রাজ্য শাসনে রাজ্যপালের সক্রিয়তা সংবিধানসম্মত

স্বাভাবিক অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীই সংশ্লিষ্ট রাজ্যের শাসকপ্রধান। প্রখ্যাত আইনজ্ঞ জি. এন. যোশীর মতে, কিন্তু যদিও রাজ্যপালই আইনত রাজ্যের প্রধান শাসক, আসলে মুখ্যমন্ত্রীই the defacto head of the State-(দ্য কনস্টিটিউশন অব ইণ্ডিয়া, পৃ. ১৯১)। আমাদের সংবিধানের ১৫৪(১) নং অনুচ্ছেদ জানিয়েছে—“The executive power of the state shall be vested in the Governor, বাস্তবে অনেক সময় মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে রেখে তাকে নেপথ্যে সরে যেতে হয়।
তার কারণ হলো আমরা ব্রিটেনের মতোই ‘Westminster model’ গ্রহণ করেছি। এক্ষেত্রে শাসকপ্রধান (রাজা/রানি) অনেকটা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন, মন্ত্রীপ্রধানই শাসন বিষয়ে প্রাধান্য বিস্তার করেন।
এলিস্ট এইচ মরিস জোস্ লিখেছেন, কেন্দ্রে ও রাজ্যে ব্রিটিশ মডেল’ গ্রহণ করা হলেও ‘this cabinet system is reproduced in the units, but with some difference’-(গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স অব ইন্ডিয়া, পৃ. ৮০)।
সেই কারণে কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর যে ধরনের সম্পর্ক, রাজ্যের রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক ঠিক তেমনটা নয়। তার ফলে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা তুলনামূলকভাবে অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। এই প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা মনে রাখতে হবে।
প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ক্যাবিনেটের কাজ হলো রাজ্যপালকে সাহায্য করা ও পরামর্শ দেওয়া (to guide and advise)। তাহলে মুখ্যমন্ত্রীই রাজ্যপালের মুখ্য সাহায্যকারী ও পরামর্শ দাতা। কিন্তু সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি যে রাজ্যপাল সেই সাহায্য সর্বদা বা পরামর্শ নিতে বাধ্য। কেন্দ্রেও এই ধরনের বাধ্যবাধ্যকতাছিল না। কিন্তু ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২ তম সংবিধান সংশোধনী এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ওপর বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দিয়েছে—তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ এখন শুনতে বাধ্য। এই কারণে ডঃ বি. পি. রাউত জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি এখন ‘rubber stamp মাত্র—(ডেমোক্রাটিক কস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ.১২৯)। কিন্তু এই ধরনের কোনও সংবিধান সংশোধন রাজ্যপালের ক্ষেত্রে ঘটেনি।
দ্বিতীয়ত, ১৬৩(১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে–রাজ্যপাল যেসব ক্ষেত্রে তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন না, সেই সব ক্ষেত্রেই মুখ্যমন্ত্রী তাকে পরামর্শ দেবেন। সুতরাং একটা বিশাল ক্ষেত্রে রাজ্যপাল তার ক্ষমতা বিস্তার করতে পারেন—বিশেষ করে ১৬৩(২) নং অনুচ্ছেদে সংবিধান বিষয়টা তাঁর নিজের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছে। এই অনির্দিষ্ট ক্ষেত্রটাই রাজ্যপালের প্রক্রিয়ার জায়গা হতে পারে। ড. এম. ভি. পাইলী মনে করেন, রাজ্যপাল নিম্নলিখিত বিষয়ে তার একক ক্ষমতা প্রয়োগ করতেই পারেন—(১) মুখ্যমন্ত্রীর নিয়োগ; (২) মুখ্যমন্ত্রীর পদচ্যুতি; (৩) বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান; (৪) বিধানসভা ভাঙা; (৫) ক্যাবিনেট লিখিত অভিভাষণের কোনও অংশ বর্জন; (৬) বিলে ভেটো দেওয়া এবং সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো; (৭) রাজ্যে। রাষ্ট্রপতি শাসনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করা ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে তাকে। নিছক কলের পুতুল বলা যায় না। ড. এম. ভি. পাইলী তাই মন্তব্য করেছেন, ‘the Governor is not a mere figurehead’, বরং তিনি রাজ্য শাসনে একটা ‘vital role পালন করতে পারেন (অ্যান ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য কস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২৪৪)। আর প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসু। মনে করেন তিনি অন্যান্য বহু বিষয়েও তার নিজস্ব ক্ষমতা দাবি করতে পারেন। সেটা নির্ভর করে according to circumstances (ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য কস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২১০)।
তৃতীয়ত, রাজ্যপালকে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পরামর্শ শুনতে বাধ্য করতে পারেন না। তার কারণ হলো, কার্যভার গ্রহণের সময়। রাজ্যপাল ঈশ্বরের নামে (in the name of God) অথবা নিজের বিবেকের কাছে শপথ। নেন তিনি সংবিধান ও আইন রক্ষা (preserve, protest and defend the constitution and the laws) করবেন এবং রাজ্যবাসীর কল্যাণের (well being) দিকে লক্ষ্য রাখবেন। সুতরাং তার দায়বদ্ধতা। সংবিধান, আইন ও জনকল্যাণের দিকেই থাকবে। যদিমুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ ভিন্নধর্মী হয়, তাহলে রাজ্যপাল সেটা নিশ্চয় অগ্রাহ্য করতে পারেন বিবেকের টানে বা জনস্বার্থে।
চতুর্থত, মুখ্যমন্ত্রী এক্ষেত্রে তাঁকে পদচ্যুত করার ব্যবস্থাও নিতে পারেন না। কেন্দ্রের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৬১নং অনুচ্ছেদে আছে রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী সংসদে ‘ইমপিচমেন্ট’ প্রস্তাব আনতে পারেন। কিন্তু রাজ্যপালকে সরাতে পারেন একমাত্র রাষ্ট্রপতিই—১৬৪(১)নং অনুচ্ছেদ অন্য কাউকে এই ধরনের ক্ষমতা দেয়নি।
এইসব কারণে বলা যায় রাজ্যপাল আদৌ মুখ্যমন্ত্রীর দাসানুদাস নন। সংবিধান তাকে বিশেষ একটা স্থান দিয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা সক্রিয়ও হতে পারেন।
মনে রাখা দরকার, ব্রিটেনের ব্যবস্থা রাজা/রানির ক্ষমতা ক্রমে খর্ব করলেও তারা ঠুটো জগন্নাথ হয়ে যাননি। ওয়াল্টার বেজহট লিখেছেন, তাঁদের তিনটি অলিখিত ক্ষমতা আছে—(১) উৎসাহ দেওয়া, (২) তথ্য জানা ও (৩) সতর্ক করা। এই ‘informal rights দিয়েই তারা পাদপ্রদীপের নীচে মাঝে মাঝে আসেন। লুই নেপোলিয়ান ‘কু’-র মাধ্যমে ফ্রান্সে ক্ষমতায় বসলে ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তাতে রানি ভিক্টোরিয়া তাকে বলেন, তার পরামর্শ না নিয়ে কাজটি করা উচিত হয়নি। ১৮৫৭ সালে ভারতে মহা বিদ্রোহ হলে (পামারস্টোন তখন প্রধানমন্ত্রী) তাকে অসর্তকতার কারণে রানি তিরস্কার করেছেন (ডঃ বি. বি. মজুমদার-রাইজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য ইংলিশ কস্টিটিউশান, পৃ. ৩৫৭)। স্যার আইভর জেনিং তাই লিখেছেন—“She may not after the ship, but she must make certain that there is a man on the wheel- (দ্য কুইন্স্ গভর্নমেন্ট, পৃ. ৩৫)।
তাহলে আমাদের রাজ্যপাল এক কাটা সৈনিক? এফ. এল. সিক্রি সঙ্গত কারণেই মন্তব্য করেছেন, রাজ্যপাল আদৌ decorative emblem’ নন (ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃঃ ২৩৬)। মুখ্যমন্ত্রী তাকে পরামর্শ দিতে পারেন—কিন্তু রাজ্যপালও তঁাকে সমালোচনা করতে পারেন। ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। প্রয়োজনে তথ্য জানতে চাইতে পারেন। যে কোনোও অফিসারকে ডাকতে পারেন, দরকারে কোনো ঘটনাস্থলেও যেতে পারেন।
এগুলো বিরোধী নেতার ভূমিকা নেওয়া বা অতি সক্রিয়তা বা ক্ষমতার রেখা অতিক্রম করা নয়। কোনোও সংবিধান গ্রন্থের মলাট খুলেই সংবিধান বিশেষজ্ঞ সাজাটা মূখর্তাকেই কিন্তু প্রকট করে তোলে। কিন্তু এ কথা মনে রাখতেই হবে—প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রীর কার্যকাল রাজ্যপালের ওপর নির্ভর করে। কারণ ১৬৪(১) নং অনুচ্ছেদে 07163Ministers shall hold office during the pleasure of the Governor’। মুখ্যমন্ত্রীও একজন “Minister’, সুতরাং তার ওপর থেকেও pleasure তুলে নেওয়া যায়। এভাবেই ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ধর্মবীর মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জিকে বরখাস্ত করেছিলেন এবং হাইকোর্টের মতে, সেটা ছিল বৈধ ব্যাপার (শর্মা বনাম ঘোষ)।
দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রীর দলে ভাঙনের ফলে তাঁর গরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যপালের মনে সন্দেহ দেখা দিলে তিনি তাকে বিধানসভায় শক্তিপরীক্ষা দেওয়ার কথা বলতে পারেন। (ড. এ. সি. কাপুর—দ্য ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সিস্টেম, পৃঃ ৩৫৩)। ধর্মবীর এটাও করেছিলেন।
তৃতীয়ত, রাজ্যপালের অভিভাষণ মুখ্যমন্ত্রী তথা ক্যাবিনেটের লেখা। ১৯৬৯ সালে অজয়বাবুরা ক্ষমতায় ফিরে এসে অভিভাষণে রাজ্যপালের নিন্দায় দুটো প্যারা রেখেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ব্রিটিশ প্রজা অনুসারে রাজ্যপাল সবটাই পড়তে বাধ্য। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, এক্ষেত্রে আরও একটা প্রথা আছে—রাজা/রানির নিন্দা তাতে থাকতে পারে না, কারণ তারাই সেটা পড়েন।
চতুর্থত, মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই রাজ্যপাল বিধানসভা ভেঙে দিতে পারেন। কারণ ব্রিটেনেও রাজা/রানির ‘prerogative power’। জি. এম. পাণ্ডের মতে এটা রাজ্যপালের একক ক্ষমতা।
পঞ্চমত, রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার (৩৫৬ নং অনুচ্ছেদ) ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এটা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থার প্রতীক।
ষষ্ঠত, রাজ্যপাল রাজ্য বিলে ভেটো দিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির কাছেও পাঠাতে পারেন। ১৯৫৯ সালে এই পশ্চিমবঙ্গেই এমনটা হয়েছিল। সুতরাং বলা যায় মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য শাসনে সর্বেসর্বা নন, তার ক্ষমতাও সীমিত। তবে তিনি রাজ্যপালের প্রধান সহকর্মী ও উপদেষ্টা। তাছাড়া তিনি ক্যাবিনেটের প্রধান ‘Cheaf head (১৬৩(১) নং অনুচ্ছেদ)। তাঁর কথাতেই অন্যান্য মন্ত্রীরা নিযুক্ত হন এবং পদচ্যুত হতে পারেন। তিনিই রাজ্যপাল ও ক্যাবিনেটের । মধ্যে সংযোগ সেতু। তিনি বিধানমণ্ডল ও তার দলের নেতা/নেত্রী।
তবে অনেক কিছুই নির্ভর করে তার ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয়তা ও দলীয় অবস্থার ওপর (ড. বি. ডি. বাহাদুর—দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃঃ ২৩৩)। সংবিধান বড়ো কথা নয়, আসলটা হলো অন্য কিছু বিষয়। রাজ্যপাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হলে এবং মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের। বিরূপভাজন হলে মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা নিষ্প্রভ। হতে পারেন—(ড. এইচ. এইচ. দাস—ইন্ডিয়া, পৃঃ ২৭২)। তাছাড়া তার দলের মধ্যে কিছু উ চাকাঙ্ক্ষী নেতা থাকলেও তার অশান্তি ঘটতে পারে। ১৯৪৮ সালে দলীয় কোন্দলের ফলেই মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এক সময় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ড. সম্পূৰ্ণানন্দকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন দলীয় সভাপতি চন্দ্রভান গুপ্তা।
ড. জে. সি. জোহারী লিখেছেনমুখ্যমন্ত্রীর দল একক গরিষ্ঠতা পেলে তার ক্ষমতাবৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু বৃহত্তর দল অন্য দলের সমর্থন নিলে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব হয়। আর তিনি কোয়ালিশন সরকার গড়লে fofa pat ‘a prisoner of circumstances’-(ইন্ডিয়ান পলিটিকাল, পৃঃ ৩৬৮)।
সুতরাং এই ব্যাপারে এক নিঃশ্বাসে শেষ কথা বলা যায় না। একটা ব্যাপার হলো । মুখ্যমন্ত্রীর কথায় বা ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তে কিছু হয় না। দরকার রাজ্যপালের সম্মতি (ডঃ এস. সি. কাশ্যপ—আওয়ার কস্টিটিউশান, পৃঃ ২৬৩)। তাছাড়া কেন্দ্রের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক, বিধানসভায় দলীয় অবস্থা, মুখ্যমন্ত্রীর দলের সহতি, তাঁর দলের ওপর তার আধিপত্য, দলীয় সভাপতির সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিধানচন্দ্র রায় এবং অজয় মুখার্জিকে একই সারিতে রাখা যায় না। মোরারজী দেশাই এবং রাবড়ি দেবীও এক নন।
ড. নির্মলেন্দুবিকাশ রক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.