উন্মেষ :
ল্যানসেট জার্নালে ১ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত রিপোর্ট বাদেও অন্যান্য সূত্র মারফত, যার মধ্যে চীনের উহান প্রদেশ থেকে আসা রিপোর্টও রয়েছে, তাতে জানা যায় যে, উহান প্রদেশে নতুন এক করোনা ভাইরাস ছড়াতে আরম্ভ করেছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে বা তার আগে থেকেই। এই ‘নতুন’ ভাইরাসের উদ্ভব সম্পর্কে যে দুটো তত্ত্ব রয়েছে। তার প্রথমটি হলো : এটি প্রাণীদেহে অন্যান্য ভাইরাসের মধ্যে জিনগত আদান-প্রদান হয়ে উৎপন্ন নতুন প্রজাতির এক ভাইরাস, যা মানুষের দেহেও বংশবিস্তার করতে পারে (এমন ঘটনা প্রাণীদেহে হামেশাই ঘটছে, কিন্তু উৎপন্ন বহু প্রজাতির মধ্যে হাতে গোণা যে ক’টি প্রাণী ও মানবদেহ দু’ জায়গাতেই বংশবিস্তার করতে পারে, তারাই অসুখের উৎপত্তি করে)। আর, দ্বিতীয় তত্ত্বটি হলো : এই ভাইরাস চীন তার উহান প্রদেশে অবস্থিত জৈবাস্ত্র গবেষণাগারে জিনগত গবেষণায় তৈরি করেছে এবং দুর্ঘটনায় বা ইচ্ছাকৃত কারণে এটি বেরিয়ে পড়ে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ.এইচ.ও.)-র বেইজিং অফিসে নতুন এক সংক্রামক অসুখের খবর পৌঁছায় এবং তার পরদিন (অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর) তাইওয়ানের স্বাস্থ্যমন্ত্রক ডব্লিউ.এইচ.ও.-কে এই খবর জানায়। চীন নিজে ডব্লিউ.এইচ.ও.-কে সরকারিভাবে বিষয়টা জানায় ৩ জানুয়ারি।
করোনা-ভবিষ্যতের নিয়ামক :
এই মহামারীর ভবিষ্যৎ স্বরূপ নির্দিষ্ট হবে নতুন করোনা ভাইরাস (যার পরবর্তীকালে নামকরণ হয়েছে। কোভিড-১৯)-এর জৈবিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারাই শুধু নয়, সংশ্লিষ্ট আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কার্য-কারণে ও তার অভিঘাতের দ্বারাও বটে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কোনও জরুরি ঘটনা ঘটলে তার রিপোর্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রচার করতে হয়। চীন তা তো করেইনি, বরং ডব্লিউ.এইচ.ও. নিজেও ব্যাপারটা জানত, তবুও চুপচাপ ছিল। তাইওয়ানের স্বাস্থ্য মন্ত্রক ডব্লিউ.এইচ.ও.-কে এই নতুন অসুখের মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কথা জানালেও, ডব্লিউ.এইচ.ও. কিন্তু নড়ে চড়ে বসেনি। চীন ওই ভাইরাসের। জিনগত বিশ্লেষণ ৫ জানুয়ারি ২০২০ তারিখেই করে ফেলেছিল বলে সাংহাই পাবলিক হেলথ ক্লিনিক সেন্টারের ড. ঝাং যোঙ্গুয়েন জানিয়েছেন, কিন্তু চীন ওই বিশ্লেষণ প্রকাশ করছে না দেখে তিনি নিজেই সেটা ১১ জানুয়ারি ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দেন। পরদিনই চীনা পুলিশ তার ল্যাবরেটরি বন্ধ করে দেয়। ১৪ জানুয়ারি ডব্লিউ.এইচ.ও. স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিবৃতি দিয়ে জানায় :‘চীন সরকার জানিয়েছে নতুন করোনা ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। বিবৃতিটি উহান থেকে আসতে থাকা অন্যান্য রিপোর্টের নিরিখে অসত্য। ডব্লিউ.এইচ.ও. চীনকে স্বস্তি দিল ২২ জানুয়ারি একটা বিবৃতি দিয়ে নতুন অসুখটি আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ নয়’ এবং ২৮ জানুয়ারি আরও একটা বিবৃতি দিতে বাধ্য হলো : ‘নতুন অসুখটির বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হচ্ছে। ডব্লিউ.এইচ.ও. চীনকে সাধুবাদ দিয়েছিল দেশের আন্তরাজ্য উড়ান বন্ধ করে দেবার জন্য, কিন্তু যখন অন্যান্য দেশ চীন থেকে আসা উড়ান বন্ধ করতে চাইল, তখন আপত্তি জানিয়েছিল। ওই আপত্তি অগ্রাহ্য করে আমেরিকা চীনের উড়ান বন্ধ করে দেওয়ায় ডব্লিউ.এইচ.ও. ৩ ফেব্রুয়ারি বিবৃতি দিল :‘চীন পৃথিবীকে বাঁচানোর যথেষ্ট চেষ্টা করছে, তাই এখন উড়ান বন্ধ হওয়ায় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। অবশ্য ততদিনে পৃথিবী জেনে গেছে যে, চীন কর্তৃপক্ষ উহান লকডাউন করার আগে পঞ্চাশ লক্ষ লোককে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যেতে দিয়েছে। এই ধরনের আরও অনেক আজব ঘটনার পর ডব্লিউ.এইচ.ও. যখন শেষ পর্যন্ত ১১ মার্চ অসুখটাকে বিশ্ব-মহামারী বলে ঘোষণা করল, ততদিনে বিশ্বের ১১৪টি দেশে ৪০০০ মানুষের মৃত্যু ও লক্ষাধিক অসুস্থ হয়ে গেছেন।
এই কথাগুলো জানা দরকার, কারণ কমিউনিস্ট চীন এবং তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থা ডব্লিউ.এইচ.ও. যদি সত্যি ঘটনা এবং সংশ্লিষ্ট সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি সময়মতো সবাইকে জানাতো তাহলে পৃথিবী অনেকটাই সময় পেতো এবং এই মহামারী হয়তো একটু অন্যরকম হতে পারতো।
সমগ্র পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের উৎপাদক ও প্রসারক হিসেবে চিহ্নিত হবার পর চীনের আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদী মনোভাবের পরিচয় আমরা এর মধ্যেই পেয়েছি। চীন দাবি করেছে এভারেস্ট পর্বত তাদের, ভুটানের কিছু অংশ তাদের, ভারতের। লাদাখের একটা অংশ তাদের, রাশিয়ার কিছু অংশ তাদের। এছাড়া নেপালকে উসকে চরম ভারত-বিরোধী অবস্থানে নিয়ে এসেছে। চীনের সঙ্গে লাদাখ সীমান্তে ভারতের ছোটো সামরিক সংঘর্ষ, ভারতের অত্যাবশ্যক সমর সজ্জা এবং প্রতিরক্ষাখাতে তাৎক্ষণিক বিপুল ব্যয়, যা এই মহামারী-জনিত রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক সংকোচনের সময় অতিরিক্ত চাপের কারণ হয়েছে, তা চীন জেনে বুঝেই ঠিক এই সময়ে করিয়েছে। এরই মধ্যে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের তিনটে বিমানবাহী পারমাণবিক যুদ্ধজাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এসে পৌঁছানো যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। এতে সন্দেহ নেই যে, করোনা পরবর্তী বিশ্বে আর্থ-সামাজিক ও সমরশক্তি বিষয়ক এক নতুন মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
এছাড়াও আস্তে আস্তে আর একটি বিষয় ক্রমশ প্রকট হয়ে চলেছে। মহামারীর নিঃশব্দ ও দ্রুত প্রসারের ফলে একসঙ্গে অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ায় দেশে দেশে এক অভাবনীয় স্বাস্থ্য-আর্থ- সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে এবং ক্রমবর্ধমান এক আতঙ্কের পরিবেশকে লালন ও হাতিয়ার করে এমন এক অসাধু ব্যবসায়িক বাতাবরণ চারপাশে পরিব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, যার ফল যথেষ্ট সুদূরপ্রসারী হবে বলেই আভাস পাওয়া যায়।
সংক্রমণের গতি ও পরিসংখ্যানের ব্যাখ্যা :
চীনের বাইরে কোভিড-১৯-এর প্রথম রুগিটি পাওয়া গেল ১৩ জানুয়ারি থাইল্যান্ডে। এই লেখার সময় সারা পৃথিবীতে প্রায় পনেরো কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন। ছ’ লক্ষেরও বেশি মানুষ। ভারতে এই আক্রান্তের সংখ্যা দশ লক্ষ ছাড়িয়েছে, মৃত্যু প্রায় সাতাশ হাজার। এই বিষয়ে মনে রাখতে হবে যে, কোভিড-১৯ রোগ-নির্ণয় করার যে পরীক্ষাটি রয়েছে, যাকে আরটি-পিসিআর বলা হয়। সেই পরীক্ষার দ্বারা নির্ণীত মানুষই রুগি বলে সব্যস্ত হন এবং ওই পরিসংখ্যানে স্থান পান। সমস্ত রুগিরই এই পরীক্ষা করার সুযোগ নেই বা করা হয় না। বলাই বাহুল্য, এই ভাইরাস যাঁদের দেহে সংক্রামিত হয়, তাদের একটা অংশের কোনও উপসর্গই হয় না; তারা সংক্রমণ ছড়াতে থাকেন, কিন্তু তঁাদের টেস্ট না হবার ফলে তারা পরিসংখ্যানে আসেন না। আরও একটি অংশের খুবই মৃদু, অকিঞ্চিৎকর ও ক্ষণস্থায়ী উপসর্গ হয় (যেমন, একটু গলাব্যথা বা একটু জ্বর জ্বর ভাব বা একবার হঠাৎ পাতলা পায়খানা, একবেলা একটু কাশি ইত্যাদি), তারা কোভিড-১৯ হয়েছে এমন সন্দেহ করেনই না, ফলে এদেরও টেস্টও হয় না। এই উপসর্গ বিহীন কিংবা মৃদু উপসর্গ যুক্ত মানুষের সংখ্যা কত? ইন্ডিয়ান জার্নাল অব
মেডিক্যাল রিসার্চে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে দেখা গেছে গবেষকরা ২২ জানুয়ারি এবং ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ১,০২১, ৫১৮ জন মানুষকে টেস্ট করেছেন এবং তঁাদের মধ্যে ৪০,১৮৪ জনের দেহে কোভিড-১৯ সংক্রমণের অস্তিত্ব পেয়েছেন। এদের মধ্যে উপসর্গ বিহীন মানুষের অনুপাত ২৮ শতাংশ। আমরা জানি যে, এর সঙ্গে মৃদু উপসর্গযুক্ত রুগিদের ধরলে অনুপাতটা সারা দেশে প্রায় ৭০ শতাংশ হতে পারে। এতে করে বোঝা গেল যে, রুগির যে দৈনিক পরিসংখ্যান আমরা দেখি, যা নিয়ে মিডিয়া রোজ চিৎকার চেঁচামেচি করে আতঙ্ক বাড়ানোর চেষ্টা করে, সেটি আসলে মোট সংক্রমণের একটি ছোট্ট অংশ। যার অর্থ হচ্ছে কতজন মানুষ যথেষ্ট পরিমাণে অসুস্থতা অনুভব করে ডাক্তার দেখিয়ে ডাক্তারের নির্দেশমতো টেস্ট করিয়েছেন, কিংবা অন্য । কোনো পজিটিভ কেসের সংস্পর্শে এসেছেন। বলে তার টেস্ট করা হয়েছে। দেশে আসল সংক্রমণের পরিমাণ দৈনিক সম্প্রচারিত সংখ্যার অনেক বেশি। এই কথা শুনে আতঙ্কগ্রস্ত হবার কারণ নেই দুটো কারণে : এক, এতে স্পষ্ট বোঝা গেল বেশিরভাগ মানুষের লক্ষণ, উপসর্গ তেমন হয় না, তাঁরা। ভালো হয়ে যান, ভালোই থাকেন। দুই, ১৩৩ কোটি মানুষের দেশ ভারতে এই সংক্রমণের পরিমাণটা আসলে বেশি উপদ্রুত অন্যান্য। দেশের তুলনায় যথেষ্টই কম। যেমন, প্রতি লক্ষ জনসংখ্যার হিসেবে কোভিড-১৯ রুগি আমেরিকায়১১৪৭ জন, ব্রেজিলে ৯৬৬ জন, কিন্তু ভারতে সংখ্যাটা প্রতি লক্ষে ৭৬ জন। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও তাই। প্রতি লক্ষের হিসেবে। মৃত্যু আমেরিকায় ৪৩, ব্রেজিলে ৩৬.৭ ও ভারতে ১.৯। এতেও আবার বেশি নির্বিকার থাকার দরকার নেই, কেননা যত কমই হোক, সংক্রমণ ছড়ানো তো রোধ করতেই হবে, কারণ যাঁর মধ্যে রোগ ছড়াবে তার যে বাড়াবাড়ি হবে না, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই।
প্রতিরোধ ও নিবারণমূলক ব্যবস্থা : (১) লকডাউন :
লকডাউন হচ্ছে বাহ্যিক জনজীবন স্তব্ধ করে এই ভাইরাসের সংক্রমণের অগ্রগতি রোধ করা। এটা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে করে মানুষ বেশি সংখ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়ে তথা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে না তোলেন। এবং সরকার সময় পান সমস্ত প্রয়োজনীয় পরিষেবা সংহত করে তার সুষম ব্যবহার করার। ভারতে লকডাউন শুরু হয় ২২ মার্চ ২০২০। তারপর দফায় দফায় লকডাউনের মাধ্যমে এই মহামারীর মোকাবিলা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে। ভারতের একমাত্র রাজ্য, যেখানে লকডাউন শুরু হতেই মুখ্যমন্ত্রী দলবল নিয়ে সারা কলকাতা চষে বেড়িয়ে বাজারে রাস্তায় রাস্তায় গোল্লা এঁকেছেন মানুষ ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে বাজার করবেন তা বোঝাতে, আরমানুষ ভিড় করে কৌতূহলের সঙ্গে সেই সমস্ত ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করেছেন। লকডাউনের মতো এমন একটি জরুরি ও অবশ্যপালীয় বিষয়কে দিনের পর দিন এইরকম খেলো করে দেবার ফলশ্রুতি এই হয়েছে যে, রাজ্যের মানুষ লকডাউন বিষয়টা আদপেই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারেননি এবং কার্যত ব্যর্থই করে দিয়েছেন। এ সত্ত্বেও লকডাউনের অবশ্যম্ভাবী সুফল হিসেবে সারা দেশে সংক্রমণ যা হতে পারত, অবশ্যই তার চেয়ে প্রত্যাশিতভাবেই যথেষ্ট কম হয়েছে। এছাড়া যা যা লক্ষ্য করা গেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন—মানুষ ঘরমুখো হয়েছে, পরিবারমুখো হয়েছে, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে, সংক্রমণরোধী বিশেষ বিশেষ পুষ্টিগুণবিশিষ্ট খাদ্যদ্রব্যের দিকে মানুষের ঝোক দেখা গেছে। যেমন, শাকসবজি, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ডি ইত্যাদি। শরীরের যত্ন নেওয়া তথা শরীরচর্চার বিষয়টি সক্রিয় করণীয় তালিকায় উঠে এসেছে। ঘরের বহু কাজে জড়িয়ে মহিলাদের সংসারচর্চার হাজারো কাজ পুরুষের নজরে এসেছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। মানুষ ঘরে ঢুকে পড়ায় প্রকৃতির ওপর মানুষের যে স্বেচ্ছাচারিতা ছিল তা প্রায় সম্পূর্ণই অন্তর্হিত হবার ফলে আকাশ ধোঁয়াশা বিহীন, বাতাস নির্মলতর, এক কথায় প্রকৃতির নতুনের মতনই ঝকঝক করতে শুরু করেছে। মানুষ আবার নতুন করে বুঝেছে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে কী পরিমাণ কলুষিত করা হয়েছিল। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদীজীর এক বিশেষ প্রকৃতিবান্ধব পদক্ষেপ সবার নজর কেড়েছে। ও অভিবাদন আদায় করে নিয়েছে। তিনি ১০ জুলাই শুক্রবার মধ্যপ্রদেশের রেওয়াতে এক মহতী ৭৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা বিশিষ্ট ও এশিয়ার সর্ববৃহৎ সৌরশক্তি প্রকল্প উদ্বোধন করলেন। পরিবেশ দূষণকারী ফসিলজাত বা পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা ধাপে ধাপে কমিয়ে সবুজতর অপ্রচলিত শক্তির সন্ধানে আমাদের এই প্রকল্প।
প্রতিরোধ ও নিবারণমূলক ব্যবস্থা : ব্যক্তিগত সুরক্ষা :
ব্যক্তিগত সুরক্ষা তিন ধরনের : মাস্ক ব্যবহার, সাবান-জল (বা তা না থাকলে স্যানিটাইজার) দিয়ে কনুই অবধি ঘনঘন হাত ধোঁওয়া এবং পরিবারের বাইরে অন্যান্য মানুষের সঙ্গে ছ’ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা। জাপানে বহু বছর ধরেই মাস্কের প্রচলন আছে। সেদেশে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মানুষ বাড়ির বাইরে মাস্ক ব্যবহার করেন। তাদের কাছে সেটা ভদ্রতা। তারা মনে করেন, কথা বলার সময় যে সূক্ষ্ম অদৃশ্য থুথুকণা মুখ থেকে বের হয়, তা থেকে অপরকে রক্ষা করা প্রাথমিক কর্তব্য। করোনা ভাইরাস এসে পৃথিবীর সবাইকে মুখে মাস্ক পরতে বাধ্য করেছে। সম্প্রতি জানা গেছে, ভাইরাসটি বাতাসে বেশ কিছুক্ষণ ভেসে থাকতে পারে। বদ্ধ জায়গায় এটা একটা বড়ো সমস্যা। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোলের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সবাই যদি মাস্কের ব্যবহারে নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক হতে পারেন, তবে সামনের দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে এই বর্তমান মহামারীটি আয়ত্তে এসে যাবে। নেপালে মাস্ক ছাড়া কাউকে রাস্তায় দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে ৫০০ টাকা জরিমানা নেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য করোনা ভাইরাস আগেও এসেছিল (সার্স ভাইরাস, মার্স ভাইরাস), আবারও আসবে। মনে হচ্ছে মাস্ক আমাদের সবার মুখে পাকাপাকি ভাবেই জায়গা করে নিল।
প্রতিরোধ ও নিবারণমূলক ব্যবস্থা : চিকিৎসা :
পর্যবেক্ষণ-১
এক গবেষক তরুণীর একটু গলাব্যথা, কাশি হওয়াতে ডাক্তার দেখানো হলো। তিনি রক্ত পরীক্ষা করার জন্য বাবার সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতার একনামী ল্যাবরেটরিতে গিয়ে রক্ত দিলেন। তারা বলল কোভিড টেস্টও করে দেবে। রিপোর্ট আনার দিন ল্যাব থেকে তাঁদের ফোনে ডেকে নিয়ে গিয়ে রিপোর্ট দিল, ওই করোনার রিপোর্ট বাদে; বলা হলো অপেক্ষা করতে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাইরে থেকে একজন লোক ঢুকলো, ঢুকে তার হাতে একটা কাগজ দিল। খুলে দেখেন, মেয়ের করোনার রিপোর্ট পজিটিভ। দেখেই তিনি দৌড়লেন আই-ডি হাসপাতালে। কিন্তু আই-ডি-র ডাক্তার করোনার রিপোর্ট দেখে বললেন :“এই ল্যাবের তো সরকারি লিস্টে নামই নেই। এই কাগজ হায়দরাবাদের এক লেটারহেডে টাইপ করা। রুগির লক্ষণ উপসর্গ তেমন কিছুই নেই। প্রেসক্রিপশান করে দিচ্ছি, আপনারা একে বাড়ি নিয়ে যান। এখানে ভর্তি করলে সরকারি করোনা লিস্টে নাম উঠবে। তাছাড়া অন্যান্য রুগির সঙ্গে থাকার ব্যাপার রয়েছে।”ভদ্রলোক ভয়ে ভর্তিই করে দিলেন। এরপর সরকারি রিপোর্ট নেগেটিভ এল।
বুঝতে পারছেন কি একটা সুনিপুণ দুষ্টচক্র চলছে? চমৎকার ও সহজ ব্যবসা। মুম্বইয়ের এক নামকরা হাসপাতালের সাম্প্রতিক ঘটনা এই দুষ্টচক্রের আর এক প্রমাণ। সেই হাসপাতালে ভুয়ো পজিটিভ রিপোর্ট দেখিয়ে রুগি ভর্তি করে লক্ষ লক্ষ টাকার বিল করা হতো। সুতরাং সাধু সাবধান!
পর্যবেক্ষণ-২
তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে ছটফট করতে থাকা ১৮ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া কোভিড পজিটিভ শুভ্রজ্যোতিকে নিয়ে সকাল। থেকে চার-চারটে হাসপাতালে ঘুরে জায়গা পাননি তার মা-বাবা। শেষে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর মা আত্মহত্যা করার হুমকি দিতে ভর্তি করা হলো ছেলেকে। তখন তারা দেখলেন অন্তত তিনটে বেড খালি। শুভ্রজ্যোতি মারা গেল কয়েক ঘণ্টা পরেই।
সঙ্গত ভাবেই রাজনৈতিক তো বটেই, স্বাস্থ্য বিষয়ক অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। সে কি বিনা চিকিৎসায় মারা গেল? আমরা জানি, আইসিএমআর-এর কোভিড চিকিৎসার নিয়মাবলীতে অসুখের প্রথম দিকে প্রযোজ্য যে ওষুধটির নাম রয়েছে, সেটি হচ্ছে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে এই ওষুধটি দেওয়া হয় জিঙ্কের সঙ্গে, কারণ সব ডাক্তারই এটা জানেন যে, জিঙ্ক অণুর মাধ্যমেই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রাণীকোষের করোনা ভাইরাসকে হত্যা করে। উপসর্গ শুরু হবার প্রথম পাঁচ দিনের মধ্যে। চিকিৎসা শুরু করা গেলে বেশিরভাগ রুগিই ভালো হয়ে ওঠেন। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে কি এই চিকিৎসা নিয়ম করে চলে? সর্বত্র ঠিকঠাক চলে বলে মনে তো হয় না! মনে না হওয়ার কারণ এই যে, এই নতুন অসুখে নতুন ওষুধ এনে বাজারে চড়া দামে ছেড়ে বিপুল মুনাফা করার যে এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছে, তার ফায়দা তোলার জন্য ওষুধ কোম্পানির এক লবি অতীব সক্রিয়, এই ডিজিট্যাল মিডিয়ার যুগে এই সমস্ত তথ্য লুকিয়ে রাখা যায়নি। ওই লবি এবং দেশে দেশে তাদের পোষ্যরা বলে বেড়াচ্ছে যে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নাকি এক অপদার্থ ওষুধ এবং এর সাঙ্ঘাতিক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, এটা নাকি হৃদযন্ত্রের পক্ষে খুব খারাপ। অথচ এর মূল ওষুধ ক্লেরোকুইন, বিগত ৬৫ বছর ধরে ম্যালেরিয়া জ্বরে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন বাতের (রিউম্যাটয়েড আর্থরাইটিস) ওষুধ হিসেবে গত পঞ্চাশ বছর ধরে ব্যবহার করছেন চিকিৎসকরা এবং কয়েক কোটি বয়স্ক বাতরোগগ্রস্ত মানুষ এই ওষুধটি বছরের পর বছর ধরে রোজ খেয়ে এসেছেন। ওষুধটি ডব্লিউ.এইচ.ও.-র জরুরি ওষুধের তালিকায়ও রয়েছে। আমরা দুঃখে লজ্জায় অধোবদন হয়ে যাই যখন দেখি বিজ্ঞানের শীর্ষস্থানীয় সাময়িকপত্র ‘দ্য ল্যানসেট’-এর পাতায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের দোযাবলী সম্পর্কে ভুয়ো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যেই এর জাল তথ্যাদি নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে এত শোরগোল ওঠে যে গবেষণাপত্রটি বাতিল বলে ঘোষিত হয়। কিন্তু তবুও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনকে কালিমালিপ্ত করার এই যুদ্ধ ভালোভাবেই জারি রয়েছে। কারণ বর্তমান বিশ্ব-মহামারীর পরিস্থিতিতে এই দশ টাকার ট্যাবলেট বাতিল করে সারা পৃথিবীতে প্রতি সিসি পিছু পাঁচ হাজার টাকা (কালোবাজারে পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা) দামের ওষুধ চালু করে দেওয়া গেলে মুনাফা কয়েক হাজার কোটি ডলার! ভারতে এই অসাধু ব্যবসা আর সাধারণ মানুষ— এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেই একটিই মানুষ—নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। সেই কারণেই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের নাম আইসিএমআর- এর কোভিড চিকিৎসার নির্দেশাবলী থেকে বাদ দেওয়া যায়নি। কিন্তু মোদীজী তো আর বারাসাতের মিডল্যান্ড নার্সিং হোমে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন না, আপনারা তো শুভ্রজিতের কোভিড পরীক্ষা করে পজিটিভ বললেন, কিন্তু তাকে রেফার করে দেবার আগে চিকিৎসার একটা প্রেসক্রিপশন করে দিলেন না কেন? কিংবা সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ তাকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে রেফার করে দেবার আগে আইসিএমআর প্রোটোকল মেনে চিকিৎসাটা দিয়ে দিল না কেন?
কেন দেবে ? ডাক্তারদের মনে তো নিপুণভাবে অনিশ্চয়তার বীজ রোপণ করে দেওয়া হয়েছে। আর অনেকেরই কাছে আবার বাণিজ্যের হাতছানিও যে আছে! এই অনিশ্চয়তা আজ সৃষ্টি করেছে চিকিৎসাবিভ্রাট। চিকিৎসা-বিভ্রাট সৃষ্টি করছে একদিকে সংক্রমণের দ্রুত প্রসার এবং জনমানসে তীব্র আতঙ্ক। ওই তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টিকরছে ঘটি-বাটি বিক্রি করে হাসপাতালে লক্ষ লক্ষ টাকার করোনা-প্যাকেজ কিনে ভর্তি হবার হুড়োহুড়ি। বেসরকারি হাসপাতালে করোনা প্যাকেজ দশ থেকে কুড়ি লক্ষ টাকা। সরকারি হাসপাতালে ?সঠিক জায়গাটা ধরতে পারলে একটু কমেই হয়ে যাবে। কিন্তু ওই চিকিৎসা-বিভ্রাট থেকে যাবার সম্ভাবনা প্রবল, যে বালাই বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে নেই। দামি ওষুধটা প্যাকেজেই ধরা থাকে। শুভ্রজিতের মা টাকা নেই বলে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে ছেলেকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করেছিলেন। তাও যদি বুঝতাম ওই দামি ওষুধ সত্যি সত্যি কাজের হতো। ওই ওষুধ মৃত্যুর সম্ভাবনা আদৌ কমায় না (অর্থাৎ তার মরটালিটি বেনিফিট নেই)। রুগির যকৃৎ (লিভার)-এর ক্ষতি করে। কিন্তু নােংরা অসাধু বাণিজ্যের কাছে এতে কিছু এসে যায় না।
একটা জরুরি বিষয় আছে। বর্তমান সরকারি নীতি হচ্ছে উপসর্গহীন অথবা মৃদু উপসর্গ বিশিষ্ট কোভিড টেস্ট পজিটিভ রুগিদের বাড়িতেই রেখে চিকিৎসা। এর কারণ হচ্ছে রুগির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের বেডের ঘাটতি বেশি করে প্রকট হচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই আরও অনেক খারাপ হবে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে। মানুষের ভোগান্তি, হাহাকার এবং বেড পাইয়ে দেবার দুষ্টচক্রগুলোর কার্যকলাপ। কোভিড-১৯ রোগটি অতি দ্রুত সংক্রমণশীল, একে থামানো না হলে ১৩৩ কোটি ভারতবাসীকে সংক্রমিত না করে থামবে না। একে থামানোর উপায়গুলো হচ্ছে :
(১) লকডাউন। এতে ভাইরাসের অগ্রগতি রোধ করা যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের রুজিরোজগারে এবং দেশের অর্থনীতিতে অনভিপ্রেত অভিঘাত আসে। তাই এটি একদমই সাময়িক। লকডাউন উঠলে আবার মহামারী চলতেই থাকে।
(২) চিকিৎসা : কোভিড-১৯-এর চিকিৎসা হিসেবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে, তার আলোচনা করা হয়েছে। এটিকে শক্ত হাতে রোখা দরকার। আর একটি বিষয় হচ্ছে, দেশের এখনও নীতি রয়েছে টেস্ট করে পডিটিভ না পেলে চিকিৎসা করা হবে না। এই নীতির পরিমার্জন অবশ্যই করতে হবে। কেননা যতই এই ভাইরাসটির বিভিন্ন দিক ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে, আমরাও তেমন তেমন ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই টেস্টগুলো এখনও সহজলভ্য নয়, এখনও সুলভ বা যথেষ্ট সস্তা নয়, এখনও পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। ভারতে এখন সরকারিভাবে রুগি রয়েছে দশ লক্ষের মতো, এদের সবাই টেস্ট করে সেই টেস্টের ফলাফলের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যানে ঢুকেছেন। আগেই আলোচনা করা হয়েছে, এমন অনেক সংক্রামিত মানুষ আছেন, যাঁদের টেস্ট করাই হয়নি। আইসিএমআর-এর অ্যান্টিবডি সার্ভের ফলাফলের ভিত্তিতে ভাইরোলজিস্ট শাহিদ জামিল বলেছেন এই সংখ্যাটা এখন ১৫ কোটি। বলাই বাহুল্য, ভারতে এখন অবধি টেস্ট হয়েছে মাত্র দেড় কোটি। বাকি সংক্রামিত মানুষগুলো অজানা, অধরা থেকে রোগটা প্রতিনিয়ত ছড়াচ্ছে। এই বিরাট ঘাটতি কমার নয়। এই ক্ষেত্রে একমাত্র করণীয় হচ্ছে,
টেস্টের অপেক্ষা না করে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা (সিন্ড্রোমিক ট্রিটমেন্ট)।
মহামারীকালীন আপৎকালে এই উপসর্গ-ভিত্তিক চিকিৎসা একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। কলেরা, নিউমোনিয়া, যৌনরোগ ইত্যাদি নানান অসুখে এটি প্রয়োগ হয়েছে। এই পদ্ধতির সুবিধেগুলো হচ্ছে :
(ক) রুগি আসামাত্র তার করোনা উপসর্গ তালিকার ন’টা উপসর্গের মধ্যে কমপক্ষে তিনটে থাকলেই তাকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, জিঙ্ক, ভিটামিন-সি ও ডি দিয়ে চিকিৎসা দিয়ে দেওয়া হবে। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হবে ততই বাড়বে তার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা।
(খ) যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হবে তত তাড়াতাড়ি রুগি অসংক্রামক হয়ে উঠবেন। তিনি রোগ ছড়াবেন না।
(গ) মহামারীর সময়ে উপসর্গ-ভিত্তিক চিকিৎসা যত জনের হবে, তাদের বেশিরভাগই হবেন কোভিড-১৯-এর রুগি। মহামারীর সেটাই বৈশিষ্ট্য। কচিৎ কেউ তা
হলে এই চিকিৎসায় তাঁর কোনও ক্ষতি হবে না।
(ঘ) এই চিকিৎসা করবে সরকারি, বেসরকারি, সমস্ত হাসপাতালের আউটডোর, পুরসভার ক্লিনিক, প্রাইভেট ডাক্তাররা, এমনকী গ্রামেগঞ্জে প্র্যাক্টিসরত কোয়াকরাও।
(3) ভ্যাক্সিন বা টিকা : এইমুহূর্তে ২০৫টি ভ্যাক্সিনের কাজ চলছে। এর মধ্যে ১৯টির মানুষের ওপর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সামনের সাত-আট মাসের মধ্যে হইহই করে সাত আটটা ভ্যাক্সিন এসে যাবে বাজারে। ভারতীয় ‘কোভ্যাক্সিন’-এর কথা বাদ দিলে বাকিগুলো কিন্তু বাণিজ্যিক, তাই আদৌ সস্তা হবে না। যাতে মানুষ আবার ঘটি-বাটি বিক্রি করে ভ্যাক্সিন নিতে ছোটে সেই জন্যই আতঙ্ক জিইয়ে রাখার বা যথাসম্ভব বাড়ানোর কাজ চলছে। কিন্তু এই ভ্যাক্সিনগুলো কতদিন। সুরক্ষা দেবে কেউ জানে না। বছরে ক’বার নিতে হবে কিংবা কত বছর পর পর নিতে হবে কেউ জানে না। গবেষকদের কেউ কেউ বলেছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে শরীরে যে স্বাভাবিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, তার স্থায়িত্ব কয়েক মাস মাত্র। এই পরিস্থিতিতে ওই ভ্যাক্সিনগুলো কতটা দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেবে তা অজানা। কোনও ওষুধই ১০০ শতাংশ সুরক্ষা দেয় না; এই ভ্যাক্সিনগুলোও দেবে না। সেটা বুঝেই প্রতিদিন মিডিয়া-ইউটিউবে দেখা যায় ‘ভ্যাক্সিন সফল, এই এলো বলে!
এই পরিস্থিতিতে ভ্যাক্সিন বা টিকার ওপর। যত না ভরসা রাখা যায়, তার চেয়ে বেশি কার্যকরী হবে ব্যক্তিগত সুরক্ষা এবং সুচারু, দ্রুত ও কার্যকরী চিকিৎসা। উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা (সিন্ড্রোমিক ট্রিটমেন্ট) ছাড়া ভারতের মতো বিশাল, বৈচিত্র্যময় ও জনবহুল দেশে যেখানে ৭৫ শতাংশ গ্রাম এবং ২৫ শতাংশ শহরাঞ্চল, সেখানে আর কোনও রাস্তা আছে বলে তো মনে হয় না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, দেশ তথা পৃথিবীর বর্তমান আর্থ-সামাজিকরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের আত্মনির্ভর হতে হবে। এই কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে ‘আত্মনির্ভরতার অর্থ স্বদেশী ওষুধ ও অন্যান্য দ্রব্যাদি, যথা— মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এবং স্বদেশী টিকা অর্থাৎ ‘কোভ্যাক্সিন।
অধ্যাপক উচ্ছল কুমার ভদ্র
(লেখক কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পূর্বতন অধ্যক্ষ)