‘এক সদ বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি’। সত্য একটাই কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেন। ভারতীয় জ্ঞান ভাণ্ডার, প্রাচীন সাহিত্য, এই বিষয়টিকেই প্রতিধ্বনিত করে। ঈশ্বর থেকেই এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, ঈশ্বরের মধ্যেই এই জগৎ রয়েছে, ঈশ্বরের মধ্যেই এই জগৎ বিলীন হয়ে যায়— এটিই চিরন্তন সত্য।
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একটি ছন্দ তথা নিয়মে চলে। প্রাচীন ভারতীয় মুনি-ঋষিরা এই বিষয়টি জানতেন। এই ছন্দই হলাে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র সংখ্যা ১০৮-এর প্রতীক। এই আধ্যাত্মিক এবং গৃঢ়সংখ্যা ১০৮ প্রাচীন ভারতীয়দের কাছে ছিল খুবই পবিত্র। আজও সেই ধারা সমানে চলে আসছে। সমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ১০৮-কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়।
(১) ভারতীয় পুরাণ মতে ভারতীয় সংস্কৃতিতে ১০৮ সংখ্যাটির একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। এক মিনিটে আমরা সাধারণত ১৫ বার শ্বাসক্রিয়া চালাই। সেই হিসাবে এক ঘণ্টায় ৯০০ বার এবং ১২ ঘণ্টায় ১০ হাজার বার এবং ২৪ ঘণ্টায় (১০ ৮০০x২) ২১,৬০০ বার। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি ১২ ঘণ্টা নিজের কাজের জন্য রাখা যায়, তাহলে বাকি ১২ ঘণ্টা একজন ব্যক্তি ভগবানের আরাধনা করতে পাবেন। তাই একজন ব্যক্তি সর্বাধিক ১০,৮০০ বার ইষ্টনাম জপ করতে পারেন। কেউ যদি এই জপের ১০০ শতাংশ উপকার পেতে চায়, তাহলে তাকে ১০৮ বার জপ করলেই হবে তাই একটি জপমালাতে ১০৮টি পুঁতি থাকে।
(২) জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী আমাদের ছায়াপথে ২৭টি নক্ষত্রপুঞ্জ আছে। প্রত্যেকের চারটি করে দিক আছে। অর্থাৎ ২৭x৪=১০৮। অন্যভাবে বলতে গেলে ১০৮ সংখ্যাটি সমগ্র ছায়াপথকে আবৃত করে।
(৩) হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুসারে ৯ সংখ্যাটি বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার প্রতীক। গাণিতিক দিক থেকে ৯ একটি অদ্ভুত সংখ্যা।
৯x১=৯ ৯x২=১৮ (৮+১=৯) ৯x৩=২৭ (৭+২=৯) ৯x৪=৩৬ (৬+৩=৯) ৯x৫=৪৫ (৫+৪=৯) ৯x১২=১০৮ (১+০+৮=৯)।
(৪) হিন্দু ধর্মে ৯ একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। ৯ এর গুরুত্ব মাথায় রেখে ঋষি ব্যাসদেব ৯টি পুরাণ এবং ১০৮টি মহাপুরাণ (উপনিষদ) রচনা করেছিলেন। মহাভারতে ১৮টি অধ্যায় আছে। গীতাতে। ১৮ অধ্যায় আছে এবং ১০, ৮০০টি শ্লোক আছে। ১০৮ এই সংখ্যাটির অঙ্কগুলির যােগফল ৯ এবং এই ৯ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সঙ্গে সম্পর্কিত।
(৫) আমাদের বেদ সূর্যকে দেবতা হিসাবে বিবেচনা করে। সূর্যের ১২টি রাশিচক্র আছে। যজুর্বেদে সূর্যকে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঈশ্বরের প্রার্থনার জন্য ১০৮ সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ। ১২ (রাশিচক্র) x ৯ (ব্রহ্মার প্রতীক) = ১০৮ (১+০+৮=৯)। তাই ১০৮ খুবই পবিত্র সংখ্যা।
(৬) ভারতীয় পুরাণ মতে চারটি যুগ আছে। (ক) সত্যযুগ ১৭২,৮০০ বছর নিয়ে সত্যযুগের ব্যাপ্তি (১+৭+২+৮=১৮) (১+৮=৯)
(খ) ত্রেতাযুগের ব্যাপ্তি ১২৯৬০০০ বছর (১+২+৯+৬=১৮) (১+৮=৯)।
(গ) দ্বাপর যুগের ব্যাপ্তি ৮৬৪০০০ বছর (৮+৬+৪=১৮) (১+৮=৯)।
(ঘ) কলিযুগের ব্যাপ্তি ৪৩২০০ বছর (৪+৩+২=৯)।
(৭) আকাঙ্ক্ষা : কথিত আছে যে মনুষ্যজাতির ১০৮ প্রকারের পার্থিব আকাঙ্ক্ষা থাকে।
(৮) মিথ্যা : কথিত আছে যে, মনুষ্যসমাজ ১০৮ প্রকার মিথ্যা বলে।
(৯) বিভ্রান্তি : বলা হয় যে মানুষের ১০৮ প্রকার বিভ্রান্তি হয়।
(১০) সংস্কৃত বর্ণমালা : সংস্কৃত বর্ণমালায় ৫৪ টি বর্ণ আছে। প্রতিটি বর্ণের পুরুষ এবং স্ত্রী সত্তা আছে শিব এবং শক্তি। ৫৪x২=১০৮।
(১১) প্রাণায়াম : প্রশান্ত চিত্তে কোনও ব্যক্তি যদি ধ্যানস্থ অবস্থায় দিনে একবার ১০৮ বার শ্বাসক্রিয়া চলায়, তাহলে তার মন এক নতুন শক্তি পায়।
(১২) পঞ্চভুজ : একটি পঞ্চভূজের দুটি পাশাপাশি রেখা মিলিত হয়ে যে কোণ উৎপন্ন করে তা ১০৮ ডিগ্রির কোণ।
(১৩) মর্মবিন্দু : আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলে যে, আমাদের শরীরে ১০৮টি মর্মবিন্দু বা মর্মস্থান (শরীরের মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু) আছে। সেখানে আমাদের চেতনা এবং দৈহিক ইচ্ছা মিলিত হয়ে আমাদের জীবনে শক্তির সঞ্চার করে। ১০৮টি লিংক পয়েন্ট বা মর্মবিন্দু পরস্পরের সঙ্গে ১০৭টি সন্ধি (জয়েন্ট) দ্বারা একটি শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
(১৪) অনুভূতি : কথিত আছে যে, আমাদের ১০৮ রকমের অনুভূতি আছে— ৩৬টি অতীত, ৩৬টি বর্তমান এবং ৩৬টি ভবিষ্যৎ কালের সঙ্গে জড়িত।
(১৫) গঙ্গা নদী : পবিত্র গঙ্গা নদী ১২ ডিগ্রি দ্রাক্ষিমাংশ (৭৯ থেকে ৯১) এবং ৯ ডিগ্রি অক্ষাংশ (২২ থেকে ৩১) পর্যন্ত ব্যাপ্ত। ১২x৯= ১০৮।
(১৬) গ্রহ এবং রাশিচক্র : জ্যোতিষশাস্ত্রে ১২টি রাশিচক্র এবং ৯টি গ্রহ আছে। ১২×৯= ১০৮।
(১৭) জ্যোতিষশাস্ত্র : জ্যোতিষশাস্ত্রে বৈদিক ঋষিরা হিসাব কষে দেখেছেন যে, (ক) পৃথিবী এবং চন্দ্রের মধ্যে দূরত্ব হলাে চন্দ্রের ব্যাসের ১০৮ গুণ।
(খ) পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যে দূরত্ব হলাে সূর্যের ব্যাসের ১০৮ গুণ।
(গ) সূর্যের ব্যাস হলাে পৃথিবীর ব্যাসের ১০৮ গুণ। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পৃথিবী এবং চাঁদ পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যে যে গড় দূরত্ব পরিমাপ করা হয়েছে তা আশ্চর্যজনকভাবে বৈদিক ঋষিদের হিসাবের প্রায় কাছাকাছি।
(১৮) কৃষ্ণের গােপী : কৃষ্ণকথায় বলা হয় কৃষ্ণের গােপীর সংখ্যা ১০৮।
(১৯) ১,০, ৮ : কেউ কেউ বলেন যে, ১ হলাে ঈশ্বরের প্রতীক। ০ হলাে আধ্যাত্মিক অভ্যাসের পরিপূর্ণতা এবং ৮ হলাে অসীমের প্রতীক।
(২০) ঈশ্বর প্রাপ্তির পথ : কেউ কেউ বলেন যে, ঈশ্বর প্রাপ্তির ১০৮টি পথ আছে।
(২১) ক্ষুদ্রাংশ : ১০৮ সংখ্যাটি ২, ৩, ৪, ১২ দিয়ে বিভাজ্য। তাই কিছু কিছু মালার পুঁতির সংখ্যা ৫৪, ৩৬, ২৭ এবং ৯।
(২২) হিন্দুত্ব : হিন্দু ধর্ম অনুসারে ১০৮ জন দেব-দেবীর অস্তিত্ব রয়েছে। কেউ কেউ আবার বলেন যে, প্রত্যেক দেব-দেবীর আবার ১০৮টি করে নাম আছে।
(২৩) নৃত্য : ভারতীয় সংস্কৃতিতে ১০৮ প্রকার নৃত্যকলা রয়েছে।
শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মেই নয়, ১০৮ সংখ্যাটির গুরুত্ব অন্যান্য ধর্মমতেও আছে। জৈন ধর্মমতে মােট ৫ প্রকার গুণ (১২+৮+৩৬+২৫+২৭) সম্মিলিত ভাবে আমাদের দেহে থাকে। শিখ ধর্মমতাবলম্বীরা একটি উলের দড়ির ওপর ১০৮টি গাঁট (পুঁতি নয়) সংবলিত মালা জপ করে। কিছু কিছু বৌদ্ধ একটি আখরােটের ওপর ১০৮টি ছােটো বুদ্ধমূর্তি খােদাই করেন সৌভাগ্যের প্রতীক রূপে। চীনদেশের বৌদ্ধ এবং তাও ধর্মাবলম্বীরা ১০৮টি পুঁতি সংবলিত মালা ব্যবহার করেন। এই মালাটির নাম ‘শু-চু’। মালার পুঁতিগুলি সমান তিন ভাগে (৩৬x৩) বিভক্ত। চীনদেশের জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে মহাকাশে ১০৮টি পবিত্র তারা আছে।
এইভাবে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের হিন্দু শাস্ত্রের পরম্পরা অনুয়ায়ী ১০৮ সংখ্যাটির একটি অপরিসীম গুরুত্ব আছে।
(সৌজন্য ইটারনাল ট্যালেন্টেড ইন্ডিয়া, প্রকাশক : রামকৃষ্ণ মঠ, হায়দরাবাদ)
রাজদীপ মিশ্র