কাকাবেনের সংস্কৃতি – পর্ব ৩

পর্ব ৩

কাকাবেনের দেশ ইন্দোনেশিয়া। রামায়ণের দেশ ইন্দোনেশিয়া। সুপ্রাচীন সনাতন ধর্ম সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এখনো বালিদ্বীপের অধিবাসীরা। প্রাচীন জম্বুদ্বীপ হতে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভারতবর্ষের অফুরন্ত ঐশ্বর্যভান্ডার ভারতকে তথা বৃহত্তর ভারতকে সমৃদ্ধ করেছে। ঐশ্বর্য অর্থে টাকাপয়সা, সোনা দানা নয়। ঐশ্বর্য অর্থাৎ আধ্যাত্মিকভাব, জ্ঞান, বিদ্যা….ঈশ্বরের নিকট গিয়ে যা সমাহিত হয়, যা সাধকের সাধনা, গৃহীর জীবনের পাড়ানি। বৈদেশিকরা এই সুবিশাল ভারতীয় উপমহাদেশের ধনসম্পদ ,  শস্য সম্পদকে লুন্ঠন করতে ছুটে এসেছে বারংবার। কিন্তু ভারতীয়রা ? ভারতীয়রা বৃহত্তর ভারতকে আপন করে নিয়েছিলেন আপন সংস্কার ,বুদ্ধি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প দিয়ে। ভারতবর্ষের  অনুপম সনাতনী ধর্ম, সংস্কৃতি ,  সৃষ্টি  নানা ভাবে ছুঁয়ে জয় করে গেছে বহু মানুষকে, বহু দেশকে, আবহমান কালকে অতিক্রম করে। সেসবের মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত অন্যতম। এই দুই মহাকাব্যের মধ্যে ভারতের যে যে রূপ প্রকাশিত হয়েছে তা কালাতিক্রমী। রাম যে একই কালে আমাদের কাছে দেবতা এবং মানুষ, রামায়ণ যে একই কালে আমাদের কাছে ভক্তি এবং প্রীতি পেয়েছে, এটি কখনোই সম্ভব হত না যদি এই মহাগ্রন্থের কবিত্ব  ভারতবর্ষের পক্ষে কেবল সুদূর কল্পলোকেরই সামগ্রী হত, যদি তা আমাদের সংসারসীমার মধ্যেও ধরা না দিত।


বাল্মিকীকে তাই নারদ বলেছিলেন – 
দেবেষ্বপি ন পশ্যামি কশ্চিদেভির্‌গুণৈর্‌যুতম্‌।

 শ্রূয়তাং তু গুণৈরেভির্‌ যো যুক্তো নরচন্দ্রমাঃ।।

শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের, “রামায়ণী কথা’র ভূমিকা রচনা করতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন –  ভারতবাসীর ঘরের লোক এত সত্য নহে , রাম , লক্ষ্মণ , সীতা তাহার পক্ষে যত সত্য। “
পূর্ব পর্বে উল্লিখিত ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত দুটি রামায়ণ সেরৎরম এবং কাকাবেন বা কাকাবীণ ব্যতীতও আরো তিনটি রাম বা রামায়ণকেন্দ্রীক বা রামায়ণাশ্রয়ী সাহিত্য রচিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, ইন্দোনেশিয়ায় যে যে সাহিত্য বিষ্ণু, রাম, রামায়ণকেন্দ্রীক সাহিত্য আছে ,তারা সকলেই নামের শেষে কাকাবেন বা কাকাবীণ ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ , সকলই রামময়, রাম ভক্তময়। স্পু – মনোগুণ নামক কবির #সুমনসান্তক এবং স্পু – তন্তুলার  #অর্জুনবিজয় ও #হরিশ্রয় নামক তিনটি কাকাবীণ প্রাপ্ত হয়েছে। হরিশ্রয় কাকাবীণ যদিও অনেকের মতে যোগীশ্বরেরদ্বারা রচিত। 


সুমনসান্তক কাকাবীণের সঙ্গে মহাকবি কালিদাস রচিত #রঘুবংশম্ কাব্যের বহুল পরিমাণে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, আবার কিছু ক্ষেত্রে পদ্মপুরাণের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। এ কথা সত্য কালিদাস মহাপন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। সুবিশাল অখণ্ড ভারতবর্ষ এবং বৃহত্তর  দ্বীপময় ভারত সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন যথেষ্ট পরিমাণে । শ্রীযুক্ত হিমাংশুভূষণ সরকার মহাশয় তাঁর ” দ্বীপময় ভারতের প্রাচীন সাহিত্য” বিষয়টি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ।  ১৮৪ টি সর্গে বিভক্ত এই সুমনসান্তক কাব্যটি প্রাচীন যবদ্বীপীয় ভাষার মধ্যে এক অনুপম সংস্কৃত ছন্দে রচিত হয়েছিল , যা আজও রহস্য এবং বিস্ময়ের উদ্রেক করে বিভিন্ন গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের নিকট।


স্পু- তন্তুলার রচিত হরিশ্রয় কাকাবীণ এর গল্পে মূলত রাক্ষসগণের অত্যাচারে বিষ্ণুর আগমন এবং দেবগণকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অদ্ভুতভাবে এই কাহিনীর সঙ্গে বিষ্ণুপুরাণের অমৃত উদ্ধারের কাহিনীটির বহুলাংশে মিল পরিলক্ষিত হয়।
অর্জুনবিজয় কাকাবীণ রামায়ণটি উত্তরকান্ড রামায়ণের আধারে নির্মিত বা রচিত হয়েছে । যেহেতু স্বাধীনভাবে কাকাবীণগুলি বৃহত্তর ভারতে রচিত হয়েছিল , তাই বিভিন্ন রকমের তথ্য এরমধ্যে সংযুক্ত হয়েছিল এবং রামায়ণকে পরিবর্ধিত করেছিল। এই কাকাবীণে  দেখানো হয়েছে অর্জুন সহস্রবাহু হয়ে রাবণকে বধ করার জন্য যুদ্ধ করেন। কিন্তু তাঁকে পরাজিত করলেও নিহত করতে পারেননি। যেহেতু রাবণের মৃত্যু বিষ্ণু অবতার শ্রীরামচন্দ্র দ্বারাই নির্ধারিত ছিল।  প্রসঙ্গত, এই কাহিনী বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থ খন্ডের একাদশ অধ্যায় বর্ণিত হয়েছে।

 বর্তমানে যখন আমরা জাভা, বালি দ্বীপে বিভিন্ন রামায়ণী ব্যালে দেখি  বা ছায়া পুতুল নাটক দেখি, সেগুলির মধ্যে নানা প্রকার বৈচিত্র্যময় ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। আসলে হাজার হাজার বছর আগের একটি মূল কাব্যগ্রন্থ ,কত দেশ – কাল – পাত্রের পরিবর্তন পরিবর্ধন পরিমার্জন এর মধ্য দিয়ে বিস্তৃত হয়েছে ,কত কবি-সাহিত্যিকের কলমে স্পর্শে নব নব রূপ ধারণ করেছে , যা এই সাহিত্যের এক আশ্চর্য রহস্য।
জাভা- বালিদ্বীপে রামায়ণ কাব্যের যে সম্প্রসারণ আমরা দেখি , তা যখন কোন দেশের সভ্যতার অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হয়, তখন কতগুলি বিষয় অবধারিতভাবে উঠে আসে ― সেখানে সাহিত্যিকদের প্রভাব, তার সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক , লৌকিক, ধর্মীয় আচরণ এবং সকল প্রকার শিল্পকলার মধ্যে দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে তাদের প্রভাব চিত্তাকর্ষক বিষয়।
ইন্দোনেশিয়াতে আজও বৈদিক সনাতনী সভ্যতার সজীব প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় । বালিদ্বীপে সনাতনী সংখ্যা ৮৭ শতাংশ এবং সেই ৮৭ শতাংশ অধিবাসী আজও সযত্নে রক্ষা করে চলেছেন সনাতনী ঐতিহ্য ,  ভাবধারাকে। 

 ভারতবর্ষ যেমন দীর্ঘ ৪০০ বছর অধীনে ছিল ইন্দোনেশিয়াও মাজাপহিত বংশের পতনের পর দীর্ঘ ৪০০ বছরের অধিক সময়। পরাধীনতার গ্লানি ভোগ করেছিল। যদিও সনাতনী ইন্দোনেশিয়ার ম্লেচ্ছদের হাত হতে এখনো মুক্তি হয় নি। যাই হোক, ১৭০০০ দ্বীপ সমন্বিত এই দেশটি ওলন্দাজ বা ডাচদের অধীনে ছিল দীর্ঘকাল। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা প্রথম পদার্পণ করে এখানে । পর্তুগীজদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইন্দোনেশিয়ার উর্বর ভূমিতে যে প্রচুর শস্যসম্পদ উৎপন্ন হয় সেখান থেকে মুনাফা লাভ করা।  ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে এখানে ডাচরা নিজেদের অধিকার কায়েম করে এবং ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থাপনা করে । এই ঘটনার মাধ্যমে দিয়েই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ইউরোপিয়ান শাসনব্যবস্থা সরাসরি কুক্ষিগত করে ইন্দোনেশিয়াতে । 


এরপর ইন্দোনেশিয়া জাপান অধীনস্থ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। জাপান শাসকের দণ্ড ধরলে, ডাচরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মিত্র শক্তির হাতে অক্ষশক্তি পরাজিত হলে জাপান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আগস্ট মাসে জাপানের আত্মসমর্পণের দুদিন পর ইন্দোনেশিয়া তাদের প্রথম স্বাধীন দেশের নেতা হিসাবে সুকর্ণকে পান। তিনি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এতসবের পরেও ডাচ রা পুনরায় ইন্দোনেশিয়াকে অধিকার করতে চায়। কারণ ইন্দোনেশিয়ার শস্য সম্পদ, মশলা তাদের মুনাফার অন্যতম বিষয় ছিল। ফলত, ইন্দোনেশিয়া বাসীর সঙ্গে ডাচদের একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হয়। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে বর্হিবিশ্বের চাপে পড়ে ডাচ সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে ইন্দোনেশিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে মেনে নেয়। 
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. রামায়ণ – দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পদচিহ্ন
২. Ramayana–An Instrument of Historical Contact and Cultural Transmission between India and Asia
৩. 1971.Traces of an Old Sundanese Ramayana Tradition in Indonesia

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.