লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিরোধীদের আশ্বস্ত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন- ‘ধর্মীয় নির্যাতনের দরুন পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসা সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দানের কথা এই বিলে বলা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই বিলে নাগরিকত্ব দানের কথা বলা হয়েছে, ছিনিয়ে নেওয়ার কথা নয়। বিলে সংবিধানের ৩৭১ নম্বর অনুচ্ছেদ কোনও ভাবেই লজ্জিত হবেনা। উত্তর-পূর্বের মানুষের সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি বিলে রয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধন বিল আমাদের ইস্তাহারে ছিল এবং মানুষ ২০১৯-এ। আমাদের প্রতি ব্যাপক জনাদেশ দিয়েছেন, তাই সরকারের দৃঢ় সংকল্পই হলো ইস্তাহারে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করা। নরেন্দ্র মোদী সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারানুযায়ী কমিটি গঠিত হয়নি।
রাজ্যসভায় সম্প্রতি বিলটি পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিল, ২০১৯ সংসদের অনুমোদন পেল। লোকসভায় বিলটি গত ৯ ডিসেম্বর পাশ হয়েছে। রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের যে সমস্ত মানুষ পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের জীবনে এই বিল নতুন আশার সঞ্চার করবে। তিনি আরও বলেন, এই বিল ভারতে কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, বরং প্রত্যেক ভারতীয়র অধিকার সমানভাবে সুরক্ষিত থাকবে। শাহ বলেন, নরেন্দ্র মোদী সরকার দেশে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার সুরক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। মোদী সরকার যে ধর্ম অনুসরণ করে, তা হলো ভারতের সংবিধান। আমরা কেবল সরকার পরিচালনার জন্যই ক্ষমতায় নেই, বরং সাধারণ মানুষের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ক্ষমতায় রয়েছি’ বলে শ্রী শাহ মন্তব্য করেন। বিতর্কের জবাবে শ্রী শাহ বলেন, দশকের পর দশক ধরে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার মানুষজনকে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার দিতে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদানের লক্ষ্যেই এই বিল। তবে, নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে এদের কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সংখ্যালঘু ওই ধর্মগুলির মানুষজন যেদিন ও যে বছর থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তখন থেকেই তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এমনকী, এদের বিরুদ্ধে যাবতীয় মামলা ও আইনি প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি, তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থকেও সুরক্ষিত রাখা হবে। শ্রী শাহ আরও বলেন, শরণার্থী এই মানুষজনের পাসপোর্ট বা ভিসার মেয়াদ যদিফুরিয়েও যায়, তাহলেও তাদের অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে না।
শ্ৰী শাহ আরও বলেন, এই বিলে। ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। কোনোভাবেই নিশানা করা হয়নি। তবে, অনুপ্রবেশকারীদের দেশে কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। তিনি জানান, বিগত বছরগুলিতে ইসলামিক দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ক্রমশ কমেছে। এই দেশ দুটিতে হয় সংখ্যালঘুদের হত্যা করা হয়েছে অথবা তাদের ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়েছে। এই কারণেই তারা ভয়ে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ধর্মীয় কারণে ভারতবর্ষ বিভাজন এবং ১৯৫০ সালের নেহরু-লিয়াকত চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও মর্যাদা সুরক্ষিত রাখার লক্ষ্যেই নাগরিকত্ব সংশোধন বিল। নিয়ে আসা হয়। তিনি বলেন, “যদি এই বিল। ৫০ বছর আগে আনা হতো, তা হলে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভবই হতো না। ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে বড়ো ভুল হলো— ধর্মীয় কারণে ভারতবর্ষের বিভাজন। নাগরিকত্ব সংশোধন বিল আমাদের ইস্তাহারে রাখা হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষ ২০১৯ সালে আমাদের বিপুল জনাদেশ দিয়েছেন। তাই, এই প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।
কেন ওই তিনটি দেশের সংখ্যালঘুদেরকেই বিবেচনায় রাখা হয়েছে এবং কেন মুসলমানদের এই বিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এ সম্পর্কিত একাধিক প্রশ্নের জবাবে শ্রী শাহ বলেন, অতীতে বিভিন্ন সময়ে উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। তাহলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দানের ব্যাপারে কেন বিবেচনা করা হবেনা ! তিনি আরও জানান, অতীতে বিভিন্ন সময়ে একাধিক সরকার পরিস্থিতি ও ঘটনাক্রমের ভিত্তিতে সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারারশর্ত পূরণের বিষয়টিকে হাতিয়ার করে শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান করেছে। এখন এই বিলের মধ্য দিয়ে ওই তিনটি দেশ থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে এদেশে চলে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্বদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। শ্রী শাহ আরও জানান, বিগত পাঁচ বছরে ওই তিনটি দেশ থেকে চলে আসা ৫৬০ জনেরও বেশি মুসলমানকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে। এমনকী, পূর্বর্তন ইউপিএ সরকার কেবল ১৩ হাজার হিন্দু ও শিখকে নাগরিকত্ব প্রদান করেছে। কিন্তু মোদী সরকার হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বী-সহ ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ছয়টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার সুরক্ষায় নাগরিকত্ব প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্য সভায় বলেন, এই বিলের পেছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। সরকারের মূল লক্ষ্যই হলো— ওই তিনটি দেশ থেকে বাধ্য হয়ে এদেশে চলে আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া। এই সরকার ২০১৫ সালেও বিলটি নিয়ে এসেছিল কিন্তু বিলটি অনুমোদিত হয়নি। তখন থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে আসন্ন নির্বাচনগুলিতে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার উদ্দেশ্যে সরকার। এই বিল নিয়ে আসেনি। এমনকী, এই বিলের। মাধ্যমে ধর্ম নিরপেক্ষতার ব্যাপকতাকেও খাটো দেখানো হয়নি। মোদী সরকার সমগ্র বিষয়টিকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিবেচনা করেছে। ওই তিনটি দেশে ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন সংখ্যালঘু এমন সমস্ত সম্প্রদায়কে এই বিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে বিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, কারণ ওই তিন ইসলামিক দেশে ধর্মের ভিত্তিতে তাদের কোনও রকম নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি। শ্রী শাহ পুনরায় আশ্বাস দিয়ে বলেন, মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত ভারতীয় নাগরিকদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। তিনি বলেন, এই বিলের মাধ্যমে কোনোভাবেই তাদের নাগরিকত্বে আঁচ পড়বে না। তিনি বিরোধীদের অনুরোধ করেন, বিলটি সম্পর্কে রাজনৈতিক দ্বিচারিতা না করতে এবং সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভাজনের রেখা না টানতে। এই বিলের উদ্দেশ্য হলো— নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়া নয়, পাইয়ে দেওয়া’ বলে শ্রী শাহ অভিমত প্রকাশ করেন।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের আশঙ্কা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই অঞ্চলের মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক পরিচিতি অক্ষুন্ন রাখা হবে। এমনকী, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির মানুষ যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন, তার সমাধান-পদ্ধতি এই বিলে রয়েছে। বিলে যে সমস্ত সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা নিয়ে বিগত এক মাস ধরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের সঙ্গেই ম্যারাথন আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এমনকী, তিনি সিকিমের মানুষকেও আশ্বস্ত করে বলেন, এই বিলের ফলে কোনও ভাবেই তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে না। সমগ্র বিষয়টিকে তিনি রাজনৈতিক আদর্শগত দিক থেকে না দেখে, মানবিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার অনুরোধ জানান।
শ্রী শাহ বলেন, সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলের আওতায় অন্তর্ভুক্ত এলাকা এবং ১৮৭৩ সালের বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশনের অধীন এলাকা-সহ অসম, মেঘালয়, মিজোরাম বা ত্রিপুরার জনজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে সংশোধিত এই আইনের ধারাগুলি বলবৎ করা হবে না। এই বিলে নাগরিকত্ব আইনের তৃতীয় তফশিলের সংশোধন করে ওই তিনটি দেশে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের মানুষকে ১১ বছরের পরিবর্তে ভারতে বিগত পাঁচ বছর ধরে বসবাসরত প্রমাণ বা নথিপত্র পেশের ভিত্তিতে যোগ্য নাগরিকত্ব প্রদানের সংস্থান রয়েছে। শ্রী শাহ জানান, আজ এক গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারির মধ্য দিয়ে মণিপুরকেও ১৮৭৩ সালের বেঙ্গল ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রেগুলেশনের ‘দ্য ইনার লাইন’-এর আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।
অসমবাসীদের আশ্বস্ত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের ভাষা, ধর্ম ও সামাজিক পরিচিতি সুরক্ষিত রাখা হবে। তিনি খেদ প্রকাশ করে বলেন, ১৯৮৫’র অসম চুক্তির ৬ নম্বর ধারানুযায়ী, বহু দশক ধরে যে কমিটি গঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত গঠিত হয়নি। ভূমিপুত্রদের অধিকার সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত রাখতে সরকারের অঙ্গীকারের কথা পুনরায় উল্লেখ করে শ্রী শাহ অসম চুক্তির বিভিন্ন ধারা পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ওই কমিটিকে যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেদন জমা দেওয়ার অনুরোধ করেন।
এই বিলে উপরোক্ত তিনটি দেশে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে এদেশে চলে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের যে প্রস্তাব রয়েছে, তা ভারতীয় সংবিধানের এমনকী, ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ কোনোটিকেই লঙ্ঘন। করবে না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এই বিলের মাধ্যমে সংবিধানের ৩৭১ নম্বর অনুচ্ছেদের কোনও ধারাও লঙ্ঘিত হবে না।
নাগরিকত্ব বিলে অন্যান্য সংশোধন প্রসঙ্গে শ্রী শাহ জানান, বিলের ৭ (ঘ) ধারাতেও সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, যাতে করে অনাবাসী ভারতীয় নাগরিক কার্ড হোল্ডারদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া যায়।
বেশ কয়েকজন সংসদসদস্য এই বিলকে বিতর্কিত বলে যে দাবি তুলেছেন, তার জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রত্যয় ব্যস্ত করে বলেন, আদালতে বিলটিকে চ্যালেঞ্জ জানানো হলেও তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এমনকী, কালের পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হবে।
2019-12-26