পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর সরকার যেভাবে মহামারী করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করেছেন তার বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। তথ্য লুকনোর কারণে তারা বিরোধী দল ও সমালোচকদের দ্বারা অভিযুক্ত হয়েছেন। বিরোধীরা অভিযোগ এনেছেন যে কোভিড-১৯ সংকটকালে মমতা তোষণের রাজনীতিকে কাজে লাগিয়েছেন। কোভিড-১৯ আক্রমণের সময়ে তবলিগি জামাতের ধর্মীয় সমাবেশে যারা যোগ দিয়েছিল তাদের মধ্যে ৫৪ জন ব্যক্তিকে ইতিমধ্যেই সনাক্ত করা হয়েছে বলে ১ এপ্রিল শ্রীমতী ব্যানার্জি দাবি করেছিলেন। তিনি এও জানিয়েছিলেন যে তাদের মধ্যে ৪৪ জন বিদেশি। কিন্তু কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার বিবরণ অনুযায়ী দিল্লির জামাতের অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২৩২ জন তবলিগি যোগদান করেছিলেন। তার মধ্যে ১২৩ জন ভারতীয় ও ১০৯ জন বিদেশি। শীঘ্রই তিনি এ বিষয়ে জোর দিয়ে জানান যে নিজামুদ্দিন এলাকাকে হটস্পট ঘোষণা করার পর তাঁর সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু সেখানে লকডাউন সত্ত্বেও প্রায় ২৩০০ জন লোক থাকছিল অথচ তিনি জানান যে সরকার ১০৮ জন বিদেশি-সহ ১৭৭ জনকে কোয়ারান্টাইন করেছে, যারা নিজামুদ্দিন মরকজে তবলিগি জামাতের সমাবেশে যোগ দিয়েছিল। তার দেওয়া বিভিন্ন সময়ের তথ্যের মধ্যে প্রচুর গরমিল আছে এবং তা কেন্দ্রীয় সরকার বা দিল্লি সরকারের দেওয়া তথ্যের থেকেও আলাদা। জাতীয় কলেরা ও আন্ত্রিক রোগ সংস্থা (নাইসেড)-র কাছে পরীক্ষার জন্য যথেষ্টনমুনা পাঠাচ্ছে না বলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে। অবশ্য নাইসেডের সঙ্গে কথা বলায় পরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।
পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসক ফোরামের তরফে কোভিড-১৯-এর ব্যাপারে স্বচ্ছতা আনতে যথার্থ ও যাচাইযোগ্য তথ্য সরবরাহ করতে সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।নাহলে চিকিৎসকদের তরফে জনগণের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছেবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুর সংজ্ঞা নির্ধারণে যে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তা পৃথিবীর আর কোথাও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। যাঁরা করোনায় মারা গেছেন কিন্তু কো-মবিডিটি ছিল তাদের করোনায় মৃত বলে ধরা যাবে না। এটা নিশ্চিত করার জন্য একটা এতাবৎকাল অশ্রুত ‘অডিট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটিতে ছিলেন সরকারের আজ্ঞাবহ কিছু চিকিৎসক ও আমলা। কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু চিহ্নিতকরণের জন্য এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফোরাম তীব্র আপত্তি তোলে। ফোরামের মুখপাত্র জানান যে প্রত্যেক চিকিৎসক এ ব্যাপারে যথেষ্ট যোগ্য এবং এই শংসাপত্রের জন্য কোনো কমিটির প্রয়োজন নেই। ২০২০-র ২৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বীকার করে যে ৫৭ জন কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু হয়েছে কিন্তু তাদের মধ্যে ৩৯ জনের কো-মবিডিটির কারণে মৃত্যু হয়েছে। ফোরাম আরও জানিয়েছিল যে চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল ও এমআর বাঙ্গুর হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগীরা ৫ দিনের উপর অপেক্ষা করছেন। এর মারাত্মক ফল হলো, কিছু রোগী প্রথমে নেগেটিভ ছিল কিন্তু কোভিড-১৯ পরীক্ষার ফল জানার জন্য হাসপাতালে দীর্ঘকাল থাকার ফলে তারা আক্রান্তও হতে পারেন বা হয়েছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রী এক সময়ে রাজ্যবাসীকে বললেন করোনাকে পাশবালিশ করে ঘুমোতে। এইরকম শিশুসুলভ আরও অনেক কথা বলতে তিনি অভ্যস্ত। কিন্তু গত ৮ জুলাই তিনি আবার ৩১ জুলাই পর্যন্ত অঞ্চল ভিত্তিক লকডাউন ঘোষণা করলেন। ৩০ জুন পর্যন্ত আগেই ছিল। তার আগে দেখে নিই রাজ্যে করোনার হাল কিরকম। একদিনে (৯ জুলাই) করোনা ভাইরাস থাবা বসিয়েছে ১১৯৮ জনেরশরীরে দৈনিক আক্রান্তের নিরিখে যা সর্বাধিক। একই সঙ্গে বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও, একদিনে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ হাজার পেরিয়েছে। মোট মৃত্যু হয়েছে ৮৫৪ জনের। আক্রান্ত। আর মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। অ্যাক্টিভ কেস ৮২৩১। মোট সুস্থ হয়েছেন ১৬৮২৬ জন। এখনও পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৫ লক্ষ ২৭ হাজার ৮০৫ জনের। কনটেনমেন্ট জোনে আবার কড়া লকডাউন। ৯ জুলাই বিকেল ৫টা থেকে বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন। সরকারি দপ্তর চলবে ৭০ শতাংশ কর্মী নিয়ে। ভাগে ভাগে কাজ চলবে। মেট্রো ও শহরতলীর ট্রেন চলবে না। শপিং মল, রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ৮ জুন থেকে চালু হয়েছে। আনলক-১-এর অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে তা খুলে দেওয়ার কথা। পূজা, উপাসনাস্থল ও বেসরকারি অফিস খুলবে কম লোক নিয়ে। অর্থাৎ আংশিক লকডাউন চলবে আবার ছাড় যেমন চলছে তেমন চলবে। কনটেনমেন্ট জোনের চারপাশের বাফার জোন নিয়ে প্রশস্ততর কনটেনমেন্ট জোনে কড়াভাবে লকডাউন চলবে।
লকডাউন ঘোষণার তিন মাস বাদে যে সব রাজ্যের আর্থিক অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের সমান তাদের চেয়েও কোভিড-১৯ পরীক্ষার সংখ্যার নিরিখে এই রাজ্য পিছিয়ে। যেমন রাজস্থান, সেখানে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মোট কোভিড-পরীক্ষা হয়েছে ৫ লক্ষ আর এই রাজ্যে হয়েছে আড়াই লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের প্রাত্যহিক পরীক্ষার ক্ষমতা ৫০০০ নমুনা এবং রাজস্থানের ক্ষমতা ১২০০০ নমুনা। ১০টা সরকারি ও ৬টা বেসরকারি সব মিলিয়ে ১৬টা পরীক্ষাকেন্দ্র আছে এই রাজ্যে।
পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো অন্য অনেক রাজ্যের চেয়ে খারাপ। ৩৩টা বেসরকারি ও ৮০টা সরকারি হাসপাতাল কোভিড-১৯ রোগীর চিকিত্সা করছে। কিন্তু এই বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বেশিরভাগ কলকাতায় আর কিছুসল্ট লেকে অবস্থিত। হাওড়ায় দুটো। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ১৩৬৮ শয্যার মধ্যে এই মুহূর্তে মাত্র ১৯১টা খালি আছে। অথচ রাজ্যে সংক্রমণের হার ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। সরকারি হাসপাতালগুলিতে মোট শয্যার সংখ্যা ৭৭৩৭। প্রতিদিন যদি ১১০০-১২০০ করে আক্রান্ত হয় তাহলে দুদিন পরে লোককে রাস্তায় পড়ে মরতে হবে।
প্রথম পর্যায়ে পুলিশ খুব সুন্দরভাবে কড়া হাতে লকডাউনের নিয়ম ভঙ্গকারীদের কঠোর হাতে দমন করছিল কিন্তু যেই মুসলমানদের গায়ে হাত পড়ল মমতা ব্যানার্জি সেই পুলিশকে কড়া শাস্তি দিলেন, তাদের ক্লোজ করলেন। সেই বার্তা পৌঁছে গেল পুলিশের কাছে। তারা হাল ছেড়ে দিল। দেখা গেল মেটিয়াবুরুজ, পার্কসার্কাস, গার্ডেনরিচ, ট্যাংরা, রাজাবাজার প্রভৃতি মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে কেউ কোনো য়িম মানছে না। মাস্ক নেই, সামাজিক দুরত্ব বিধি পালন। নেই, যথেচ্ছ জমায়েত হচ্ছে। জুলাইয়ে নতুন লকডাউনে সেইসব এলাকা বাদ। এটা কিছুতেই সম্ভব নয় করোনার মতো বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ছড়ানো মারণ রোগের সঙ্গে লড়তে গিয়ে রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক যদি এমন নির্লজ্জ পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেন, তবে নিশ্চিতভাবে এক ভয়ংকর বিপদের মুখে পড়তে চলেছে রাজ্যবাসী।
২০১১ সালের আগে রাজ্যে অন্তত বেশ কিছু উচ্চমানের বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু উদ্ভট জমি আইন, চূড়ান্ত স্বজনপোষণ, ভ্রষ্টাচার, একনায়কতন্ত্র ও প্রচেষ্টার অভাবে গত প্রায় দশ বছরে রাজ্যে একটাও বড়ো উচ্চমানের হাসপাতাল তৈরি হয়নি। রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে ৭০০ জন ডাক্তার নিয়োগ হলে। ৪০০ জন ছেড়ে দেয় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ও বেসরকারি হাসপাতালে উন্নত সুযোগ সুবিধার কারণে। প্রায় অর্ধেকের উপর চিকিৎসকের পদ খালি, নার্সদের অবস্থাও অনুরূপ। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা কাজ করে না। হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিসিইউ নেই, ভেন্টিলেটর নেই। শুধু বাড়িগুলো নীল সাদা রং হয়েছে, তোরণ হয়েছে। করোনার শুরুতে ঘটা করে ঘোষণা করা হয়েছিল কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে ৪০০০ শয্যাবিশিষ্ট বিশেষ কোভিড হাসপাতাল করা হলো। সম্পূর্ণ মিথ্যা।
রাজ্যে স্বাস্থ্য বাজেট অবিলম্বে ২ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ করতে হবে। অনুৎপাদক খরচ—ক্লাবে টাকা দান, বিভিন্ন মেলা, বাণিজ্য সম্মেলন, চলচ্চিত্র উৎসব, কালচারাল অ্যামবাসাডর পোষা এসব বন্ধ করলেই তা সম্ভব। আর লকডাউন হতে হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সব অঞ্চলে এবং কঠোর হাতে তা পালন করার অধিকার পুলিশকে দিতে হবে।
সুদীপ নারায়ণ ঘোষ