করোনা ও অর্থনীতির সঙ্কট সমাধান একমাত্র স্বদেশী

বর্তমানে আমাদের দেশ তথা সারা বিশ্ব এক গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে গোটা বিশ্ব আজ থরহরি কম্পমান। আড়াই লক্ষাধিক লোক মৃত, আক্রান্ত অর্ধ কোটি। আমাদের ভারতবর্ষও এর ব্যাতিক্রম নয়। সহস্রাধিক মৃত, আক্রান্ত অর্ধলক্ষ এবং ভারতবর্ষের বিপদ শুধুমাত্র চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অধিক জনঘনত্বের দেশ হওয়ার কারণে আমাদের দেশের বিপদ অর্থনীতিতেও ব্যাপ্ত। শুধুমাত্র ভারতবর্ষ নয়—চিকিৎসায়, অর্থনীতিতে তথাকথিত উন্নত বলে পরিচিত দেশগুলিও এই বিপদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না। ইতালি থেকে আমেরিকা সমগ্র পাশ্চাত্য দুনিয়ায় শোনা যাচ্ছে এর অশুভ পদধ্বনি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তাগিদে গৃহবন্দি প্রায় সকলেই। এর ফল ভোগ করছে সেই দেশগুলির অর্থনীতি। অর্থনীতির দিক দিয়ে প্রথম সারিতে থাকা সমগ্র পাশ্চাত্য দুনিয়ার অর্থনীতি আজ দাঁড়িয়ে আছে পতনের দোরগোড়ায়। সবকটি দেশের শেয়ারবাজারে নেমেছে বিপুল পরিমাণে ধস, উৎপাদন ব্যবস্থা হয়েছে বিধ্বস্ত। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে উৎপাদন ব্যবস্থার সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা। উৎপাদন ব্যবস্থার সাময়িক বিপর্যয় ও পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা, অর্থনীতির এই যৌথ বিপদ এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য নানান রকম উপায় বের করার চেষ্টা করছেন অর্থনীতিবিদরা, কিন্তু এই বিপদ কেন? মহামারীর আক্রমণ শুধুমাত্র চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিধিতে সীমাবদ্ধ না থেকে অর্থনীতির পরিধিতে মাথা গলালো কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিতে পারছে না বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক কোনো অর্থনীতিই। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের কিন্তু তাকাতে হবে প্রাচীন ভারতের বিকেন্দ্রীকৃত স্বদেশি অর্থনীতির দিকে।

উৎপাদন ব্যবস্থা বর্তমানে যে কোনো অর্থনীতিতে, যে কোনো একটি বস্তুর উৎপাদন, একেকটি ক্ষেত্রে হয়ে থাকে ব্যাপকভাবে কিন্তু অন্য কোনো বস্তুর উৎপাদন একেবারেই হয় না। ধরা যাক, এক জায়গায় ধান চাষ হচ্ছে সেখানে শুধু ধানই হচ্ছে, এক জায়গায় আখ চাষ হচ্ছে সেখানে শুধু আখেরই চাষ হচ্ছে। চাষের মধ্যেমে উৎপাদিত সামগ্রী সারাদেশে পরিবহণের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যবসায়ীদের কাছে। চাষিরা নিজেদের উৎপাদিত সামগ্রী সম্পূর্ণ বিক্রি করে দিচ্ছে। বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস তাদের কাছ থেকে কিনছে, জিনিসগুলি আবার সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। সেখানকার চাষিরাও তাদের উৎপাদন ব্যবসায়ীদের কাছে। সম্পূর্ণ বিক্রি করে দিচ্ছে। অর্থাৎ বর্তমানে গোটা পৃথিবীতে প্রচলিত অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যবস্থার কেন্দ্রীভবন হচ্ছে। অর্থনীতির এই বিশেষ পরিকাঠামোয় একটি জিনিসের উৎপাদকরা অপরাপর জিনিসের উৎপাদন খরচ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। তাই অপরাপর জিনিসের বিনিময় মূল্য সম্পর্কেও তারা অবহিত নয়। তাই নিজেদের প্রয়োজনীয় যে সব জিনিস তারা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনছে সেই সব জিনিসের মূল্য হিসেবে তারা ব্যবসায়াদের দ্বারা ধর্যে দামই প্রদান করছে। আবার তার দ্বারা উৎপাদিত জিনিসের দাম হিসেবে ব্যবসায়ীরা অন্য জায়গায় উপভোক্তাদের থেকে কত টাকা। নিচ্ছে তাও তারা জানে না। তাই ব্যবসায়ীদের ধার্য দামেই তারা নিজেদের উৎপাদন বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, যেখানে ধান উৎপাদন হচ্ছে সেখানকার ধান চাষিরা জানে না যে এই ধানের বাজারদর কত, ধানের ক্রেতার কাছে সে নিজেরা সরাসরি পৌঁছতেও পারছে না, ফলে ব্যবসায়ীদের কথিত দামেই তারা নিজের উৎপাদিত ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। আবার নিজেদের প্রয়োজনীয় যে বস্ত্র বা আখজাত চিনি তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনছে সেই সব বস্তু বা চিনির উৎপাদন খরচ তারা জানে না। সেই সব বস্ত্র বা চিনি উৎপাদকের কাছে তারা নিজে সরাসরি পৌছতেও পারছে না। ফলে বস্ত্র বা চিনির মূল্য হিসেবে তারা ব্যবসায়াদে ধার্য দামই প্রদান করতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ জিনিসের ক্রয়-বিক্রয়, চাহিদা ও জোগানের নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদিত সামগ্রীর দাম পুরোটাই ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল থাকছে, ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, অর্থনীতির সমস্ত ক্ষমতা ব্যবসায়াদের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা উৎপাদকের কাছ থেকে কম দামে জিনিস ক্রয় করে সেই একই জিনিস উপভোক্তাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে অর্থনৈতিক শোষণ চালানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। বর্তমান। পৃথিবীর সমস্ত অর্থনীতির ধারা এই শোষণের তারতম্যের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। যখন এই শোষণ করার সুযোগ কোনোও বড়ো ব্যবসায়ীর একচেটিয়া অধিকারে এসে যায় তখন বর্তমান পৃথিবীর অর্থনীতির পরিভাষা অনুযায়ী সেই পরিস্থিতিকে বলা হয় একচেটিয়া বাজার অর্থনীতি বা মনোপলি মার্কেট ইকনমিক্স। আবার যখন এই শোষণ করার সুযোগ একাধিক বড়ো ব্যবসায়ীর মিলিত একচেটিয়া অধিকারে এসে যায় তখন বর্তমান পৃথিবীর অর্থনীতির পরিভাষা অনুযায়ী সেই পরিস্থিতিকে বলা হয় অলিগোপলি মার্কেট ইকনমিক্স। আবার যখন । এই শোষণ করার সুযোগ কোনোও এক বা । একাধিক বড়ো ব্যবসায়ীর একক বা মিলিত । একচেটিয়া অধিকারে না থেকে যে কোনও ব্যবসায়ীর আয়ত্তের মধ্যে থাকে তখন। বর্তমান পৃথিবীর অর্থনীতির পরিভাষা অনুযায়ী সেই পরিস্থিতিকে বলা হয় বিশুদ্ধ । প্রতিযোগিতা-নির্ভর বাজার অর্থনীতি বা ‘পিওর কম্পিটিটিভ মার্কেট ইকনমিক্স’। আবার যখন এই শোষণ করার সুযোগ। ব্যবসায়ীর অধিকারে না থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে তখন বর্তমান পৃথিবীর অর্থনীতির পরিভাষা অনুযায়ী সেই পরিস্থিতিকে বলা হয় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’ অথবা ‘সোশ্যালিস্ট বা কমিউনিস্ট : ইকনমিক্স’। এই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে জিনিসের ক্রয়-বিক্রয়, চাহিদা। ও জোগানের নিয়ন্ত্রণ ব্যবসায়ীর উপর । নির্ভরশীল থাকছে না, পুরোটাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকছে, উৎপাদিত সামগ্রীর দামও। রাষ্ট্র ঠিক করে দিচ্ছে। তা বলে অর্থনীতির । এই বিশেষ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শোষণ হয় না তা নয়। শুধু শোষকের পরিবর্তন হয়, ব্যবসায়ীর বদলে রাষ্ট্র অর্থাৎ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রক রাজনীতিবিদ বা আমলারা শোষকের ভূমিকা গ্রহণ করে। বিশুদ্ধ প্রতিযোগিতা-নির্ভর বাজার অর্থনীতি বা পিওর কম্পিটিটিভ মার্কেট ইকনমিক্সে প্রচুর সংখ্যক ব্যবসায়ী বা শোষক থাকায় এই শোষণ তুলনায় কম হয়। কারণ নিজেদের বাজারের পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যে প্রত্যেক ব্যবসায়ী নিজেকে উপভোক্তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে চায় এবং সেকারণে একক প্রতি লাভ কম রেখেও উপভোক্তাদের কাছে জিনিসের মূল্য কম রাখে। কিন্তু শোষণ তুলনায় কম হলেও এ পদ্ধতিতেও শোষণ একেবারে বন্ধ হয় না। কারণ উপভোক্তাদের কাছে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যবসায়ীরা একক প্রতি লাভ কম রাখলেও লাভ তো একেবারে শূন্য করে না, যেটুকু ব্যবসায়ীর লাভ সেটুকুই উৎপাদক ও উপভোক্তাদের কাছে শোষণ।

প্রাচীন ভারতের স্বদেশি অর্থনীতি ছিল এর বিপরীত। সম্পূর্ণ অর্থনীতি ছিল কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে বিভক্ত। সেই একক গুলিকে গ্রাম বলা হতো। প্রত্যেকটি গ্রাম ছিল অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। একটি গ্রামে বসবাসকারী লোকেদের মধ্যে সব পেশার লোক থাকত এবং তারা বিভিন্ন রকমের জিনিস উৎপাদন করত যে জিনিসগুলি গ্রামের মানুষের সামগ্রিক চাহিদা মেটানোর কাজে লাগতো। একজনের উৎপাদন অন্যজনের উৎপাদনের সঙ্গে বিনিময় প্রথার মাধ্যমে বা হয়তো মুদ্রার মাধ্যমে সরাসরি হাতবদল হতো। অর্থাৎ একই গ্রামে একজন ধান চাষ করলেন, একজন আখ চাষ করলেন, একজন তুলাচাষি বস্ত্র উৎপাদন করলেন। উৎপাদিত সামগ্রীর সরাসরি পারস্পরিক বিনিময় হলো। উৎপাদক সরাসরি উপভোক্তাদের কাছে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করতেন। উপভোক্তা সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকেই তার। প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করতেন। ধান উৎপাদক বস্ত্র ও আখের উপভোক্তা হতেন। আখ উৎপাদক বস্ত্র ও ধানের উপভোক্তা হতেন। বস্ত্র উৎপাদক ধান ও আখের উপভোক্তা হতেন। উৎপাদক এবং উপভোক্তা কাছাকাছি অবস্থান করতেন। পরস্পরের উৎপাদন খরচ জানতেন। সরাসরি পারস্পরিক ক্রয়-বিক্রয় হতো। সেজন্য জিনিসের ক্রয়-বিক্রয়, চাহিদা ও জোগানের নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদিত সামগ্রীর দামের ওপর বাজারের, মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর অথবা রাষ্ট্রের কোনোও ভূমিকাই ছিল না। সেকারণেই সেই অর্থনীতিতে ব্যবসায়ীর অথবা রাষ্ট্রের কোনোও শোষণ ছিল না। বর্তমানে যে কোনো অর্থনৈতিক পরিকাঠামোতে এই শোষণ সহজেই পরিলক্ষিত হয়। যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল কারণ এই শোষণ। প্রকৃতপক্ষে উৎপাদক এবং উপভোক্তার মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি করে এই অর্থনৈতিক শোষণ। যেমন, কলকাতা শহরে আগে খাটাল ছিল। কলকাতাবাসী এই খাটালগুলি থেকে দুধ কিনে তাদের দৈনিক দুধের বিপুল চাহিদা মেটাত। উৎপাদক ও উপভোক্তা কাছাকাছি অবস্থান করতো। উৎপাদক সরাসরি উপভোক্তাদের কাছে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করতো। উপভোক্তা সরাসরি উৎপাদকদের কাছ থেকেই তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করতো। ফলে কোনরকম অর্থনৈতিক শোষণ পরিলক্ষিত হতো না। প্রায় তিনদশক আগে আকস্মিকভাবে তৎকালীন রাজ্য সরকার পরিবেশ দূষণের অজুহাতে কলকাতা শহরে খাটাল রাখা নিষিদ্ধ করে দেয়। খাটালগুলি শহর থেকে অনেক দূরে চলে গেল। কলকাতাবাসী তাদের দৈনিক দুধের বিপুল চাহিদা মেটানোর জন্য দুগ্ধব্যবসায়ীদের মুখাপেক্ষী হলো। দুধের দাম বাড়লো, অর্থনৈতিক শোষণ চালু হলো। খাটালের চেয়ে অনেক বেশি দূষণ সৃষ্টিকারী তৈলব্যবহারকারী যন্ত্রচালিত গাড়ি কিন্তু কলকাতা শহরে নিষিদ্ধ হয়নি, তবে হ্যা, তজ্জনিত দূষণ কমাবার জন্য নানান নিয়মতান্ত্রিক সংস্কার সাধিত হয়েছে। খাটালের ক্ষেত্রেও নিষিদ্ধ না করে নিয়মতান্ত্রিক সংস্কার সাধিত করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারতো, কিন্তু ব্যবসায়িক মানদণ্ড যে আজ প্রকৃতপক্ষে রাজদণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাই বণিকের অর্থনৈতিক শোষণ করার উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কাজেই সে নিয়োজিত হলো। এটি ব্যবসায়ীর অর্থনৈতিক শোষণের একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ কিন্তু এই একই পদ্ধতিতে অনেক বড়ো অর্থনৈতিক শোষণ করে চলেছে বণিককুল। বিশেষত বিদেশি বণিককুল এবং সেই শোষণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নয়, বরং বিজ্ঞাপন ও প্রচার মাধ্যমের ঢক্কানিনাদের দ্বারা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ডাবের জল আর আখের রস খাওয়া গ্রীষ্মপ্রধান আমাদের দেশের মানুষের চিরন্তন অভ্যাস ছিল। এক্ষেত্রেও উৎপাদক ও উপভোক্তা কাছাকাছি অবস্থান করতো। উৎপাদক সরাসরি উপভোক্তাদের কাছে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করতো। ফলস্বরূপ এখানেও কোনোরকম অর্থনৈতিক শোষণ পরিলক্ষিত হতো না। কিন্তু বিজ্ঞাপন ও প্রচারমাধ্যমের অমোঘ ঢক্কানিনাদের ফলস্বরূপ ডাবের জল আর আখের রসকে নির্বাসন দিয়ে ঠাণ্ডা পানীয়ের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে সকলে। উৎপাদক শোষিত হয়নি, কারণ এক্ষেত্রে বণিক নিজেই উৎপাদকের স্থান দখল করেছে। শোষণকেন্দ্রিক সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে একটি নির্দিষ্ট কালখণ্ডের পরে এই জিনিসটিও লক্ষ্য করা যায় যে, সেখানে মধ্যস্বত্বভোগী বণিক নিজেই উৎপাদকের স্থান দখল করে অর্থাৎ বণিক হয়ে যায় উৎপাদক। উৎপাদন ব্যবস্থার আরও বেশি কেন্দ্রীভবন ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদক হবার প্রয়োজনীয় দক্ষতা বণিকের অধিগত থাকে না। সে বাধ্য হয় উৎপাদনের কাজে দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করতে। গ্রামকেন্দ্রিক বিকেন্দ্রীকৃত স্বদেশি অর্থনীতির ক্ষুদ্রতম একক গ্রামের স্বাধীন কুটির শিল্পী বা ক্ষুদ্র শিল্পী, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অথবা বাজার অর্থনীতির মারপ্যাঁচে পরিণত হয় বণিক পরিচালিত বৃহৎ শিল্পের শ্রমিক। এর ফলেই দেখা যায় অর্থনীতির ক্ষুদ্রতম একক গ্রাম থেকে শ্রমিকদের বৃহৎ শিল্পকেন্দ্রিক শহরমুখী গমন। সৃষ্টি হয় বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকের ।

স্বদেশি অর্থনীতির পথে চলে ভারতবর্ষ অর্থনীতির ময়দানে এককালে যে সাফল্য লাভ করেছিল আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশ কোনো কালে সেই সাফল্য লাভ করেনি। খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিশ্বের অর্থনীতির চল্লিশ শতাংশ ছিল ভারতের দখলে। এই অবস্থা চলেছিল প্রায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মনে রাখা দরকার, সেই সময়কালে আলেকজান্ডারের গ্রিস সাম্রাজ্যের দ্রুত উত্থান ও পতন ঘটেছে। প্রায় চারশো বছর দাপটের সঙ্গে গোটা ইউরোপ শাসন করেছে রোম। আরব সাম্রাজ্য তার আগ্রাসী লোলুপ হাত বাড়িযেছে তিনটি মহাদেশ জুড়ে। তবু অর্থনৈতির দিক থেকে ভারতের সঙ্গে পেরে ওঠেনি কেউ। ভারত কিন্তু কোনো দেশ দখল করেনি। কোথাও কোনো সাম্রাজ্য স্থাপন করেনি, বরং বহিরাগত গ্রিক, শক, হুন, কুশান, আরব প্রভৃতি আক্রমণকারীকে এরেক পর এক প্রতিরোধ করেছে; আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে পরম যতনে। ১০০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারত তীব্রভাবে আক্রান্ত, পরাভূত, লুণ্ঠিত বৈদেশিক মুসলমান আক্রমকারীদের দ্বারা। ভারতের অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও তার প্রভাব পড়ে। সেজন্য দেখা যায়, এই সময় থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত চল্লিশ শতাংশ থেকে তিরিশ শতাংশে নেমে এসেছে। তা সত্ত্বেও তখন ভারত কিন্তু বিশ্বের অন্য দেশসমূহের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। অন্য কোনো দেশই তখন বিশ্ব অর্থনীতির তিরিশ শতাংশের অধিকারী ছিল না। এ অবস্থায় চলে আরও দু’শতক। এরপর আসে ভয়ংকর অবস্থা। পরাধীনতার স্বাভাবিক নিয়মেই ভারতবর্ষ তখন প্রবল অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়। ফলস্বরূপ ভারতের অর্থনীতি গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে মাত্র কুড়ি শতাংশ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। তবু ভারত বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। কোনো দেশই তখন একক ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির কুড়ি শতাংশের অধিকারী ছিল না। এমনকী ভারত তখন যাদের দ্বারা পরাধীন তারাও ভারতের তুলনায় পশ্চাৎপদ ছিল। তুর্কিপাঠান-মোগলের কালখণ্ডে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা কুড়ি শতাংশের আশেপাশেই আটকে ছিল। এরুর এল ভারতের অর্থনীতির সবচেয়ে কালো দিন। ব্রিটিশ অধীনে ভারতের স্বদেশি অর্থনীতি বিতাড়িত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন অর্থনীতি অনুসৃত হতে শুরু করল। পলাশীর যুদ্ধের সময়েও বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবদান কুড়ির নীচে নামেনি। আর ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশ বিতাড়িত হলো তখন বিশ্বঅর্থনীতিতে ভারতের অবদান মাত্র দু’শতাংশ। স্বাধীনতার সাত দশক পর আজ বিশ্বঅর্থনীতিতে ভারতের অবদান মাত্র পাঁচ শতাংশ।

কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিবহণনির্ভর বিপণন, নিজ বাসস্থানে কর্মসংস্থানহীন শ্রমিকের দল— এই তিনটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি।

আজ করোনায় আক্রান্ত পৃথিবীতে সামাজিক দূরত্ব রাখার তাগিদে যখন পরিবহণ ব্যবস্থাই প্রায় বিপর্যস্ত, গোটা পৃথিবী জুড়ে তখন পরিবহণনির্ভর কেন্দ্রীভূত সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি হয়ে পড়েছে পঙ্কবদ্ধ হস্তীর মতো অচল। স্বদেশি অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকৃত উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় উৎপাদন ও বিপণন পরিবহণের ওপর নির্ভরশীল নয় এবং কর্মীরাও একত্রিত হয় না, স্থানীয় স্তরে কাজ পায়। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতেও যদি স্বদেশি অর্থনীতির পথে দেশ চলতো তাহলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তাগিদে জাতীয় অর্থনীতি এতখানি বিপর্যস্ত হতো না।

বিপর্যস্ত উৎপাদন ব্যবস্থা ও কর্মহীন শ্রমিকের দল— এই দ্বিমুখী সমস্যায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি তথা জাতীয় অর্থনীতি এখন পরিত্রাণের পথ খুঁজছে। পথ কোথায়? পথ এখন একমাত্র সেই চিরন্তন স্বদেশি অর্থনীতি যাকে এতদিন বলা হতো দ্য থার্ড ওয়ে বা তৃতীয় বিকল্প, তা গোটা বিশ্বের কাছে আজ দ্য ফাস্ট ওয়ে বা প্রথম তথা একমাত্র বিকল্প।

দেশের অর্থনৈতিক নবজাগরণের জন্য তাই আজ আবাহন করতে হবে সেই স্বদেশি অর্থনীতিকে এবং এই স্বদেশি অর্থনীতিকে দেশে পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার মানুষের মনের মধ্যে স্বদেশি ভাবনার বিকাশ। পরাধীনতার আমলে আমরা মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নিতে পেরেছিলাম বলেই বঙ্গভঙ্গকে রুখে দিতে পেরেছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন আমেরিকান পণ্যে জাপানের বাজার ভরে গিয়েছিল, যুদ্ধবিধ্বস্ত হতদরিদ্র জাপান কিন্তু আমেরিকান পণ্য গ্রহণ করেনি। এই স্বদেশি চেতনা ছিল বলেই জাপানের এত উন্নতি। এই স্বদেশি চেতনা ছিল বলেই আমরা ব্রিটিশকে বিতাড়িত করতে পেরেছিলাম। এই স্বদেশি চেতনা ছিল বলেই একটা সময় ভারত বিশ্বঅর্থনীতিতে প্রভুত্ব করেছিল। এই স্বদেশি চেতনা যদি আবার ফিরে আসে তাহলে ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে।

অম্লানকুসুম ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.