ভারতের প্রতি চীনের ঐতিহাসিক শত্রুতা এবং ভারতবাসীর দায়িত্ব

গত ১৭ জুন মধ্যরাত্রে চীনা সেনা নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে ভারতের কুড়িজন বীর সৈনিকের জীবনহানি ঘটিয়েছে। ভারতের বীর জওয়ানরাও অবশ্য এর যােগ্য প্রত্যুত্তর দিয়েছে।। চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী চীন-ভারত সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না দু’পক্ষের সেনাবাহিনীই। সেই নিয়ম অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্যবাহিনী নিরস্ত্র ছিল। নিরস্ত্র ছিল চীনা সৈন্যবাহিনীও। কিন্তু তাদের হাতে ছিল কাটা লাগানাে গদা। সেই গদার আঘাতেই তারা হত্যা করেছে ভারতের কুড়ি জনকে। চীনের এই নৃশংসতায় গােটা বিশ্ববাসী আজ স্তম্ভিত।। | ভারত সীমান্তে চীনের হামলা অবশ্য আজ নতুন নয়। অতীতেও এর নজির রয়েছে এবং সেই উদাহরণ খুব সুখকর নয়। ১৯৫০ সালেই ভারত ও চীনের একমাত্র মধ্যবর্তী দেশ (বাফার স্টেট) তিব্বতকে আক্রমণ করে গ্রাস করে চীন। স্বাধীনতার পর ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’নীতিতে কুঁদ হয়ে থাকা আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান কান দেননি চীনা ড্রাগনের আক্রমণে বিপন্ন তিব্বতের আর্তচিৎকারে। চীনের আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করেননি প্রতিবেশী বন্ধুদেশ তিব্বতকে। ফল ফলতে দেরি হয়নি, তিব্বতকে দখল করার ফলে চীনের সঙ্গে ভারতের সরাসরি সীমানা স্থাপিত হয়েছিল। আগ্রাসী প্রবৃত্তি অনুযায়ী চীন সীমানা লঙ্ঘন করে ঝাপিয়ে পড়েছিল ভারতের। ওপর ১৯৬২ সালে। তৎকালীন নিষ্ক্রিয় ভারত সরকার ব্যর্থ হয়েছিল সেই আক্রমণকে ঠেকাতে। চীন দখল করেছিল ভারতের ৬২ হাজার বর্গকিলােমিটার ভূখণ্ড। সেই বিপুল পরিমাণ ভূখণ্ডের গুরুত্ব অনুধাবন করতে ভুল করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। বিরােধীদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি। 1691666701, ‘Not a bled of grass grows there (সেখানে তাে একটা ঘাসও গজায় না, অর্থাৎ কৃষিকাজ হয় না)। কিন্তু তার গুরুত্ব ছিল অন্য জায়গায়, সমভূমিপ্রধান ভারত এবং মরুভূমিপ্রধান চীনের মধ্যে প্রাকৃতিক প্রাচীর নির্মাণকারী হিমালয় নিজের ভূপ্রাকৃতিক। অবস্থানের কারণেই বিশাল সামরিক গুরুত্বের অধিকারী। এখন সেই সামরিক সুবিধা ষােলাে। আনা উশুল করছে চীন। হিমালয়ের ওপরে অপেক্ষাকৃত উচু স্থানে প্রচুর পরিমাণ সমরােপকরণ মজুত এবং সময়ােপযােগী পরিকাঠামাে নির্মাণ করেছে চীন। প্রতি বছরে শতাধিক বার তারা ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করছে। হিমালয়ের উচ্চস্থান চীনের হাতে ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নিম্নভূমিতে অবস্থানরত ভারত সেই অনুপ্রবেশসমূহ ঠেকাতে প্রতি বছর খরচ করে কয়েক হাজার কোটি টাকা। ঘাস না গজানাে সেই কয়েক হাজার বর্গকিলােমিটার এলাকা ভারতের হাতে থাকলে সেই বার্ষিক অর্থব্যয় ভারতের না হয়ে চীনের হতাে। | শুধুমাত্র সামরিক গুরত্বই নয়, এই জায়গাটির অর্থনৈতিক গুরুত্বও যথেষ্ট। বর্তমানে সারা বিশ্বে পানীয় জলের ব্যবসা প্রায় কুড়ি হাজার কোটি ডলারের (টাকার মূল্যে প্রায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকা)। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এর পরিমাণ আগামীদিনে আরও বাড়বে তীব্র গতিতে। বর্তমানে অর্থনৈতিকবিশ্ব যদিখনিজ তেলের হয় তাহলে আগামী অর্থনৈতিক বিশ্ব হবে পানীয় জলের। পানীয় জলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাণ্ডার (পানীয় জলের বৃহত্তম ভাণ্ডার কুমেরু কোনও একটি দেশের অধিকৃত নয়, রাষ্ট্রপুঞ্জের সরাসরি আওতায়) হিমালয় নিজের হাতে থাকায় সেই অনাগত আগামীতে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে কী বিপুল সুবিধা পাবে এবং হিমালয় হস্তচ্যুত হওয়ায় আগামীর ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে কী বিপুল সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে তা চিন্তার বাইরে। এখানেই শেষ নয়, নদীমাতৃক ভারতবর্ষের প্রধান তিনটি নদনদীর অন্যতম ব্রহ্মপুত্রের উৎস সেই সময় থেকে চীনের দখলে।ইতিমধ্যেই সেই উৎসের পরবর্তী অংশে তারা বাঁধ নির্মাণ করেছে। যে কোনও মুহূর্তে তারা ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে অসম-সহ সমস্ত উত্তর-পূর্ব ভারত সংকটাপন্ন হবে।

আগ্রাসী চীন কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট নয়। হিমালয়ের বাকি অংশ এবং অরণাচল প্রদেশ-সহ সমস্ত উত্তর-পূর্ব ভারত তারা ছলে-বলে- কৌশলে দখল করতে চায়। হিমালয়ের বুকে অবস্থিত ঐতিহাসিক ভারতবন্ধু নেপাল আজ চীনের কৌশলে এবং পূর্বতন ভারত সরকারের উদাসীনতায় বর্তমানে কমিউনিস্ট প্রভাবিত হয়ে চীনের করালগ্রাসে। হিমালয়ে অবস্থিত আরেক ভারতবন্ধু ভুটান চীনের কৌশলের কাছে নতি স্বীকার না করায় সেখানে বল প্রয়ােগের আশ্রয় নিয়েছিল তারা।

পরিস্থিতি আজও সেই একই। পঞ্চাশের দশকে আক্রান্ত হয়েছিল বন্ধুদেশ তিব্বত। ২০১৭ সালে আক্রান্ত হয়েছিল ভুটান। এবারে আক্রান্ত হয়েছি সরাসরি আমরা। এবারকার মতাে ভারত সরকারের হুঁশিয়ারিতে চীন পশ্চাদপসরণ করেছে। তা বলে কর্তব্যকর্ম বিস্মৃত হলে হবে না। সেদিনের মতাে আজও যদি কর্তব্যকর্মে বিস্মৃত হই আমরা, তাহলে আগ্রাসী ড্রাগনের মুখগহ্বর আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না। বিবাদ শুধুমাত্র লাদাখ সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আমাদের উত্তরবঙ্গ সংলগ্ন সিকিম সীমানায়ও তারা আক্রমণ করবে। এবং তার পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের যােগাযােগের একমাত্র পথটিকেও (দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং নিয়ে গঠিত ‘চিকেন নেক আনবে নিজের অধিকারে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের যােগাযােগ বিনষ্ট হবার ফলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্র অরুণাচল প্রদেশ যাবে তাদের অধিকারে।

এ প্রসঙ্গে বলা যায়, অরুণাচল প্রদেশ-সহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতেও নেহরুর কোনাে লক্ষ্য ছিল না। এখানকার ভূপ্রকৃতি পাহাড়ি ঢালবিশিষ্ট হওয়ায় কৃষিতে এই অঞ্চল খুব পিছিয়ে। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। হিমালয়ের ঠিক প্রান্তদেশে অবস্থিত এই অঞ্চলটি হিমালয়ের বরফ গলা জলে সমৃদ্ধ থাকে সারা বছর। পাহাড়ি ঢাল বরাবর সেই জল প্রচণ্ড গতিতে নিম্নমুখী হয়। ফলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অরণাচল প্রদেশ-সহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত সােনার খনিসদৃশ। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধুমাত্র অরুণাচল প্রদেশেই বছরে এক লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারে, সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত মিলিয়ে পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। আজ ক্ৰমক্ষয়িষ্ণু খনিজ তেলের ভাণ্ডারের ওপর এবং ক্রমক্ষয়িষ্ণু খনিজ কয়লাজাত তাপবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল গােটা বিশ্বের শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্র যখন বিকল্প শক্তির সন্ধানরত, তখন এই বিপুল পরিমাণ জলবিদ্যুৎ ভারতীয় অর্থনীতির এক চিরস্থায়ী সম্পদে পরিণত হতে পারে। কিন্তু চীনের আগ্রাসী নীতির কারণে সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

চৈনিক আগ্রাসন শুধুমাত্র সিকিম, লাদাখ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে আবদ্ধ থাকবে তা নয়, তারা আক্রমণ করবে কাশ্মীর সীমান্তে, আর এখানে তাদের দোসর হবে তাদেরই প্রদেয় অস্ত্র ও অর্থে বলীয়ান পাকিস্তান। কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তান ও চীনের লােলুপদৃষ্টি আজকের নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের স্থলপথে যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম কাশ্মীরকে ভারতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলেছে এবং সেই কাজ করছে। চীনপ্রদত্ত অর্থবলে ও অস্ত্রবলে। চীন তার অথবর্ল ও অস্ত্রবলে শুধুমাত্র নিজেদের, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এবং সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা যে শুধুমাত্র ভারতের সীমান্তেরই ক্ষতি করছে তা নয়, সেই অর্থ ও অস্ত্রবল ভারতের অভ্যন্তরেও লাগানাে হচ্ছে। ভারতের ক্ষতি করার জন্য। মূলত কৃষিপ্রধান ভারত খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। ভারতের প্রায় আশিটি এমন জেলা আছে যে জেলাগুলি বিভিন্ন খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। জেলাগুলি মূলত মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও বিহারের কিছু অংশে অবস্থিত। এই খনিজ পদার্থের সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব হলে ভারত শিল্পে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত হতাে। কিন্তু ভারত শিল্পে স্বয়ম্ভর হলে চীনের বাজার নষ্ট হবে, চীন তার উৎপাদিত পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে পারবেনা। তাই চীন ভারতের শিল্পক্ষেত্রের এই বিপুল সম্ভাবনাকে নষ্ট করার জন্য এই জেলাগুলিতে মাওবাদীদের অর্থ ও অস্ত্র দ্বারা সাহায্য করছে। চীন প্রদত্ত অর্থ ও অস্ত্রবলে বলীয়ান মাওবাদীরা এই সমস্ত এলাকায় এমন অশান্তির পরিবেশ তৈরি করেছে যে এখানে ন্যূনতম পরিকাঠামাে তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে দেশের শাসনব্যবস্থা। ফলে ভারতের শিল্পে উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

ভারতের শিল্পোন্নয়নের সমস্ত সম্ভাবনাকে চীন অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চায়। ভারতকে তার উৎপাদিত পণ্যের বাজার এবং কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ হিসেবে রেখে দিতে চায়, ঠিক ঔপনিবেশিক আমলের ব্রিটিশের মতাে। বস্তুত, পলাশীর যুদ্ধের আগের মানদণ্ডধারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকের সঙ্গে আজকের চীনের কার্যপদ্ধতির অদ্ভুত সাদৃশ্য।

ভারতের সঙ্গে এই সর্বাত্মক শত্রুতা চীন শুধু ভারত সীমান্তে ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে করছে তাই নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও চীন ভারতের প্রতি একইরকম বৈরী ভাবাপন্ন। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের জন্য ভারতকে মনােনীত করা হয়েছিল। কিন্তু চীন ভেটো প্রয়ােগ করে ভারতকে সেই মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেছে। কূটনীতি জগতের নির্মম পরিহাস হলাে, চীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হয়েছে এবং তজ্জনিত কারণে ভেটো প্রয়ােগের অধিকারী হয়েছে ভারতেরই দয়ায়।

স্মরণ করা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ১৯৪৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ স্থাপিত হয়। বিশ্বযুদ্ধজয়ী চার দেশ অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের চার সদস্য দেশ হিসেবে ভেটো প্রয়ােগের অধিকার লাভ করে। ১৯৫৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ঠিক করে বিশ্বের বৃহত্তম মহাদেশ এশিয়ার একটি দেশকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করা হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপান তখন এশিয়ার প্রথম সারির দেশ হিসেবে গণ্য হতাে না। এশিয়ার বৃহৎ দুই দেশ। ভারত ও চীনের মধ্যে যে কোনও একটি দেশকে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য করার কথা পরিষদে গৃহীত হয়। কমিউনিস্ট চীনকে সমর্থন করে কমিউনিস্ট সােভিয়েত ইউনিয়ন আর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে সমর্থন। করে গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। সংখ্যাধিক্যে জয়ী ভারত তখন রাষ্ট্রপুঞ্জের। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য কিন্তু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সেই স্থায়ী সদস্যপদ গ্রহণ না করে চীনকে সেই পদ ছেড়ে দেন। কৃতঘ্ন চীন সেই উপকারেরই প্রতিদান দিচ্ছে আজ ভারতের বিরুদ্ধেই ভেটো প্রয়ােগ করে। অর্থাৎ বলা যায় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধতর করার জন্য যে যে উপাদনের প্রয়ােজন হয়, সেই উপাদানগুলি প্রচুর পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও আমরা নিজেদের। অর্থনীতিকে উন্নত করতে পারছি না চীনের জন্য। চীনের জন্যই কাশ্মীর থেকে সম্ভাব্য প্রাপ্য বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার আমাদের হস্তচ্যুত। চীনের জন্যইমধ্য ভারত থেকে সম্ভাব্য প্রাপ্য বিপুল খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার আমাদের। হস্তচ্যুত। সেই কারণেই আমাদের দেশের উন্নত মেধা আজ ব্রেন ড্রেনের মাধ্যমে বিদেশাভিমুখী। | এখন প্রশ্ন হলাে, চীন এত কিছু করছে। কীভাবে? চীন এত শক্তি পাচ্ছে কোথা থেকে? অত্যন্ত দুঃখের হলেও একথা সত্যি যে চীন এই শক্তি পাচ্ছে আমার আপনার পকেটের টাকা থেকেই। সাধারণ ভারতীয় ক্রেতা সস্তার মােহে পড়ে ভারতীয় পণ্যের বদলে চীনা পণ্য কিনে। ফেলেন, আর এর মাধ্যমেই প্রচুর পরিমাণ অর্থ ভারত থেকে প্রতি বছর চীনে চলে যায়। গত অর্থবর্ষে চীনের সঙ্গে ভারতের মােট বাণিজ্যের পরিণাণ ছিল প্রায় ৭০.৮ বিলিয়ন ডলার বা পাঁচ লক্ষ তেইশ হাজার ন’শােকুড়ি কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬১.৮ বিলিয়ন ডলার বা ৪ লক্ষ ৫৭ হাজার ৩২০ কোটি টাকা হলাে চীন থেকে ভারতে হওয়া আমদানি এবং মাত্র ৯ বিলিয়ন। ডলার বা ৬৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হলাে ভারত থেকে চীনে হওয়া রপ্তানি। অর্থাৎবাণিজ্য ঘাটতি হলাে ৫২.৮ বিলিয়ন ডলার বা ৩ লক্ষ ৯০ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। চীনের থেকে ভারতের আমদানির মধ্যে পেট্রোলিয়াম নেই, তবু এই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতির কারণ চীনে নির্মিত সস্তা পণ্যের ভারতীয় বাজারে ব্যাপক। বিক্রি হওয়া। কারও কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, চীনা জিনিস ব্যবহার করা যদি দেশের পক্ষে এতই ক্ষতিকর, তাহলে সরকার চীনা জিনিস ব্যবহার আইন করে বন্ধ করে দিচ্ছে না কেন? বর্তমানে বিশ্বায়নের পৃথিবীতে। আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে কোনও দেশই কিন্তু একটি বিশেষ দেশের সব পণ্য বিক্রি আইনত নিষিদ্ধ করতে পারে না।

তাহলে সমাধান কোথায়?সমাধান আছে। আমাদের বীর সেনারা সীমান্তে সংগ্রাম করবেন, কিন্তু অসামরিক জনসাধারণেরও দায়িত্ব আছে। ভারত-বিরােধী সব কাজই চীন করছে এবং করবে আমাদের দেশে বিক্রিত চীনা পণ্যের মূল্যবাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকেই। তাই জনসাধারণ যদি চীনের পণ্য না কেনেন তাহলে অর্থাভাবে চীন ভারত-বিরােধী কাজ করা থেকে বিরত থাকবে। ভারত সরকার চীনের সামগ্রী বিক্রি নিষিদ্ধ না করতে পারলেও কোনও বস্তু কেনা। বা না কেনা তাে সম্পূর্ণ ক্রেতার হাতে। চীনা পণ্যে ভারতীয় বাজার ছেয়ে গেলেও চীনা পণ্য কিনবাে কী কিনবাে না সেই সিদ্ধান্ত তাে সম্পূর্ণরূপে ক্রেতার নিজের। ক্রেতারা যদি চীন পণ্য না কেনেন, তাহলে বিশ্বায়ন সংক্রান্ত আইনসমূহও চীনের পণ্যকে ভারতের বাজার দখল করার সুযােগ দিতে পারবে না।

মনে হতে পারে এতবড়াে এক আন্তর্জাতিক শক্তি চীন, তারা আমাদের দেশের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে, শুধুমাত্র বয়কটকে অস্ত্র করে আমরা সাধারণ মানুষ কি পারবাে এত বড়াে এক শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে? করা যে যায়, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ইতিহাসের দিকে একটু তাকালেই। ১৯০৫ সাল ব্রিটিশ সরকার ঘােষণা করলাে বঙ্গভঙ্গ। শক্তিশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি Settled Fact’(স্থিরীকৃত সিদ্ধান্ত)-কে ভারতবাসী ‘Unsettled করে দিয়েছিল শুধুমাত্র ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করার মাধ্যমে। শুধুমাত্র ভারতীয়রা ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করা শুরু করতেই টনক নড়েছিল ব্রিটিশ সরকারের। বাধ্য হয়েছিল তারা পশ্চাদপসরণ করতে। এতে বঙ্গভঙ্গ প্রতিহত হয়েছিল। সেদিন দরিদ্র পরাধীন অস্ত্রহীন ভারতবাসী যা করতে পেরেছিল আজ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বের পঞ্চম এবং সামরিক শক্তির দিক দিয়ে বিশ্বের সপ্তম শক্তিধর দেশের নাগরিক ভারতবাসী আমরা কি তা করতে পারবাে না? অবশ্যই পারবাে, যদি সেদিনের মতাে আজও আমরা মায়ের দেওয়া মােটা কাপড় মাথায় তুলে নিতে পারি। যদি সেদিনের মতাে আজও দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে পারি তবেই আমরা চীনের আগ্রাসনকে সম্পূর্ণরূপে রুখে দিতে পারবাে।

অম্লানকুসুম ঘােষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.