শ্রীঅরবিন্দ তাঁর মা বইটিতে শ্ৰীমায়ের চারটি বিশেষ মাতৃরূপের বর্ণনা করেছেন। এর বাইরে রয়েছে প্রাত্যহিক বা দৈনন্দিনের মায়ের বিশেষ বিশেষ রূপ। যারা মাকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা তাঁর সেই দৈনন্দিনের মহিমান্বিত রূপ দর্শন করেছেন। জগৎ আগেও বাস্তবের এমন দেবীরূপ দেখেনি, ভবিষ্যতেও সম্ভবত এ জগৎ আর তা প্রত্যক্ষ করবে না। যে জননী দেবী রূপে পূজিত তাঁর লীলা যে খেলার মাঠ পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে জগতের কোনও দেবীমাহাত্ম্য বা দর্শন গ্রন্থ বােধহয় এর আভাষ দিতে পারেনি।

অন্যান্য গতানুগতিক আশ্রমের প্রকৃতির থেকে শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম তার সৃষ্টিমুহূর্ত থেকেই স্বতন্ত্র। জীবনের কোনও প্রয়ােজনই এখানে ব্রাত্য নয়। যে নতুন জীবনের অঙ্গীকার শ্রীঅরবিন্দ ও মায়ের আহ্বানে উঠে এসেছিল, তার মধ্যে বিশেষ একটি দৃঢ় স্থান অধিকার করে আছে শারীর শিক্ষার কর্মসূচি। আর এর ফলেই এই আশ্রম পৃথিবীর মধ্যে এক ব্যতিক্রম যেখানে খেলাধুলাে বা শরীর চর্চা যােগসাধনার একটি প্রধান অঙ্গ। তাই শ্রীঅরবিন্দকে বলতে শুনি

“A total perfection is the ultimate aim which we set before us, for our ideal is the Divine Life.”

“That cannot be unless the body too undergoes a transformation.”

আশ্রমের সঙ্গে যাদের নিত্য যােগাযােগ তারা জানেন যে আশ্রমে প্রায় সব ধরনের খেলাধুলােয় চরম উৎকর্ষ লাভ করা যায়। আমাদের আলােচনা সে বিষয়ে নয়। আমরা আজ ভাবতে বসেছি মায়ের নিজের খেলার বিষয় নিয়ে। মা টেনিস খেলাটিকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব খেলা হিসাবে। এটি ইউরােপের ও ইংল্যান্ডের একটি পুরনো খেলা। কার্যকারণ ছাড়া এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে মা খুব সচেতন ভাবেই এই খেলাটিকে বেছে নিয়েছিলেন। এই খেলাটির বিভিন্ন বিশেষত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মায়ের এই পছন্দের কার্যকারণ। এই একটি খেলা যেখানে খেলা শুরু হয় ‘Love All’ এই কথাটি দিয়ে—যা শ্রীঅরবিন্দ ও মায়ের যােগের মূল ভাবনার প্রতিধ্বনি (সঙ্গের ছবি দ্রষ্টব্য)। এত খেলা থাকতে মা তাই টেনিসকে বেছে নিয়েছিলেন যােগের পথে তাঁর দেহের শ্রেষ্ঠ প্রস্তুতির হাতিয়ার হিসেবে। এই খেলায় শূন্য বলে কিছু নেই। শূন্যকে এখানে ডাকা হয় বা বলা হয় ‘Love’। এটাই এই খেলার প্রধান বিশেষত্ব।

মা টেনিস খেলা শুরু করেছিলেন ফ্রান্সে তখন তার বয়স অনেক কম। কম বয়সে টেনিস খেলার যে ছবিটি পাওয়া যায় তখন তার বয়স ৩৪ (ছবি দ্রষ্টব্য)-সালটা ছিল ১৯১২। মা ছােটো বেলা থেকেই টেনিস খেলতেন—আর সেই খেলা চালিয়ে গেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। প্ৰণব কুমার ভট্টাচার্য বা ‘দাদা’ এ বিষয়ে লিখেছেন, “Then we got the Tennis Ground in 1948 and our physical eduation programme got widened. Mother started playing tennis every day. At 4 pm she came out from Ashram main Building to go for her tennis.”। মার দৈনন্দিন জীবনে এই খেলা জড়িয়ে গিয়েছিল ওতপ্রোতভাবে, বয়স তাঁর কাছে কখনাও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই খেলা Singles এবং Doubles—দুভাবেই খেলা যায়। মার doubles-এর partner ছিলেন প্রণবদা ( লক্ষণীয়, করবেন প্রণবদার বা নিজের জন্মদিনেও মা টেনিসকে ছুটি দেননি)। খেলার point গােনাটাও সেই Love শব্দটি দিয়ে অর্থাৎ 15-Love, 30Love ইত্যাদি, অর্থাৎ শূন্য বলে কিছু নেই। শূন্য সব সময় রূপান্তরিত হয়েছে Love-এ। মা খেলার ছলে আমাদের ‘Love All’-এর মন্ত্রে দীক্ষিত করে দিয়ে গেছেন।

পাঠক ভাবতে পারেন এই Love শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে। এ বিষয়ে মতান্তর থাকলেও সর্বজনগ্রাহ্য যে ভাবনাটি গ্রহণীয় তা হল এই যে, ‘Love’ শব্দটির উৎপত্তি ফরাসি শব্দ egg (l’ouef) থেকে কেননা ডিম বা egg দেখতে অনেকটা শূন্যের মতাে। এ যেন অনেকটা ক্রিকেটের Duck’-এর মতাে। শূন্য রানে Batsman out হয়ে গেলে Duck বলা হয় যেহেতু duck’s egg-ও অনেকটা শূন্যের মতাে। কেউ কেউ বলেন এর উৎপত্তি ফরাসি শব্দ (Theure) ‘the hour’ থেকে ইত্যাদি। যাই হােক এর উৎপত্তি যে মায়ের দেশ ফ্রান্সে তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই।

আশ্রমের বিভিন্ন physical education programme-এ মা সানন্দে যােগদান করেছেন—সাহায্য করেছেন। সক্রিয় ভাবে—তা সে ভলিবল হােক, কুস্তি হােক, বক্সিং হােক, হাই জাম্প, লং জাম্প আরও কত কী। কিন্তু নিজে মাঠে নেমে শুধু সমর্থনই জানাননি, তাঁর যােগের শক্তি প্রয়ােগ করেছেন বিশেষ ভাবে – “I put out my force to support her as in all the other work of the Ashram…”, খেলার জগতে ‘Sportsman spirit’ বলে একটি কথা চালু আছে অর্থাৎ যে spirit একজন সত্যিকারের Sportsman-এর পক্ষেই দেখানাে সম্ভব। কী সেই Sportsman Spirit? শ্রীঅরবিন্দ তার একটি অপূর্ব ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন :

“…invaluable result of these activities (sports and physical exercises) is the growth of what has been called the sporting spirit. That includes good humour and tolerance and consideration for all, a right attitude and friendliness to competitors and rivals, self-control and observance of the laws of the game, fair play and avoidance of the use or foul means, an equal acceptance of victory or defeat without bad humour, resentment or ill-will towards successful competitors, loyal acceptance of the decisions of the appointed judge, umpire or referee. These qualities have their value for life in general and not only for sport, but the help that sport can give to their development is direct and….

এটুকু বলেই শ্রীঅরবিন্দ থেমে থাকেননি—সেই spirit কে জীবনের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য আরও লিখেছেন,

“…there is no a priority ground why sports should be excluded from life of an Ashram like ours where we are trying to equate life with the Spirit.”

শ্ৰীমা শ্রীঅরবিন্দের এই বক্তব্যের সমর্থনে তাঁর নিজের কথায় যেন এই বাণীর পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, “when one plays tennis or basketball, how does one do that (offering to the Divine) as an offering ? মা যেন শ্রীঅরবিন্দের কথার প্রতিধ্বনি করেছিলেন, “It means that what you do should not be done with a personal, egoistic aim, for success, for glory, for gain, for material profit or out of vanity, but as a service and an offering, in order to become more conscious of the divine will and to give oneself more entirely to it, until one has made enough progress to know and feel that it is the Divine who acts in you, His force that animates you and His will that supports you—not only a mental knowledge, but the sincerity of a state of consciousness and the power of a living experience.

For that to be possible, all egoistic motives and all egoistic reactions must disappear.”

পারিবারিকভাবে আমি এই খেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছি আমার কৈশাের থেকেই। টেনিসের প্রতি মায়ের পক্ষপাতিত্ব এই খেলার প্রতি আমাদের দুর্বলতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আজ শুধু ফ্ৰান্স (French Open), অস্ট্রেলিয়া (Australian Open), আমেরিকা (U.S. Open) ইংল্যান্ডের (Davis Cup) নয়, ভারতবর্ষে, বিশেষ করে এই বাংলায়ও, এই খেলা বিশেষ জনপ্রিয়। সময়ের নির্ঘণ্ট অনুযায়ী বিদেশের বেশীরভাগ টেনিস টুর্নামেন্ট হয় ভারতীয় সময় অনুযায়ী মাঝরাতে। মা’র ছবির সামনেই টিভির পর্দায় সেইসব খেলা যখন সুগভীর ব্যঞ্জনা, সুসামঞ্জস্য, দৈহিক পটুতা, খেলােয়াড় সুলভ মনােভাবের মধ্যে দিয়ে গভীর উত্তেজনায় পূর্ণ হয়ে ওঠে তখন মনে হয় মা’ও এই খেলার একজন দর্শক—একজন অংশীদার, যার ডান হাতে একদিন উঠে এসেছিল এই খেলার racket আর বাঁ হাতে উঠে এসেছিল বল—যিনি একদিন নিজেই এই পৃথিবীর বুকে এই খেলাকে উপলক্ষ করে আমাদের শিখিয়েছিলেন জীবনে Love All-এর গুরুত্ব।

মায়ের এর LOVE ALL এর যোগসূত্র আজও সমান ভাবে অব্যাহত। শ্রী অরবিন্দ আশ্রম থেকে মায়ের প্রতিনিধি হিসাবে যিনি চিঠি পত্রের উত্তর দেন সেই সব চিঠির শেষে একটি কথাই লেখা থাকে “In Her love”। মায়ের ভালোবাসা তাই আজ একই ভাবে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।

টেনিস এমন একটি খেলা যার সত্যিই অনেকগুলি বিশেষত্ব আছে। এটি এমন একটি খেলা যেখানে দুপক্ষের মধ্যে draw হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। খেলার নিয়ম অনুযায়ী এক পক্ষ জয়ী হবেই। মা নিজে এই খেলার মাঠে নেমে সকলের সঙ্গে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বােধহয় জীবনের চলার পথে আমাদের জয়ী হবার জন্য এগিয়ে দিয়ে গেছেন। মা নিজে এই খেলায় আমাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু আমরা নিৰ্ভয়ে এগিয়ে চলেছি, কেননা এ খেলায় মা আমাদের কাছে পরাজিত হতেই ভালবাসেন। তাই সবসময় জয়ের বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। মা আমাদের জয়ী হিসেবে দেখতে চান। যে racket দিয়ে মা খেলতেন, যে racket দিয়ে মা টেনিসের বল কোর্টের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত আদান প্রদান করেছেন—সেই racket আজও মায়ের প্রতিনিধিত্বের চিহ্নস্বরূপ রক্ষিত হয়ে আছে। হস্তাক্ষরে নয়—কিন্তু সেই racket-এর গায়ে বিশ্ববাসীর জন্য মায়ের একটিমাত্র বাণী স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে আছে—যা মাত্র দুটি ইংরেজি শব্দের সম্মিলন Love All–মায়ের যােগ যে শুধু ভালবাসার কথাই বলে।

বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.