ড্রাগনের কূটচালে মতিভ্রষ্ট নেপাল

ভারত বরাবর প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে আসছে। সার্কভুক্ত ছােট্ট দেশ – বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তানের ভারত সর্বদা এক প্রকৃত বন্ধু। ত্রাতার ভূমিকায় সচেষ্ট যেটা আমরা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং ২০১৭ সালে ভূটানের ডােকলামে চীনের আগ্রাসনেও দেখতে পেয়েছি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শক্তি প্রদর্শনে দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত-চীন পরস্পরের ঘাের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই ভারতকে ঘিরতে চীন সার্কভুক্ত এই দেশগুলিতে বিভিন্ন খাতে অজস্র বিনিয়ােগ করছে এবং পাকিস্তান। চীনের বাড়তি সুবিধায় ভারতে সর্বদা জঙ্গিবাদের আক্রমণ ছড়িয়ে অসছেই। নেপাল ও ভারতকে ‘রুটি ও বেটি’র সম্বন্ধে আখ্যায়িত করা হয়। নেপালের সঙ্গে রয়েছে আমাদের ভাষিক, ধার্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য। সম্ভবত সেই কারণে চীনের কুপ্রভাবে নেপালের পকেট ভর্তি করে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, একমাত্র নেপালি নাগরিকদের ভারতীয়দের মতাে সামরিক বাহিনী-সহ সব সরকারি ক্ষেত্রে চাকরির সুব্যবস্থা আছে, এমনকী তারা অবসেরর পরও সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন না। “ইবিনা পাসপাের্ট ভিসায় উভয় দেশের নাগরিক অবাধে বিচরণ করতে পারেন। নেপালে কমিউনিস্ট আগ্রাসন থেকে শুরু করে ভূমিকম্প, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতি আপদকালীন সমস্যায় ভারত সর্বদা উত্তম এবং সাহায্যকারী প্রতিবেশীর ভূমিকায় ছিল। উভয় দেশের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্কের ভিত নেহরুর জমানায় শুরু হলেও ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে মনমােহন, বাজপেয়ী, মােদী সরকার ভারতের প্রত্যেকটি নির্বাচিত সরকার নেপালের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্কের পুরাে পৃষ্টপােষকতা করে গেছে। কাঠমাণ্ডুতে তৎকালীন নেপালি প্রধানমন্ত্রী মােহন সমসের জং এবং ভারতের রাষ্ট্রদূত সিএনসিং-এর উপস্থিতিতে ১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই উভয় দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ভারত-নেপাল শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি হয়। সেই সূত্র ধরে ১৯৫২ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নেপাল দখলের চেষ্টা করলে ভারত দেওয়াল হয়ে প্রতিহত করে। নেপালের পরিকাঠামাে উন্নয়নে প্রতিবেশী ভারতের অবদান অপরিসীম। নেপালের প্রথম বিমানবন্দর প্রতিস্থাপন করা থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক, যােগাযােগ, শিল্প, বাণিজ্যে ভারত সর্বদা নেপালের পাশে থেকেছে। ২০১৫ সালের নেপালের ভয়ংকর ভূমিকম্পে ভারত ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যে সবার আগে পৌঁছে। গিয়েছিল। তখন নেপালকে পুনর্গঠনের সহায়তায় তৎকালীন ভারতে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ১ হাজার বিলিয়ন ডলারের সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।উল্লেখ্য ,ভারতের বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন সীমান্তে যথেষ্ট কড়াকড়ি থাকলেও নেপাল-ভারত সীমান্তের ১৮৫০ কিমি জুড়ে তা কোনােদিনই ছিল না। ২০১৬ সালের সরকারি এক তথ্যানুসারে নেপালের প্রতিরক্ষা দপ্তরে নিয়ােজিত আছেন ৯৫ হাজার নেপালি নাগরিক। তুলনামূলকভাবে ভারতের আধা-সেনাবাহিনী ও পুলিশ বিভাগ ছাড়াই শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর ৭টি গাের্খা রেজিমেন্টেই রয়েছেন ৪০ হাজার নেপালি। নেপালের প্রায় ৪০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়ােগ ভারতের অংশীদারিত্ব, ১৫০টিরও বেশি ভারতীয় সংস্থা। নেপালে প্রতিষ্ঠান গড়েছে। ভারতের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যােগাযােগ -সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে নেপালিরা অতি সহজে প্রবেশ করে বিনা শুল্কে সবরকম পরিষেবা উপভােগ করছে। ভারত-নেপালের মধ্যে ১৯৫১ সালের সন্ধি অনুযায়ী শুধুমাত্র নেপালের নাগরিকরা অবশ্যই ভারতে সরকারি চাকরির সুবিধা এবং জমি ক্রয় করতে পারবে কিন্তু সেই সুবিধা ভারতীয়রা নেপালে গিয়ে ভােগ করতে পারবেন না।

প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে কথিত আছে যে, অযােধ্যার রাজা রামচন্দ্রের সঙ্গে মিথিলা কন্যা সীতা দেবী বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সুতরাং নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শুধু প্রতিবেশীর নয়, বরং পরম আত্মীয়তার। কিন্তু চীনের কূটচালে নেপালি কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী। ওলির নেতৃত্বে সম্প্রীতির সেই সম্পর্কে অনেকটা ফাটল ধরেছে। চীনের পরােক্ষ মদতে নেপাল উভয় কক্ষে বিল পাশ করে উত্তরাখণ্ডের তিনটা এলাকা কালাপানি, লিপুলেখ ও লিংপিরাধুরা তাদের মানচিত্রের নকশায় সংযােজিত করেছে। নেপালের কামিউনিস্ট সরকার সম্প্রতি এতােই ভারত বিদ্বেষী হয়ে পড়েছে যে মহামারী করােনার জন্য তারা ভারতকেই দায়ী করেছে। ভারত-নেপাল সীমান্তের রেডিয়াে চ্যানেলগুলিতে চলছে অবিরত ভারত বিরােধী প্রচার।নতুন মানচিত্রের নকশার দোহাই দিয়ে নেপাল ভারতের তিনটি গ্রাম যথাক্রমে গােঞ্জী, নাবী ও কুটিরের প্রায় ৩ হাজার ভারতীয়ের জবরদস্তি নেপালি নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে । সম্ভবত এই প্রথম চাপা উত্তেজনার মধ্যে নেপালের সুরক্ষাকর্মী এক ভারতীয়কে গুলি করে, কয়েকজন আহত হয়। নেপালের গৃহমন্ত্রণালয় ভারত-নেপাল সীমান্তে বর্তমানে ১০০টি অতিরিক্ত চেকপােস্ট স্থাপন করে সেই সংখ্যা ১২১ থেকে লাফিয়ে ২২১টি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সেই সংখ্যা আগামীতে ৫০০-তে পৌঁছনাের টার্গেট নিয়ে নেপাল সরকার ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে। দিয়েছে। ভারত-নেপাল সংঘাতের সুত্রপাত ঘটে যখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ গত ৮ মে উত্তরাখণ্ডের লিপুলেখ গিরিপথ থেকে কৈলাশ মানস সরােবর যাওয়ার ৮০ কিমি লম্বা সড়কের উদঘাটন করেছিলেন। নেপাল উত্তরাখণ্ডের তিনটে এলাকার পর আবার বিহারের পূর্ব চম্পারণ জেলার জমিও তাদের বলতে দাবি শুরু করে দিয়েছে। এলাকাটির উভয় দেশের সীমা নির্ধারক পিলার নম্বর ৩৪৫/৫ ও ৩৪৫/৭-এর ৫০০ মিটার এলাকা জুড়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টিহয়েছে। যার জন্য বিহারের গণ্ডক নদীর বাঁধ নির্মাণে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য যে ১৯৫৪ সালের কুশি সন্ধি এবং ১৯৫৯ সালের গণ্ডক সন্ধিনুসারে ভারত-নেপাল উভয় সীমান্ত এলাকায় নদীবাঁধ মেরামতি প্রকল্প অত্যন্ত সৌহার্দরূপে হয়ে আসছিল। নেপালের বর্তমান ওলি সরকার নাগরিকত্ব আইনে ২০৬৩ সংশােধনী এনে এখন সেখানকার ভারতীয় বধূদের নাগরিকত্বের জন্য ন্যূনতম ৭ বছরের করা হয়েছে। সেইসঙ্গে তাদের ভারতীয় নাগরিকত্বের আইন পরিত্যাগ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ক্রমাগত ভারত বিরােধী অ্যাজেন্ডার সঙ্গে সমন্বয় রেখে এখন নেপালের অন্যতম সরকারি ভাষা হিন্দিকে নিষেধাজ্ঞার পথে হাঁটছেন। উল্লেখ্য , হিন্দি নেপালের অন্যতম জনপ্রিয় প্রথম ভাষা। ২০১১ সালের জনগণনানুসারে শুধুমাত্র সীমান্ত এলাকায় প্রায় ৭৮ হাজার হিন্দি ভাষাভাষীর বাস। এটা পুরাে স্পষ্ট যে, হিন্দিতে নিষেধাজ্ঞা কেবল ভারতের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তবে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করে নেপাল মােটেই ভালাে নেই। সেখানে নিত্যসামগ্রীর আকাশছোঁয়া দাম। লবণের কেজি প্রতি দাম হয়েছে ১০০ টাকা, প্রতি লিটার সরিষা তেল ২৫০ টাকা, চিনি ১২৫ টাকা, টেরস ১০০ টাকা, আলু ৯০ টাকা কিলােতে পৌঁছে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ওলি প্রকৃতপক্ষে নিজের দেশের নাগরিকদেরই খাদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।

চীন ক্রমশ নেপালের জমি হাতিয়ে নিচ্ছে। সেইবিফলতা ধামাচাপা দিতেই নেপাল সরকার ভারত বিরােধী ইস্যুগুলিতে কৃত্রিম জাতীয়তাবাদের প্রলাপ বকছে। নেপালের কয়েকটা সংবাদমাধ্যমের সূত্রানুসারে চীন নেপালের গােখা জেলার রুইগ্রাম দখল করে ৭২টি পরিবারকে চীনের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।রুইগ্রাম ছাড়াও চীন নেপালের আরও ১১টি এলাকা জবরদখল করে মােট চার জেলার প্রায় ৩৬ হেক্টর জমি হাতিয়ে নিয়েছে। ১৮১৬ সালের সুগৌলি সন্ধির সূত্রানুসারে নেপাল ভারতের লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি, লিপুলেখ নিজেদের মানচিত্রের নকশায় দাবি করলেও ১৯৬০-এর দশক থেকে তাদের দেশের উত্তরী গােরখার রুইগাঁও এবং উত্তরী সংকুয়াসভার চয়াং, লুংগডেক গাঁও চীনের অধিকৃত। চীন-নেপাল সীমান্তের ১৪১৪.৮৮ কিমি সীমান্তের ৯৮টি পিলার ভেঙে চীন অনেক জমি কবজা করার অভিযােগ করেছে নেপালি সংবাদমাধ্যম। খােদ নেপাল কৃষিমন্ত্রকের অধীনস্ত জরিপ অনুযায়ী চীন কয়েক হেক্টর জমি দখল করা ছাড়াও এখন তারা নদীর গথিপথ পরিবর্তন করে নেপালকে ক্রমশ গ্রাস করার উপক্রম। নেপালের অভ্যন্তরীণ আশঙ্কা এই যে এভাবে ভূমি অধিগ্রহণ চলতে থাকলে এইসমস্ত অধিকৃত অঞ্চলে ভবিষ্যতে চীন সশস্ত্র পুলিশ ছাউনি বসিয়ে নেপালের জন্য আরও হুমকিস্বরূপ হতে পারে। উল্লেখ্য যে, চীনের তিব্বত থেকে নেপালের দিকে প্রবাহিত সুমজং, কামখােলা ও অরুণ নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়ায় নেপালের সংক্ষুয়াসভা জেলায় জলের চরম ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে।

নেপাল চীনের প্রতি ঝুঁকলেও চীনের সীমান্ত এলাকায় অধিকাংশ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক মােটেই ভালাে নেই। চীন সুযােগমতাে কত ভয়ংকর হতে পারে সেটা বর্তমান নেপালের ওলি সরকার মােটেই অনুধাবন করতে পারছে না। চীন ভূখণ্ডের হিসেবে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ।

সেই অনুসারে উত্তর কেরিয়া,রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, ভারত, ভুটান, নেপাল, ভিয়েতনাম-সহ ১৪টি দেশের সঙ্গে চীনের সীমান্ত সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেই জমি, নদী, সমুদ্র, পাহাড় কিংবা পর্বতশৃঙ্গে চীন দাদাগিরিতে কোনাে না সময় অস্থিরতায় মেতে উঠে। চীন পাকিস্তান, নেপালের মতাে সুযােগ-সন্ধানী দেশগুলিকে অপব্যবহার করে নিজের স্বার্থ পূর্ণ করতে থাকে। চীন অতিক্রমণ, পেট্রোলিং, আর্থিক অনুদান প্রভৃতির মাধ্যমে প্রতিবেশীর ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশের চেষ্টায় সচেষ্ট থাকে। ২০১৭ সালে চীনের ডােকলাম বিবাদে ভারত প্রতেবশী বন্ধুদেশ ভুটনের হয়ে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরপরও ভুটানের চারাগাহ অঞ্চলে চীন নজর রেখে আসছে। সম্প্রতি নেপালের সরকারি দপ্তরও অভিযােগ করেছে। যে চীন নদীর স্রোত পরিবর্তন করেছে। তাদের সঙ্গেও সীমান্ত বিবাদ লেগেই আছে। তাইওয়ানকে চীন দীর্ঘ সময় থেকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে আসছে। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সড়ক, দ্বীপ কিংবা সমুদ্র এলাকার আধিপত্য নিয়ে চীন বিতর্কে জড়িয়ে রয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক থাকলেও ১৯৬৩ সালে উভয় দেশের সীমানা সমঝােতায় পাকিস্তান শকসগাম ঘাঁটির একটি বড়াে এলাকা চীনের কাছে সমর্পণ করে। সম্প্রতি হংকংয়ে আগ্রাসী মনােভাব এবং সেখানকার মৌলিক অধিকার’ ও ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’লঙ্ঘনের অভিযােগে রাষ্ট্রসঙ্ঘ চীনের প্রতি ক্ষেভে ব্যক্ত করেছে, এমনবস্থায় নেপালের মতাে দুর্বল ক্ষুদ্র দেশ চীনের কাছে কতটুকু নিরাপদ! অন্যদিকে ভারত সার্কভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশকে (পাকিস্তান ছাড়া) আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক নিরাপত্তা দিয়েই আসছে। স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে, মিত্র দেশ নেপাল ড্রাগনের কূটচালে ভারত বিরােধিতায় নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করছে না তাে!

রঞ্জন কুমার দে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.