করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়তে দেশজুড়ে জেলা আধিকারিকদের বড় ভূমিকা

এক বিশাল সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলার চেয়ে ছোটো ছেটো অজস্র সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে বললে বুঝতে সুবিধে হয়। পর্যবেক্ষণটি করেছিলেন আমেরিকান বিশ্ববিখ্যাত শিল্প পরিচালক হেনরি ফোর্ড। নানান মহাসংকটকালের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। একলপ্তে ৬০ হাজার কোভিড আক্রান্ত রোগীর পরিচর্যা করা ভারতের কাছে নিশ্চিত বড়ো সমস্যা। কিন্তু এই সংখ্যাটিকেই ভারতের ৭৩০টি জেলার নিরিখে ১০০ থেকে ২০০-র মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে ভাগ করে যদি নজর দেওয়া যায় তাহলে সমস্যাটা অনেক ছোটো আকারের মনে হতে পারে। ফলে একে ম্যানেজ করাও অনেক সহজ হতে পারে। আমার মতে ১৭ মে’র পর লকডাউন তোলার ক্ষেত্রে ভারতের এটিই উপযুক্ত পরিকল্পনা হওয়া উচিত। হ্যা, জেলা প্রশাসনকে ঘিরেই ঘটবে যা কিছু করোনা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড। এই জেলা প্রশাসন কার্যালয়ই হবে প্রাণকেন্দ্র। আমি বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শুরতেই লকডাউন ঘোষণা করার ফলশ্রুতিতে অন্তত ৫০ শতাংশের ভাগ্য পুরোপুরি নির্ভর করবে নির্দিষ্ট রাজ্য সরকারগুলি কীভাবে তাদের Containment পরিকল্পনাকে বাস্তবে সফলভাবে রূপায়িত করতে পারছে।

এই প্রসঙ্গে বলা ভালো যে ভারতকে কখনই একটি এক ছাঁচে ঢালা দেশ হিসেবে ধরে নেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়।

কোভিডের প্রার্দুভাবের ক্ষেত্রে ভারতের গতিপ্রকৃতির অনেকটাইইউরোপের সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে। সেখানে কোনো কোনো দেশে সংক্রমণের মাত্রা তুলনামূলকভাবে অন্য ইউরোপীয় পড়শি দেশের থেকে কম। একইভাবে ভারতের ক্ষেত্রে কেরালা, কর্ণাটক, গোয়া প্রভৃতি রাজ্যে রোগীর সংখ্যা অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় কম হবে। জেলাস্তরে গুরুত্ব ও লকডাউন তার উদ্দেশ্য পূরণে সফল হয়েছে। এই সময়ে রাজ্য সরকারগুলি তাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে কোভিড আক্রমণ ঠেকাতে যথাসাধ্য করেছে। কিন্তু লকডাউন উঠে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে রোগের সংক্রমণ যে বেশ বাড়বে এমনটা ধরে নিয়েই আমাদের কিন্তু প্রস্তুত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা ভয়ের কারণ হবে রাজ্যে রাজ্যে ফিরে আসা সেই পরিযায়ী শ্রমিকেরা যারা আপাততভাবে রোগলক্ষণহীন হলেও অনেকে বাস্তবে শরীরে রোগ বহন করছে। এরা কর্মসূত্রে মেট্রো শহরগুলি থেকে নিয়ে আসা জীবাণু গ্রামে ছড়িয়ে দিতে পারে। লকডাউন পরবর্তী পর্বে সফলভাবে আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে গেলে অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে পরীক্ষা, অনুসন্ধান ও নির্দিষ্ট সময় নজরদারি করা ছাড়া পথ নেই। পরিকল্পনাটি রদপায়িত করতে গেলে রাজ্যগুলিকে জেলাভিত্তিক নির্দিষ্ট ছক তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক রাজ্য সরকারকে একটি করোনা সংক্রান্ত ওয়ার্ডরুম তৈরি করা যেখানে জেলা প্রশাসনগুলি প্রতি সন্ধ্যায় সর্বশেষ পরিস্থিতির রিপোর্ট করবে। এই সূত্রে সহজে খোঁজ পাওয়ার জন্য একটি Tracking App খুলতে হবে যেমন কর্ণাটকে করা হয়েছে। এখানে এক মুহূর্তেই রাজ্যের প্রতিটি জেলার করোনা সংক্রান্ত খবর পাওয়া যাবে। জেলাগুলির পরিস্থিতি কেমন তা বুঝতে চারটি মানদণ্ড হবে ভিত্তি – (১) কতগুলি পরীক্ষা হয়েছে, (২) কত পরীক্ষা নেগেটিভ হলো, (৩) সেই দিন কত জন মারা গেলেন, (৪) যারা নজরবন্দি অবস্থায় অন্তবর্তী সময় কাটাচ্ছেন তাদের সন্তুষ্টি মতামত কেমন। মনে রাখতে হবে, রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষায় সংক্রামিতের সংখ্যা বাড়লে জেলা আধিকারিককে তিরস্কার করলে তার পক্ষে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর কোনো তাগিদ থাকবে না।

পরীক্ষা, অনুসন্ধান, নজরদারি ঃ প্রত্যেক জেলায় নিদেনপক্ষে দুটি সংক্রমণ পরীক্ষাগার থাকা দরকার। যার মধ্যে PCR Machine থাকা আবশ্যিক । বিকল্প হিসেবে প্রতিটি জেলাকে কাছাকাছি অবস্থিত সরকার স্বীকৃত অন্য কোনো পরীক্ষা ল্যাবরটরির সঙ্গে সংযুক্ত থাকা জরুরি। প্রত্যেকটি পরীক্ষাকেন্দ্রকে কমপক্ষে দৈনিক ২৫০টি পরীক্ষা করতেই হবে। একই সঙ্গে যদি নিয়মাবলী মেনে অনেকের রক্তে নমুনা মিশিয়ে Pool test বা সমষ্টিগত পরীক্ষা করা যায় সেক্ষেত্রে এক লপ্তে ৫ গুণ একসঙ্গে পরীক্ষা করা যেতে পারে। এমন ব্যক্তি যাদের ইনফ্লুয়েনজার মতো জ্বর বা প্রবল শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করা উচিত। অন্যদিকে ওষুধের দোকানগুলি থেকে যারা জ্বর ও কাশি সংক্রান্ত ওষুধপত্র কিনে নিয়ে গেল সেই তালিকা ধরে পরীক্ষা হওয়া জরুরি।

রোগলক্ষণ নজরে পড়ছে না কিন্তু পরীক্ষায় পজিটিভ এসেছে এমন মানুষদের সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি না করে হোটেল। বা কোনো হোস্টেলে রাখা উচিত। যে কেউ অন্য কোনো স্থান থেকে জেলায় ঢুকছে বিশেষ করে পরিযায়ী শ্রমিকদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলক নজরবন্দি গৃহে রাখা দরকার। তাদের অতিথি হিসেবে রাখতে হবে। ভালো খাবারদাবারের সঙ্গে Mobile wifi সুবিধে দিতে হবে (যাদের মোবাইল আছে)। এর কারণ হচ্ছে এর মাধ্যমে যেন বার্তা যায় যে নজরবন্দি থাকার বিষয়টা মোটেই যন্ত্রণাদায়ক নয়, বরং আরামপ্রদ। এ কারণে প্রত্যেক জেলায় ২০০ কামরার হোটেল বা হোস্টেল রাখতে হবে যেখানে লক্ষণহীন রোগীরা নজরবন্দি অবস্থান করবেন। অবশ্যই নিজগৃহে নজরবন্দি অবস্থান অনায়াসে করা যেতে পারে যেমন আলাদা থাকার ঘর ও লাগোয়া শৌচাগার রয়েছে। এই মডেলে কাজ করলে আমাদের হাসপাতালগুলিও উপচে পড়ে সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে দেওয়া অনেকটা আটকাতে পারবে।

প্রত্যেক জেলায় একটি করে কোভিড সংক্রান্ত আলাদা ২০০ শয্যার ICU যুক্ত হাসপাতাল থাকা দরকার। যেখানে বিশেষজ্ঞ অ্যানাস্থেটিস্ট, নার্স ও প্যারামেডিক থাকবেন। অবশ্যই ভেন্টিলেটর ও পর্যাপ্ত Personal Protective Equiopment (PPE 71 বর্মবস্ত্র) থাকতে হবে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলি যেখানে যথেষ্ট সংখ্যক স্নাতকোত্তর শিক্ষানবীশ ডাক্তার রয়েছেন এক্ষেত্রে এগুলি আদর্শস্থান হতে পারে। কোভিডের সঙ্গে এই যুদ্ধ তরুণ টগবগে ডাক্তাররাই জিততে পারেন বিশেষ করে যাদের অ্যানসথেসিয়া ও ICU-তে কাজ করার প্রশিক্ষণ রয়েছে।কোভিড সংলগ্ন ICU প্রবীণ ডাক্তারবাবুদের কাজের পক্ষে বিপজ্জনক স্থান।

সহজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি প্রবীণদের রক্ষা ঃ কোভিড আক্রন্ত হলেই কাউকে সামাজিকভাবে অচছু ত করে দেওয়ার সমস্যাগুলির নিরসন দরকার। সমাজের এই শিক্ষাটুকু নেওয়ার সময় এসেছে। যেসব রোগী সেরে উঠেছে তাদের ব্রাত্য করে রাখা অপরাধ। সব ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সমাজকর্মী ও স্থানীয় মানুষজনদের প্রবীণ অক্ষম মানুষের বাড়ি গিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, আবশ্যিক সামগ্রী সরবরাহে সব রকমের সহযোগিতা করা উচিত যাতে তারা অসহায় না বোধ করেন। বাজার বা যে কোনো জনবহুল অঞ্চলে। প্রয়োজনে যেতে গেলে মাস্ক পরা ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এগুলিকে কড়া হাতে বলবৎরাখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শপিং মল, ধর্মীয় প্রার্থনালয়গুলি বন্ধ থাকবে। সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান এখন বন্ধ রাখতে হবে। স্কুল-কলেজের জন্য অনলাইন শিক্ষা প্রদানই চলবে। তবে মহামারীরোধে এই প্রচেষ্টায় প্রশাসনকে সফল হতে গেলে সমাজের সকলের সহযোগিতা ও যাঁরা সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন তাঁদের বিশ্বাস অর্জন জরুরি। একেবারে গোটা অঞ্চলকে hot spot করে দীর্ঘদিন অচল রাখলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তেই থাকবে, বরঞ্চ ঠিক যেখানে Positive রোগী ধরা পড়ছে সেই নির্দিষ্টকয়েকশো মিটার অঞ্চল চিহ্নিত করে কড়াকড়ি করতে হবে।বস্তি অঞ্চলে যেখানে অনেকে পজিটিভ রোগীর সঙ্গে একই শৌচালয় ব্যবহার করছেন তাদের অবশ্যই তুলে নিয়ে নজরবন্দি করতে হবে। এলাকার দোকান সকাল থেকে রাত অবধি সামাজিক দূরত্ব মেনে খোলা থাকুক।

কোভিড ছাড়া অন্য রোগীরা যাতে চিকিৎসা পায় সে ব্যবস্থা করতে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলি স্বাভাবিক কাজকর্ম অচিরে শুরু করুক। অন্তঃরাজ্য রেল,বিমান ও সড়কপথে যাত্রী পরিবহণ চালু করে দেওয়ার সময় এখনও হয়নি। মাল বা অন্য সামগ্রী যেমন চলাচল করছে চলুক।

মৃত্যুর সংখ্যা আটকানো ঃ জেলা প্রশাসনকে পরিকল্পনায় একটা মূলগত ধাঁচা দিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী ফলদায়ী ব্যবস্থা নেবে। আবার বলছি মহামারী প্রকোপ স্থিমিত হয়ে এলে কোনো দেশকেই কত লোক আক্রান্ত হয়েছিল সেই ভিত্তিতে বিচার করা হবে না, তার কার্যপ্রণালীর সাফল্য বিচার হবে কত মানুষ মারা গিয়েছে সেই মানদণ্ডে। ভারতের তরুণ জনসংখ্যার আধিক্য সেই দিক থেকে আমাদের অনুকূলে রয়েছে। আমরা যত বেশি সংখ্যক পরীক্ষা করতে পারব পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী আমাদের মৃত্যুহার তত কম হওয়ার সম্ভাবনাই রয়েছে।

ডাঃ দেবী শেঠী ও কিরণ মজুমদার শ’

(ডাঃ শেঠী প্রখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জেন এবং চেয়ারম্যন ও প্রতিষ্ঠাতা, নারায়ণ হেলথ। কিরণ মজুমদার শ’ চেয়ার পার্সন, বাইকন লিঃ)

অনুবাদক– সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.