রাজ্য সরকারের হাজারো দোষ ঢাকতেই কি করোনা তথ্য গোপন?

সংক্রমণের আসল হিসেব বেরিয়ে পড়লে, সরকারের ব্যর্থতা প্রকাশ্যে চলে আসতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই তথ্য গোপনের বিষয়টা আসতে পারে বলে মনে করছে বিরোধী রাজনৈতিক মহলের একাংশ। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর দোহাই দিয়ে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলকে আটকানোর চেষ্টাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। আমাদের রাজ্যে কতজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত, সেই তথ্য জানার অধিকার কী সাধারণ মানুষের আছে? হয়তো ভাববেন, কেন থাকবে না? সব রাজ্যের তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে? তাহলে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? করোনা নিয়ে একটি আপডেট ডেটা পাবার জন্য, অনেকগুলি অ্যাপ এখন হাতের কাছে আছে, সেগুলির সবই পশ্চিমবঙ্গের সঠিক তথ্য দিতে পারছে না। এই তথ্য জানা যাচ্ছে না একটি মাত্র কারণে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অলিখিত করোনার তথ্যের ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা ঘোষণায়। আর এই বিষয়ে যে তথ্য রাজ্য সরকারের তরফে দেওয়া হবে সেটাকেই আসল তথ্য হিসাবে প্রকাশ করতে হবে। এমনটাই নিদান দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।

বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ও তথ্য গোপন নিয়ে একযোগে সরব হয়েছে সরকার বিরোধী সব কটি দল। তবে সব থেকে সরব বিজেপি। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে বলেছেন যে এই তথ্য গোপনর ক্ষেত্রে আগের বামেদের সঙ্গে বর্তমান তৃণমূলের মিল এক জায়গায়।নন্দীগ্রামে সেই সময় যেমন সিপিএম লাশ গায়েব করেছিল, এখন করোনায় সেভাবেই লাশ গায়েব করছে তৃণমূল। এই কথাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক চরমে উঠেছে। রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে। বিজেপি সাংসদ আগেও সরব হয়েছিলেন করোনা আক্রান্তের সঠিক তথ্য না দেবার বিষয়ে অভিযোগ তুলে। এক সঙ্গে একই বিষয়ে সরব বাম ও কংগ্রেস। দিলীপ ঘোষ বলেন, রাজ্য যে তথ্য সামনে এনেছে, তার থেকে অন্তত চারগুণ মানুষ আক্রান্ত। এই বিষয়ে প্রশাসনের তরফে ভয়। দেখিয়ে ডাক্তার ,হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, পুলিশপ্রশাসনের মুখ বন্ধ রাখা হয়েছে। এমনকী সংবাদমাধ্যমেরও কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। অন্যদিকে মৃত্যুর সার্টিফিকেট দেবার ব্যাপারেও নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যেমনটি এর আগে ডেঙ্গু আক্রান্তে মৃত্যুর বিষয়ে আরোপ করা হয়েছিল।

কেন তথ্য গোপন করার এই খেলায় নেমেছে প্রশাসন? সাধারণ মানুষের বক্তব্য, এই তথ্য গোপনের ফলে পরিস্থিতির অবনতি বা উন্নতির সঠিক তথ্যটাই প্রকাশ হচ্ছে না। আর সেই কারণে, এই মারণ ভাইরাসকে কীভাবে আটকানো যাবে, সেই গেম প্ল্যান ঠিক করাও যাবেনা। কোথায় এই রোগের সংক্রমণ বেশি, আর কোথায় কম? সেই তথ্য চেপে যাওয়ার ফলে, সাধারণ মানুষ অজান্তেই মৃত্যু পরোয়ানা সই করে ফেলছেন, এমনটাও ভেবে ভয় পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

তথ্য গোপনের অভিযোগ আরও দানা বেঁধেছে, যখন রাজ্যের নানা জায়গা থেকে এই করোনা নিয়ে নানা অভিযোগ উঠছে। যেমন, হাতে কিট থাকা সত্ত্বেও করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে সামান্য। নাইসেডের তরফেই এই অভিযোগ করা হয়েছে। অথচ কোয়েরেন্টাইনে থাকা মানুষজনের হিসেব ও তাদের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করার যদি মিল করানো হয়, এই হিসেব মিলবে না।

গত ১৭ এপ্রিল, সাড়ে তিনটায় বামনেতা ও বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী তার সোশ্যাল মিডিয়া পেজে হাওড়া জেলার সাতটি করোনাজনিত কারণে মৃত্যুর বিষয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করে বলেন, এই সাতের মধ্যে মাত্র তিনটির হিসেব তালিকায় স্থান পেয়েছে। বাকি চারটি গেল কোথায়?

কেন এই তথ্য গোপনের খেলা?

১। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের গরিমা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মাঝে মাঝেই নানা কথা বলেন। কিন্তু তার এই বিষয়টা কতটা যে ঠুনকো, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের পরিকাঠামো ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি গলা ফাটান, সেই পরিকাঠামো বলে যে কিছুই নেই সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে, আর ঢাল তলোয়ার হীন সীমিত ক্ষমতার চিকিৎসা পরিকাঠামোর কারণে আমাদের রাজ্যে সংক্রমণ যে ঊর্ধ্বগতি সম্পন্ন হয়ে উঠেছে সেটা প্রমাণিত হয়ে যাবে।

২। করোনা নিয়ে যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী সব রাজ্যকে সাবধান করলেন, তখন তিনি এড়িয়ে গেলেন। বললেন সিএএ বা এনসিআর নিয়ে সারা দেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার থেকে চোখ ঘোরাতেই এই করোনাকে সামনে আনা। পরে যে এটা ভুল, সেটা প্রমাণিত যখন হলো, আর মুখ্যমন্ত্রী যখন বুঝতে পারলেন যে তিনি রাজনীতি করতে গিয়ে বিষয়টাতে গুরুত্ব নিয়ে বড় দেরি হয়ে গেছে, সেই ভুল ঢাকতে তিনি তথ্য ঢাকার বিষয়টাতে মন দিতে শুরু করলেন। ততদিনে যা হবার তাই হয়ে গেছে। সংক্রমণের থাবা আঘাত করেছে আমাদের সাধারণ মানুষকে।

৩। প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাব, আর কেন্দ্রের ঘাড়ে দোষ চাপানোর রাজনীতির খেলা খেলতে গিয়েও তিনি লেজেগোবরে হয়ে গেলেন। করোনা পরীক্ষা করাবার মতো পর্যাপ্তকিট নেই, সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্র পাঠিয়ে দিল। টাকার অভাব, পাওনা টাকা চাইলেন, সেটাও সামান্য হলেও এই পরিস্থিতিতে মিটিয়ে দিল কেন্দ্র। এছাড়াও করোনা পরিস্থিতি সামালাবার জন্য পরিকাঠামোর প্রয়োজনে সব রকম সাহায্য করতে শুরু করে দিল। ফলে যা হবার তাই হলো, এবার কী করবেন তিনি? সংক্রমণের আসল হিসেব বেরিয়ে পড়লে, সরকারের ব্যর্থতা প্রকাশ্যে চলে আসতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেই তথ্য গোপনের বিষয়টা আসতে পারে বলে মনে করছে বিরোধী রাজনৈতিক মহলের একাংশ।

৪। এদিকে সারা দেশের কাছে নিজের একটা ভাবমূর্তি তৈরির লক্ষ্যে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে মমতা সরকার একটা মাইলস্টোন তৈরি করেছে, সেটাকে প্রমাণ করার লক্ষ্যেই তথ্য চেপে যাবার প্রবণতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছে একটি মহল।

৫। এদিকে বারে বারে লকডাউন না মানার তালিকায় শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকায় বেশ কিছু সংখ্যালঘু অঞ্চলের নাম উঠে এসেছে বিশেষ করে কলকাতার। সেখানে ইতিমধ্যেই সংক্রমণের মাত্রাটা কেমন, সেটা নিয়ে চিন্তিত কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক থেকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক, আলাদা করে রাজ্য সরকারকে ওই অঞ্চলগুলিতে লকডাউন মানতে বাধ্য করার জন্য একটি নির্দেশিকা দিতে বাধ্য হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। ফলে এই ক্ষেত্রেও সঠিক তথ্য সামনে আসলে, সেটি যে খুব একটা সুখকর হবে না সেটাও জানে প্রশাসন। তাই চেপে যাওয়াটাই সঠিক পথ, এমনটাই মনে করছেন অনেকে।

এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মুখে বলছেন এক আর কাজে করছেন আর এক। তিনি প্রচারের আলোয় সব সময় থাকবেন বলে, কখনও রাস্তায় দাগ কাটছেন, কখন রেশন দোকানে হানা দিচ্ছেন। সঙ্গে ঘুরছে এক ঝাক স্তাবক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি ও তার উল্টোদিকে থাকা সাধারণ মানুষগুলি। তারা কতটা সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মানছেন সেটা যারা লাইভ দেখেছেন তার অভিযানগুলি, তারা বলতেই পারবেন। রেডজোন ভবানীপুরে রেশন দোকানে অভিযানের দিন যারা দেখেছেন, তারা বলতেই পারবেন। এখান থেকেও তো ছড়াতে পারে সংক্রমণ, সেটা কী মুখ্যমন্ত্রী জানেন না? হয়তো জানেন। তবুও জেনে শুনেও মানুষের পাশে। শুধু নিজেকে প্রচারের আলোয় রাখার জন্য। বাকি সব গৌণ।

বিশ্বপ্রিয় দাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.