাকা, ক্ষমতায় যাওয়া আর হিন্দুদের সহায় সম্পদ সহজে দখল করার অপরাজনীতির নির্মম শিকার হলো সংখ্যালঘুরা। সবাই সম্ভবত একমত হয়েছে দেশটি থেকে ‘বহুত্বের মধ্যে ঐক্য’ ধারণাটিকে মুছে ফেলতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে সম্ভবত সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার মতো কেউ আর নেই।
কুলদা রায় – নিউইয়র্ক