চিন্তাশীল রাষ্ট্রনায়ক ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায় ছিলেন বাঙ্গালি হিন্দুদের ত্রাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা। ড.শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের জীবনে অনেক অজানা, গােপন ও অকথিত তথ্য আছে—তিনি ছিলেন আমাদের দেশের এক অবহেলিত বীর ও নায়ক। এখানে পশ্চিমবঙ্গের জনকের অসামান্য ভূমিকার কিছুটা ফুটিয়ে তুলে আমি আমার অন্তরের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার চেষ্টা করেছি। এই সঙ্গেই আমি তার এই অপ্রতিরােধ্য প্রবল সংগ্রামের ওপর আলােকপাত করবার চেষ্টা করেছি।

ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায়ের পিতা ছিলেন ‘বাঙ্গলার বাঘ’ স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায়। তিনি কলকাতা হাইকোর্টের মুখ্য বিচার পতি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায় তাঁরই সুযােগ্য পুত্র ছিলেন।

ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায় ১৯৪২ সালে বঙ্গপ্রদেশের অর্থমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং স্বাধীন ভারতে তিনি নেহরু সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।

পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতীয় জনসঙ্ঘ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। পরবর্তীতে সেটি ভারতীয় জনতা পার্টিতে পরিবর্তিত হয়— যা কিনা আজকের দিনে ভারতের শাসকদল। আমরা অনেকেই তার এই বর্ণময় জীবনের ও জাতিগঠনে তার নেতৃত্বের খবর রাখিনি।

মুসলমান জনাধিক্যের জন্য মুসলিম লিগ পুরাে বঙ্গপ্রদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি দাবি করে। কিন্তু অবিভক্ত বঙ্গের পশ্চিমাংশে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম লিগের অন্যায্য চাপ চলতেই থাকে। এই সংকটকালে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায় বাঙ্গালি হিন্দুদের পরিত্রাতা হিসেবে মুসলিম লিগের বিরােধিতায় আবির্ভূত হন। এই চরমতম সংকটের মুহূর্তে তিনি হিন্দু বাঙ্গালির অস্তিত্ব রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায় ভারতভাগের প্রবল বিরােধী ছিলেন কিন্তু পরে মুসলিম লিগের হঠকারিতায় দেশভাগ যে অনিবার্য তা উপলব্ধি করলেন এবং তখনই ঠিক হিন্দু বাঙ্গালির অস্তিত্ব রক্ষায় পশ্চিমবঙ্গকে ছিনিয়ে নেওয়ার সংকল্প। করলেন। সেইমতে বঙ্গভাগের দাবি তুলে পশ্চিমভাগকে ছিনিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর হলেন।

সেই সময় বঙ্গপ্রদেশের মুসলিম লিগ নেতা সুরাবর্দি স্বাধীন বাঙ্গলার দাবি তুললেন। যা ভারত কিংবা পাকিস্তান কারাের সঙ্গেই যাবে না। সুরাবর্দি জানতেন যে বঙ্গপ্রদেশ ভাগ হলে, অর্থনৈতিক ভাবে পূর্ববঙ্গের ক্ষতি। কারণ কয়লাখনি, পাটকল, শিল্প প্রভৃতির বেশির ভাগটাই পশ্চিমভাগে পড়ছে। তারপর তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে বড়াে শহর, বন্দর ও বাণিজ্য নগরী কলকাতাও হাতছাড়া হতে চলেছে। কিন্তু মুশকিল হলাে, তার এই নীতি তার দলের নীতির বিরুদ্ধে যাচ্ছিল।

অবাক করে মহম্মদ আলি জিন্না ব্যাপরটির গুরুত্ব বুঝে তাকে নীরবে সমর্থন দিলেন। শুরু হলাে লড়াই। কংগ্রেস নেতৃত্ব তৎক্ষণাৎ এই দাবি প্রত্যাখ্যান করল।

প্রবল বিরােধিতা শুরু করলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায়। তিনি বােঝালেন, এটা মুসলিম লিগের চাল। মর্যাদাপূর্ণ কলকাতা হাতছাড়া হওয়া ও পশ্চিমভাগের দখল হারানাের ভয়ে মুসলিম লিগ তথা জিন্না সুরাবর্দিকে ঢাল করে এই চাল চেলেছেন। স্বাধীন বাঙ্গলা আসলে পাকিস্তানের প্রভাবেই চলবে। তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে। তিনি আরও বললেন, তিনি আলাদা পশ্চিমবঙ্গ চান যা জিন্নার তথা পাকিস্তানের প্রভাব থেকে সর্বৈব মুক্ত হবে।

পাকিস্তানের হাত থেকে বাঙ্গলার পশ্চিম অংশকে রক্ষা করতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন। এই দাবির ভিত্তিতে বাঙ্গলার বিধানসভায় তিনটি পৃথক ভােট সংগঠিত হয়েছিল। কী কী সেশন, কারা ভােট দিয়েছিল, কী কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেই ভােট থেকে?

১. জয়েন্ট সেশন : এখানে সমস্ত সদস্যের ভােটে ১২৬-৯০ ব্যবধানে ভারতীয় কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে যােগদানের বিপক্ষে রায় দেওয়া হলাে।

২. মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার। সদস্যদের সেশন :এখানে ১০৬-৩৫ ভােটে বাঙ্গলা ভাগের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হলাে।

৩. অমুসলমান এলাকার সদ্যসদের সেশন : এখানে ৫৮-২১ ভােটে বাঙ্গলা ভাগের পক্ষে রায় গেল।

মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙ্গলা ভাগের পক্ষে যে কোনাে সেশনের একটি সিঙ্গেল মেজরিটি ভােটের ফলস্বরূপ, বাঙ্গলা ভাগের পক্ষে সায় দেওয়া হলে।ঠিক হলাে, ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতকে স্বাধীনতা হস্তান্তর কর হবে, ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীন আইন অনুসারে।।

হিন্দুদের অস্তিত্ব রক্ষায় মুসলিম লিগের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক প্রচারের বিরােধিতায় অবতীর্ণ হন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায়। তিনি ও তার সমর্থকরা সনাতন হিন্দুধর্মের সহনশীলতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি এবং এদেশে বসবাসকারী মুসলমানদের

নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কথাই প্রচার করতেন । কিন্তু তার এবং তাঁর অনুগামীদের এই বিশ্বাস পূর্ববঙ্গের নােয়াখলিতে হিন্দু গণহত্যায় প্রবলভাবে নাড়া খায় ও ভেঙে পড়ে। ১৯৪৬-৪৭-এর দাঙ্গার পরেই ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায় মুসলমান প্রধান ও মুসলিম লিগ দ্বারা শাসিত দেশে হিন্দুদের নিরাপত্তার অভাব অনুভব করেন।

তার প্রবল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবের সামনে জিন্না, সুরাবর্দি ও অন্য মুসলমান নেতারা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েন এবং তাদের পুরাে বঙ্গপ্রদেশের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। ভারত কেশরীর সিংহগর্জনে বাঙ্গলার পশ্চিমাংশের হিন্দু প্রধান ভূখণ্ড নিয়ে সৃষ্টি হলাে পশ্চিমবঙ্গ।।

যদি ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায়ের প্রয়াসে পশ্চিমবঙ্গ না তৈরি হতাে তাহলে জেহাদি মুসলমানদের কবল থেকে বাঙ্গালি হিন্দুদের রক্ষা করা যেত না এবং তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাও দেওয়া যেত না। যদি। পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি না হতাে তাহলে হিন্দুদের সেই দশা হতাে, যা আজকে বাংলাদেশে বাঙ্গালি হিন্দুদের এবং পাকিস্তানে হিন্দুদের হচ্ছে।

১৫ আগস্ট ১৯৪৭-এ ভারত স্বাধীন হবার পর কংগ্রেস দল ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায়কে ডেকে প্রথম ক্যাবিনেটের মন্ত্রী হতে আহ্বান জানায়। তিনি রাজি হন এবং ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে প্রশংসনীয় কাজ করে নজর কাড়েন সকলের। ১৯৫০ সালে চিত্তরঞ্জন লােকোমােটিভ কারখানা ও ১৯৫১ সালে সিন্ধি সার কারখানার তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

দেশভাগের পর হিন্দুদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় এই অবস্থায় খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েন। ক্রমাগত আসতে থাকা উদ্বাস্তুদের স্রোত পরিদর্শন করতে তিনি নেহরুকে আমন্ত্রণ জানান। সংসদে তিনি এই সমস্যার সুরাহা হবে কী করে তা পেশ করেন। কিন্তু সবই বৃথা হয়।

১৯৫০ সালে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষর হওয়াতে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায় আরও ভেঙে পড়েন এবং ক্যাবিনেট থেকে পদত্যাগ করেন। এর কিছুকাল পরে ড. শ্যামাপ্রসাদমুখেপাধ্যায় হিন্দু মহাসভায় যােগ দেন। তিনি চেয়েছিলেন এই দলে যেন সকল বর্ণের মানুষের প্রবেশাধিকার থাকে। কিন্তু বাস্তবে চিত্র ছিল ভিন্ন।।

১৯৫১ সালে তার স্বপ্ন সার্থক হয় যখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঘচালক শ্রীগুরুজীর আশীর্বাদে তিনি ভারতীয় জনসঙ্ তৈরি করেন। ১৯৫২-রনির্বাচনে তিনি উত্তর কলকাতা থেকে জয়লাভ করেন এবং কতিপয় আসন জিতেও অন্য দলের সঙ্গে নিশে কংগ্রেসের বিরােধিতায় নামেন। পার্লামেন্টের তিনি বিরােধী দলনেতা নির্বাচিত হন।

কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায় খুবই বিচলিত বােধ করেন। ৩৭০ ধারার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালে তিনি কাশ্মীরে প্রবেশ করেন। কাশ্মীরে বহু মানুষের সমাগমে তিনি কাশ্মীরবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন যে ভারতের অন্য প্রদেশে যে সংবিধান চলছে, কাশ্মীরে সেই এক সংবিধানের নীতি প্রচলিত হবে। তিনি বলেন, “আমি আপনাদের ভারতীয় সংবিধানের ন্যায় বিচার দেব, নাহলে আমার জীবন দেব।” ১৯৫৩ সালে যখন শ্যামাপ্রসাদমুখােপাধ্যায় আবার কাশ্মীর ফিরে আসেন তখন কংগ্রেস পরিকল্পনা করছিল তাকে গ্রেপ্তার করার, কিন্তু তা না করে তাকে কাশ্মীরে প্রবেশ করতে দেওয়া হলােএবং গ্রেপ্তার করে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলাে। কারাগারে বন্দীদশায় তার মৃত্যু হয় যা আজও দেশবাসীকে ব্যথা দেয়।

একথা বলাই যায় যে, ঈশ্বরের প্রেরিত দূত হিসেবে হিন্দুদের ত্রাতা রূপে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায়ের আগমন ঘটেছিল । তিনিই পশ্চিমবঙ্গের সৃষ্টিকর্তা এবং শান্তিপ্রিয়, মুক্তিকামী, উদার সহনশীল হিন্দু বাঙ্গালিদের উদ্ধারকর্তা। হিন্দু বাঙ্গালিদের শ্যামাপ্রসাদ মুখেপাধ্যায়ের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণতি জানানাে উচিত। সেই কালজয়ী মহাপুরুষের আবির্ভাব না ঘটলে হিন্দু বাঙ্গালিরা এক অস্তিত্বহীন জাতিতে পরিণত হতাে।

সৌমিত্র সেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.