করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ভারত এখন পর্যন্ত যথেষ্ট সফল এবং মোটামুটিভাবে নিরাপদ। আমেরিকা-সহ ইউরোপের বিভিন্ন প্রতাপশালী দেশসমূহ প্রধানমন্ত্রী মোদীর সহযোগিতা চেয়েছে, স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’খোদ বিশাল জনসংখ্যা বিশিষ্ট ভারতকে করোনা রোধের বলিষ্ঠ পদক্ষেপে বাহবা দিতে বাধ্য হয়েছে। ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ মানুষের করুণ অবস্থা সহজে বোধগম্য। কিন্তু জীবন থেকে সাময়িক সমস্যা কখনো বৃহত্তর হতে পারে না, সেটা দেশের আর্থিক ক্ষতিই হোক কিংবা ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে নিষেধাজ্ঞা। ভারতবর্ষ যখন করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সমস্ত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ভুলে। সমগ্র রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার একযোগে ঝাপিয়ে কাজ করছিল, ঠিক তখনই দিল্লির নিজামুদ্দিনে তবলিগি জামাতিদের ধর্মীয় সমাবেশে করোনা সংক্রমণে দেশের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারি সূত্রমতে দেশের মোট করোনা আক্রান্তের প্রায় ৩০ শতাংশই তবলিগি জামাতের সমাবেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল। তাছাড়াও দেশের ১৭টি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া আক্রান্তদের মধ্যে বিভিন্ন কোয়ারেন্টাইনের (নিভৃতবাস) প্রায় ২২ হাজার আক্রান্তদের সঙ্গে দিল্লির নিজামুদ্দিনের কোনো না কোনো যুগসূত্র ছিল। বিগত একটি সরকারি পরিসংখ্যানে তবলিগি জামাতের সমাবেশে যোগ দেওয়ার প্রায় ১০২৩ জন করোনায় আক্রান্ত চিহ্নিত হয়েছে। দেশের ২৪টি রাজ্যে এবং ৪টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে দিল্লির জমায়েতে উপস্থিত তবলিগিদের খোঁজেচিরুনি তল্লাশি চলছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বক্তব্যনুযায়ী প্রতি ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে যার অন্যতম কারণ তনলিগ-ই-জমায়েত। লকডাউন অন্তের কোনো ইঙ্গিতই দৃশ্যমান নয়, কারণ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের তবলিগরা দিল্লির সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিল তাদের অনেকে আত্মগোপন করে আছে এবং তাদের সংস্পর্শে রোজ নতুন করে আরও অনেক আক্রান্ত হচ্ছে। তামিলনাড়ুতে করোনা পজিটিভ ৩০৯ জনের ২৬৪ জনই তবলিগি সদস্য, মহারাষ্ট্রে দিল্লির ধর্মীয় সমাবেশে যোগ দেওয়া ১৪০০ জনের মধ্যে ১৩০০ জনকে চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টাইনে প্রেরণ করা হয়েছে এবং ১০০ জন এখনো পলাতক। দিল্লিতে মৃত ২ জন করোনা পজিটিভ দিল্লির সমাবেশে উপস্থিত ছিল এবং এখন পর্যন্ত সেখানের ২১৯ জন করোনায় পজিটিভ আক্রান্ত যাদের মধ্যে ১০৮ জনই তবলিগি জামাতি। তবে প্রতিদিন সেই সংখ্যার পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমাবস্থায় তেলেঙ্গানায় আক্রান্তের সংখ্যা ২০ ছিল, যাদের সবাই দিল্লির জমায়েতের হজির ছিল, অন্ধ্রপ্রদেশে ৮৭ জন করোনা পজিটিভ যাদের মধ্যে ৭০ জন তবলিগি। জম্মু-কাশ্মীরে ২৩ জন করোনা আক্রান্ত যাদের ১০ জন দিল্লির নিজামুদ্দিনে যোগ দিয়েছিল। ১৩ মার্চ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দূরন্ত এক্সপ্রেসের প্রতিটি ট্রেনে কয়েক হাজার জন যাত্রী দিল্লির নিজামুদ্দিনের সমাবেশে অংশ নিয়েছিল, এদের মধ্যে কর্ণাটক থেকে মাত্র ৩০০ জন, হরিয়ানায় ৫০৩ জন, মহারাষ্ট্র থেকে ৫৪ জন, গুজরাট থেকে ৭২ জন, পঞ্জাব থেকে ৯ জনকে রেল কর্তৃপক্ষ তবলিগি জমায়েতের অংশগ্রহণকারী সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে।
দেশের এই নির্মম পরিস্থিতিতে রাজনেতা থেকে শুরু করে ডাক্তার, পুলিশ, সেনা, নার্সসবাই নিজের জীবনকে বাজি রেখে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যখন করোনা আক্রান্ত কিছু তবলিগি দুবৃত্ত দেশের এই সেবকদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পরিবর্তে তাদের প্রতি অমর্যাদাপূর্ণ, অশ্লীল আচরণ করছে এবং এই দুবৃত্তদের অধিকাংশই দিল্লির নিজামুদ্দিনের জমায়েতের সদস্য। উত্তর-পূর্ব দিল্লির স্বাস্থ্য দপ্তরের অভিযোগ কোয়ারেন্টাইনে থাকা নিজামুদ্দিনের তবলিগিরা চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর থুতু ছোঁড়ে। একইভাবে গাজিয়াবাদের আইসোলেশনে ভর্তি তবলিগি জামাতরা হাতপাতালে নগ্ন হয়ে নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে অশালীন আচরই করে, এমনকী এই দুবৃত্তরা চিকিৎসাকর্মীদের নিকট নাকি বিড়ি-সিগারেটেরও দাবি রাখে। বিহারে দিল্লির নিজামুদ্দিনের অংশগ্রহণকারী তবলিগি জামাতদের খুঁজতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের তমলুকেও নিজামুদ্দিনে অংশগ্রহণকারী ২৫ বছরের এক যুবককে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে গেলে মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী-সহ গোটা টিমকে হেনস্থা করা হয়, গাড়ি ভাঙচুর করে চালককে মারধর করা হয়। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি অশালীন আচরণের জন্য এই তবলিগি জামাতদের বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে এফআইআর দায়ের করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আবার এই তবলিগিরা কানপুরের গণেশশঙ্কর মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের দিকে থুতু ছিটিয়েছে– অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
দিল্লির নিজামুদ্দিনের তবলিগি সমাবেশে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এবং রাজ্য সরকার। জমায়েতের উপস্থিত সাত মওলানার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে এফআইআর দায়ের করেছে দিল্লির পুলিশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকও ফরেনার্স অ্যাক্টের ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী বিদেশি তবলিগি জামাতিদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে, কারণ টুরিস্ট ভিসায় এসে কোনো ধর্মীয় প্রচারে অংশ নেওয়া যায় না। এই ধর্মীয় সমাবেশে যোগ দেওয়া ৬৭টি দেশের ৯৬০ জনের ভিসা বাতিল করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এবং স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে আগামীদিনে তবলিগ জামাত সম্পর্কিত কোনো সমাবেশের জন্য ভারত আর ভিসা দিবে না। বর্তমান ভারতে যে কটি করোনার নতুন সংক্রমণ হয়েছে তাদের অধিকাংশের সম্পর্ক ‘দিল্লির নিজামুদ্দিন’। জামাতে অংশগ্রহণকারী অনেকেই আত্মগোপন করে এখনো আছে এবং যারা কোয়ারেন্টাইনে বা আইসলেশনে আছে তাদের দুর্ব্যবহারে দেশের সাধারণ মানুষ-সহ খোদ সংখ্যালঘু মন্ত্রক অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘুমন্ত্রী মুক্তার আব্বাস নাকাভি তবলিগিকাণ্ডকে তালিবানি অপরাধে আখ্যায়িত করেছেন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যেখানে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় নাজেহাল। দুর্ভাগ্যবশত এখনো দিল্লির নিজামুদ্দিনের অনেক তাবলিগব নিখোঁজ। অসমের এক প্রতাপশালী মন্ত্রী তাবলিগদের ‘মানব বোমা’য় আখ্যায়িত করেছেন কিন্তু বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা নিজামুদ্দিনের ঘটনাকে করোনা জিহাদ’ বা ‘মরকজষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করতে একেবারে নারাজ।
কিন্তু মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধ দুবৃত্তদের জন্য বিশেষ কোনো সমাজকে সম্পূর্ণ দোষারোপ করাটা ঠিক নয়। বছর ৭৫-এর খালেদা বেগম হজ পালনের যাত্রার জন্য সঞ্চিত ৫ লক্ষ টাকার পুঁজি করোনা মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সেবাকাজে দান করেন। বুলন্দশহরে করোনা আতঙ্কে হিন্দু বৃদ্ধের সৎকারে যখন কেউ আসছিল না তখন প্রতিবেশী মুসলমানরা সৎকার্য করে। দরিদ্র মুসলমান মহিলার কাফনের কাপড় জোগায় এক হিন্দু যুবক, এটাই আমাদের ভারতবর্ষ। কিন্তু তথাকথিত কতিপয় কিছু ধর্মের ঠিকাদাররা সমাজের সাধারণ মানুষদের ভুল পথে চালিত করে বিভ্রান্ত করে রেখেছে। দিল্লির নিজামুদ্দিন কাণ্ডের মূল পাণ্ডা মৌলানা সাদ এক অডিয়ো বার্তায় বলছে— করোনা ভাইরাসের জন্য নাকি দায়ী মানুষের পাপ, তাই আল্লা ক্ষুব্ধ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দাবি অতিতেও ভারতের তবলিগি জামাতকে ব্যবহার করেছে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইএস, ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জামাত-উদ – দাওয়া এবং জৈশ-ই-মহম্মদের মৌলবাদী তত্ত্বের প্রচার। নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন তবলিগি জামাতকে একটি ইসলামি কট্টরপন্থীদের আন্দোলন হিসেবে বর্ণিত করেছেন। আজ এই জামাতের কর্মকাণ্ড উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং কাজকস্তানে নিষিদ্ধ। করোনা সংক্রমণে নিঃসন্দেহে কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবশ্যই নয়, তবে মৌলবাদীরা গোঁড়ামির কিছুটা ঊর্ধ্বে উঠে আসতে পারলে দিল্লির নিজামুদ্দিনের কাণ্ডের সূত্রপাতই হতো না এবং পুরো দেশকে এভাবে আতঙ্কে দিন কাটাতেও হতো না। করোনা সংক্রমণের কঠিন সময়েও পাকিস্তান ঘৃণ্য মৌলবাদী হিংসার উধ্বে উঠতে পারেনি। পাকিস্তানের দৈনিক সংবাদপত্র টেলিগ্রাফ জানায় পাকিস্তানে অমুসলমান হওয়ার অপরাধে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখদের চরম লকডাউন মুহূর্তেও কোনো প্রকার ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে না। সেখানকার এক সমাজসেবী ড. আমজাদ আইয়ুব মির্জা প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের জন্য ত্রাণসামগ্রী পৌঁছনোর আবেদন জানিয়েছেন। করোনার সংক্রমণের কঠিন সময়ের সুযোগ নিয়ে সেই পাকিস্তান সীমান্তে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া হোয়াটসআপ, ফেসবুকে ভুয়ো তথ্য পরিবেশন করে ভারতের মুসলমান সমাজকে খেপানোর অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। দ্যা ম্যাসেজ অব ইসলাম’, ‘দিল্লি মরকজ’ নামের দুটি উর্দু ইউটিউব চ্যানেল বিভিন্ন ঘোর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের উস্কানিমূলক বক্তব্য আপলোড করা হচ্ছে। পাকিস্তানের হিজবুল চিফ কুখ্যাত সৈয়দ সালাউদ্দিন এক ভিডিয়ো বার্তায় বলছে—পুরো দুনিয়ায় মুসলমানদের উপর জুলুমের কারণেই করোনা ভাইরাসের আবির্ভাব। কিন্তু হায় ! সেই পাকিস্তান করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের জন্য ভারতের শরণাপন্ন। ভারতের প্রায় প্রত্যেক করোনা সংক্রমণে নিজামুদ্দিনের সংযোগ মিলছে কিন্তু এর পরেও জুম্মাবারে। দেশের বিভিন্ন মসজিদে মুসলমানদের জমায়েত ঘটছে। এতে স্বাভাবিকভাবে জনমনে ক্রোধ পুঞ্জিভূত হচ্ছে।
রঞ্জন কুমার দে