মহালয়ার দিন থেকে পুজো শুরু হয়ে যেত

দুর্গা পুজোর আনন্দ শুরু হতাে জামা কাপড় কেনা থেকে পুজোর শেষে যাত্রানুষ্ঠান দেখা পর্যন্ত। ছােটোবেলায় মা আমাকে মঙ্গলা হাটে জামা, প্যান্ট কিনতে নিয়ে যেত। আমাদের ভাই-বােনেদের জামা কাপড় কেনা, দুর্গাঠাকুরের শাড়ি, বালিশের ওয়াড়, বিছানার চাদর, গামছা, বাবার ধুতি সব ঘুরে ঘুরে মঙ্গলাহাট থেকে কেনার স্মৃতি আজও আমার বেশ মনে পড়ে। ছােটোবেলায় আমার বড়দির একটা ঘটনা আমার এখনও মনে পড়ে;বড়দি একটা পিওর সিল্ক শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য জেঠর কাছে বায়না করেছিল। জেঠু আমাদের ভাই-বােনদের জুতাে দিতাে তাই আলাদা ভাবে বড়দিকে শাড়ি কিনে দিতে চায়নি। কিন্তু বড়দি মাটিতে শুয়ে পড়ে কান্নাকাটি করে যেভাবে জেঠুর কাছ থেকে পিওর সিল্ক শাড়ি আদায় করেছিল তা এখনও আমার বেশ মনে পড়ে। আমরা সবাই বাবার সঙ্গে হাওড়া শিবপুরে পাঞ্জাব টেনারি বা ভারত টেনারিতে জুতাে কিনতে যেতাম। জুতাে কেনা হয়ে যাওয়ার পর প্রত্যেককে দুটো করে বেলুন দিত। বেলুন ফুলিয়ে বড়াে করা আর বেলুনের গন্ধ আজও আমার মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। আমাদের তখন মহালয়ার দিন থেকেই পুজো শুরু হয়ে যেত। মহালয়ার দিন খুব ভােরে উঠতে হবে বলে আগের দিন রাত্রিতে তাড়াতাড়ি খেয়ে আমরা শুয়ে পড়তাম। জেঠুর ঘরে একটা বুশ কোম্পানির ইলেক্ট্রিক রেডিও থাকতাে। সেই রেডিওতে আমরা মহালয়া শুনতাম। ভাের ৪টায় গুরুগম্ভীর গলায় চণ্ডীপাঠ তার মাঝে মাঝে কিংবদন্তী সেই গানগুলাে যা আজও একভাবে শুনি। কিন্তু এখন মহালয়া শােনা আর ছােটোবেলায় মহালয়া শােনার মধ্যে তাফাত অনেক। ছােটোবেলায় মহালয়া শােনার পর আমরা বন্ধুদের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলতাম। একজন চোর হতাে আর আমরা সবাই কোনাে পাঁচিলের কোণে, পুকুরের ধারে গাছের আড়ালে লুকোতাম। যে প্রথম ধরা পড়ত সে আবার চোর হতাে। সেই খেলায় মজাই ছিল আলাদা। সেইদিন থেকেই গুলি খেলা, খেলনা পিস্তলে ক্যাপ ফাটানাে শুরু হয়ে যেত।
আমাদের স্কুল ছুটি পড়তে চতুর্থীর দিন প্রথম ক্লাস হয়ে। সেইদিন স্কুলে টিচারকে আমরা টিফিনের জমানাে পয়সা দিয়ে মিষ্টি খাওয়াতাম।
পঞ্চমীর দিন ভােরে আমাদের প্যান্ডেলে দুর্গাঠাকুর আসতাে। তাই ভাের হতেই দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, মহিষাসুর, সিংহ কেমন হয়েছে দেখার জন্য পাড়ার প্যান্ডেলে চলে যেতাম। ষষ্টির দিন সন্ধ্যেবেলা ঠাকুরকে গয়না এবং অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত করা হতাে। আমি খুব ছােটোবেলা । থেকেই সঙ্ঘের শাখায় যাই। সেই সময় আমাদের শাখায় মূখ্য শিক্ষক ছিল সঞ্জিতদা। ষষ্ঠী থেকে আমাদের শাখা সকাল ৬টা থেকে ৭টা হতাে। সকালে কবাডি খেলার মজাই ছিল আলাদা। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিন দিনই পুজো এবং পুস্পাঞ্জলি দিতাম। বিকালবেলায় দাদার সঙ্গে হাওড়ার ১ কদমতলায় ঠাকুর দেখতে যেতাম। কদমতলায় খুব সুন্দর সুন্দর ঠাকুর হয়। অন্নপূর্ণা ব্যয়াম সমিতি, জাতীয় সেবাদল, উত্তর খুরুট বারােয়ারি ও বেলিলিয়াস রােডের ঠাকুরগুলাে দেখে রাত্রিবেলায় বাড়ি ফিরতাম। দশমীর দিন সকালে আমার মায়ের মামার বাড়িতে (ষষ্ঠীতলায় ডাক্তার বাড়ি) পুস্পাঞ্জলি দেওয়ার কথা খুব মনে পড়ে। একটা বড়াে পুস্পাঞ্জলি মন্ত্র বলা হতাে আর একচালার মা দুর্গাকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে মায়ের পায়ে পুস্পাঞ্জলি দিতাম। দশমীর দিন বিকালে পাড়ার ঠাকুরের সঙ্গে লরীতে বসে লজেন্স খেতে খেতে বলাে দুগ্না মাই কী—জয় আসছে বছর—আবার হবে। সবাইয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে বলতে গঙ্গায় ঠাকুর বিসর্জন তারপর লরিতে একসঙ্গে পাড়ায় এসে শান্তির জল এবং বোঁদে খাওয়া ছােটোবেলা থেকে এখনও করে আসছি। ছােটোবেলায় ঠাকুরের নির্দেশে আমরা সবাই কাগজের পাতায় ‘শ্রীশ্রী দুর্গামাতার সহায়’ ১০৮ বার লিখতাম। তারপর ঠাকুর ঘরে সমস্ত দেবতাদের প্রণাম করে গুরুজনদের প্রণাম করতাম। পাড়ায় গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি করা। কাকামণির বাড়ি, জেঠিমার বাড়ি গিয়ে প্রণাম করা গজা, নিমকি, ঘুগনি, মিহিদানা সন্দেশ খাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা। ছােটোবেলায় আমাদের পাড়ায় পুজোর শেষে যাত্রাপালা হতাে। কমলে কামিনী। যাত্রার কথা আজও মনে পড়ে। ঝং করে বাজনার আওয়াজ দিয়ে যাত্রা শুরু হতাে। যাত্রায় গান, সংলাপ, অভিনয়, কমলে কামিনী দর্শন আজও ভুলতে পারি না।
সঞ্জয় মুখােপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.