এন আর সি হবেই : ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘উদ্বাস্তুর পার্থক্যটা বোঝা দরকার

বাঙ্গলার তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে এবার বিজেপির ফল বেশ খারাপ, গত বিধানসভার নিরিখে না হলেও কিছুদিন আগের লোকসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই। শত হলেও গত বিধানসভায় বিজেপির প্রায় অবিশ্বাস্য ভাবে জেতা খড়গপুর (সদর) কেন্দ্র এবার উপনির্বাচনে হাতছাড়া হয়েছে। লোকসভায় কালিয়াগঞ্জের বিজেপি এগিয়ে ছিল প্রায় ৫৭ হাজার ভোটে, হার হলো সেখানেও। করিমপুরে ধর্মভিত্তিক ভোটের মেরঙ্করণ। সংখ্যাগত কারণে বিজেপির বিরুদ্ধে গিয়েছে। যাই হোক, হারের কারণ হিসাবে মূলত দায়ী করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ (এনআরসি) নিয়ে বিজেপির আপোশহীন মনোভাবকে। এর মধ্যে কালিয়াগঞ্জ – করিমপুরের ভোটারদের এন আর সি-র বিষয় নিয়ে মাথাব্যথা থাকতে পারে, কারণ এগুলি সীমান্ত-ঘেঁষা এলাকা। কিন্তু বহু ভাষাভাষীর বসস্থান ‘মিনি ভারতবর্ষ খড়গপুরের ভোটাররা খামোকা এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে। যাবেন কেন? রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ সঠিকভাবেই যুক্তি দিয়েছেন এন আর সি উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট বিপর্যয়ের একমাত্র কারণ হলে খঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে তা বলা যাবে না। সুতরাং এবার উপনির্বাচনে বিজেপির ভোট বিপর্যয়ের প্রধান কারণ হিসাবে এন আর সি-কে দায়ী করা চলে না।
এই বিষয়টা আমাদেরও বুঝতে হবে। এন আর সি নিয়ে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের মাথাব্যথা থাকতে পারে, অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন, এমন মুষড়ে পড়া মানুষের চিন্তা হতে পারে, সাধারণ পশ্চিমবঙ্গবাসীর এন আর সি নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা থাকার কারণ নেই। এটা ঠিক বিরোধীদের এন আর সি নিয়ে প্রচার-কৌশলের সঙ্গে বিজেপিলড়াই করতে পারেনি, অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। এখানে এন আর সি বিরোধিতা সর্বাত্মক, শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোই নয় কায়েমী স্বার্থে কিছু প্রচারমাধ্যমও এনিয়ে উস্কানি দিচ্ছে। একটা বিষয় সবার জানা দরকার অসমে এন আর । সি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এবং এনিয়ে যে প্রশাসনিক উদ্যোগ অসমে এখনও পর্যন্ত গৃহীত হয়েছে তাতে অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘উদ্বাস্তু’চিহ্নিতকরণের কোনো মেকানিজম নেই, আর এতেই নানা গণ্ডগোলের সৃষ্টি হয়েছে ও বিরোধীরা অপপ্রচারের সুযোগ পেয়ে গিয়েছে। রাষ্টসঙ্ঘ ‘অনুপ্রবেশকারী’ আর ‘উদ্বাস্তুদের সংজ্ঞা আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, বিরোধীরা ইচ্ছাকৃতভাবে যা গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচেছ । ‘অনুপ্রবেশকারী’তাদেরই বলে যারা শুধুমাত্র আর্থিক কারণে সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসে, ‘উদ্বাস্তু হল তারা যারা সামাজিক ও ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে সীমান্ত পেরোতে বাধ্য হয়। আর্থিক কারণটা এক্ষেত্রে গৌণ বা অনুপস্থিত। অন্যদিকে অনুপ্রবেশকারীরা সামাজিক বা ধর্মীয় উৎপীড়নের শিকার হন না কখনোই।
এই হিসাবে দেখতে পেলে বাংলাদেশি মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে। উৎপীড়নের কোনও সম্ভাবনা নেই, বরং তাদের উৎপীড়নের শিকার হয়ে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানরা সেদেশ থেকে উৎখাত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। আর এরাজ্য তথা দেশের অর্থনীতিকে বেহাল করার আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অঙ্গ হিসেবে সীমান্তবর্তী এলাকায় মুসলমানদের অনুপ্রবেশ করানোর পরিকল্পনা। বহুদিনের। সুতরাং একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া উচিত যে অনুপ্রবেশকারী’বলতে কেবলমাত্র মুসলমানদেরই বোঝায়, আর উদ্বাস্তু হলো মূলত হিন্দু ছাড়া অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু, প্রতিবেশী ইসলামি দেশের নিরিখে। অর্থাৎ হিন্দু ও অন্যান্যদের যেমন কোনওভাবেই ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দেওয়া চলে না, তেমন মুসলমানরাও ‘উদ্বাস্তু হিসেবে কোনোদিনই গণ্য হবেন না। এর মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই, আছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘উদ্বাস্তু’ বিষয়ে নির্ধারক সংজ্ঞা এবং উপমহাদেশের ধর্মীয় আবহ যা নেহরু-জিন্না-মাউন্টব্যাটেন দ্বারা চিত্রিত ও কমিউনিস্ট দ্বারা প্রবল সমর্থিত।
এবার আসল কথায় আসা যাক। এই মাপকাঠিতেই আগামী দিনে এন আর সি হবে, তার আগে আসবে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল বা সি এ বি (ক্যাব) অর্থাৎ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। যেখানে প্রতিবেশী ইসলামি রাষ্ট্রে অত্যাচারিত হয়ে এদেশে পালিয়ে আসা সকল মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, যাদের মধ্যে একজনও মুসলমান থাকবে না। আর অনুপ্রবেশকারী হিসাবে যাদের তাড়ানো হবে। তারা ভারতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে এরাজ্যে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে, এদের সকলেই হবেন মুসলমান। এর মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি নেই, আছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্পষ্ট একথা বলেছেন। আফগানিস্তান থেকে আগত সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। অসমের এন আর সি তালিকায় সকল প্রকারের হিন্দুদের যুক্ত করার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হবে ‘ক্যাব’ এলে।
সুতরাং ‘বিজেপি বাঙ্গালি তাড়াচ্ছে বলে যাঁরা রাজনীতি করছেন এতকাল অনুপ্রবেশকারীদের মদতইে তারা রাজনীতির ময়দানে টিকে আছেন। আপামর হিন্দু বাঙ্গালি যদিও এদের স্বরূপ ধরে ফেলেছেন, তবে যারা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন তাদের সংশয় নিরসন করাটাও বিজেপির কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
বিশ্বামিত্র-র কলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.