গত ৩১ অক্টোবর ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের জন্মদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের সিদ্ধান্তকে তার চরণে সমর্পণ করেছেন। এখন উচ্চ প্রযুক্তির ফোনের সুবাদে সারা বিশ্বব্যাপী মোটামুটি বিখ্যাত ব্যক্তিদের জন্ম-মৃত্যু, কর্মকাণ্ড একটু নাড়াচাড়া করলেই পাওয়া যায়। তাই সেগুলো সকলেরই জানা। আলাদা কিছু জানার সুযোগ থাকে domain expart বা বিষয় বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেই। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ প্যাটেল বিষয়ে একটি বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করেছিল। স্বনামধন্য স্বাধীনতা সংগ্রামী মৌলানা আজাদেরই এক সময়ের কলকাতার বসতবাড়িতে যা আজ তাঁর নামাঙ্কিত সংগ্রহশালা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান ড. রাজশেখর বসুই ছিলেন। অনুষ্ঠানের একক বক্তা। প্রাক স্বাধীনতা পর্বের দীর্ঘ আন্দোলন ও স্বাধীনতা-পরবর্তী নবীন একটি জাতির নিজেকে সংহত করে বিশ্বের দরবারে উপযুক্ত করে তোলার সময়টির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন প্যাটেল। কিন্তু তার সমকালীন অনেক সহযোগীকে ঘিরেই একটা অতি মানবীয়তা বা ‘মিথ’তৈরির চেষ্টা হয়েছে। প্যাটেলকে নিয়ে সে প্রচেষ্টা হয়নি। তাই তাঁর জাতির। কল্যাণে নেওয়া সুদূরপ্রসারী। সিদ্ধান্ত গুলিকেও কখনও জনসমক্ষে আসতে দেওয়া হয়নি। এতে মানুষটিকে সম্পূর্ণভাবে জানার অধিকার থেকে দেশবাসী বঞ্চিত হয়েছে। ড. বোস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, এর মূলে ছিল কেবলমাত্র একটি পরিবারকেই ‘ফোকাসে রাখার অপচেষ্টা। তখনই প্রবাদ পুরুষ হয়ে ওঠা মহাত্মা গান্ধীও এ বিষয়ে মাথা ঘামাননি।
এ প্রসঙ্গে তৎকালীন তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের কারণে নেতারা একে অপরের প্রতি সৌজন্যবোধ কখনই হারিয়ে ফেললেন না। প্যাটেল যখন কৃষকদের দাবিতে বরদোলি সত্যাগ্রহে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন তিনি পুরোদস্তুর কৃষকনেতা। কিন্তু ১৯৩৫ সালে সারা ভারত কিষানসভা তৈরি হওয়া ও ১৯৩৭ সালে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাদেশিক কংগ্রেস সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর জমিদারদের হটিয়ে দেওয়া নিয়ে কংগ্রেসের বামপন্থী মনোভাবাপন্নদের সঙ্গে প্যাটেল একমত হতে পারেননি। পরবর্তীকালে সোভিয়েত 16607 folcu Galegos Pseudo socialist policy-তেও তার ভিন্নমত ছিল। সোভিয়েত মডেল অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প স্থাপনের তিনি বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু এই মডেলে যেহেতু সবটাই রাষ্ট্রের তরফে খরচা হয়ে যায়, তাই পাশাপাশি সঞ্চয় বাড়াতে তিনি বেসরকারি শিল্পদ্যোগের ওপরও সমান গুরুত্ব দিতেন। আজকের সারা বিশ্বে ব্যবসায়িক লেনদেনে লিপ্ত গুজরাট মিল্ক কোঅপারেটিভের পরিচালনায় ‘আমুল ব্রান্ডটি’ ৩৮ হাজার কোটি টাকার যে অর্থনীতি পরিচালনা করছে। তার সূচনাকর্তা ছিলেন ৭০ বছর আগে এই প্যাটেলই।
দেশে মানুষের স্বল্প খরচে বাসস্থানের সমস্যা মেটাতে হাউসিং সমবায় সমিতির পরিকল্পনা ও এ সংক্রান্ত প্রারম্ভিক নীতি-নির্ধারণেও ছিল তারই ভূমিকা। শুরু থেকেই মেয়েদের ক্ষমতায়নের ওপর তার নজর থাকায় আমূল থেকে শুরু করে সমস্ত ধরনের সমবায় প্রকল্পগুলিতে গোড়া থেকেই মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল। ৫৭৬ বা তার আশপাশের সংখ্যার দেশীয় রাজাদের ভারতভুক্তি বহুচর্চিত। হায়দরাবাদ বা কাশ্মীরে সামরিক অভিযান যাদের জানার তারা জানেন। কিন্তু ৮২ শতাংশ হিন্দুপ্রধান জুনাগড়ের নবাব (এখানকারই নবাবপুত্তুর ছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো) পাকিস্তানে ঢুকাতে মরিয়া হচ্ছিলেন। প্যাটেল জুনাগড়ের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রমাদ গুনেছিলেন, কারণ তখনকার ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সোমনাথ মন্দির ছিল এই জুনাগড় স্টেটেরই অন্তর্গত।
বহু বুঝিয়ে সুঝিয়ে প্রয়োজনে চাপ দিয়ে জুনাগড়ের স্টেট ভারতভুক্ত করতে সফল হয়েছিলেন তিনি। না হলে সোমনাথ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। বিষয়টা তার চেয়ে কেউ বেশি বোঝেনি, বললেন ড. বোস। মন্দির গড়তে গিয়েও স্বাধীনতার পর আবার সেই বিশ্বনেতা হওয়ার স্বপ্নে মশগুল প্রধানমন্ত্রীর কাছে সতর্কবাণী পেলেন। ভারতের মতো নতুন nation state-এর পক্ষে এই ধর্মভিত্তিক মন্দির নির্মাণকে সারা বিশ্ব হিন্দু Revivalism বলে নিন্দা করবে। এ বিষয়ে ড. বোস বিদগ্ধ বিষয়-পণ্ডিত কে এম মুন্সীর উল্লেখ করে বলেন সোমনাথ হিন্দুর অতীত ও হিন্দুর বর্তমানের যুগপৎ প্রতিনিধিত্ব করে। এই মন্দির বার বার বিদেশি আক্রমণকারী দ্বারা ধ্বংস হয়ে হিন্দুর যৌথ অবচেতনায় হীনমন্যতা সৃষ্টিকরে রেখেছে। (collective unconscious)। অদম্য আত্মসচেতন সেকুলারবাদীকে তিনি তার যাবতীয় অধীত বিদ্যা প্রয়োগ করেই মেনে নিতে বাধ্য করেন যে মন্দির নিয়তিনির্দিষ্ট।
একে বিলেতফেরত ব্যারিস্টার তার ওপর বাড়তি পণ্ডিত (সেটা যে কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ার দৌলতে সেটাও খুব প্রচারিত হয়নি) উপাধিধারীকে সমঝাতে তো নিজেরও কিছু সিন্দুকে থাকা। দরকার। হ্যা, সরদার প্যাটেলও পরাধীন। ভারতে ওকালতি পাশ করার পর বেশ কয়েকবছর আনন্দ জেলার বরসাদ শহরে প্র্যাকটিস করেন। পসার জমিয়ে ৩৬ বছর বয়সে তিনি বিলেতের প্রখ্যাত middle temple থেকে পুরোদস্তুর ব্যারিস্টার হয়ে ফেরেন। এখানে তো তার পসার ছিলই তবু তিনি দেশসেবাকেই বেছে নেন। এমন নয় যে আই এন এ বন্দিদের বিচারের সময় কোনো পণ্ডিতের বিচারবুদ্ধিতে আস্থা না রাখতে পেরেভুলাভাই দেশাইতাকে সরিয়ে নিজেই আজাদ হিন্দ বাহিনীর পক্ষে দাঁড়ান। ও ঐতিহাসিক সওয়ালের পর মামলা জেতেন। এটি অন্য প্রসঙ্গ হলেও প্যাটেলের ব্যবহারিক জীবনের সাফল্য ও ব্যক্তিগত চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় হিসেবেই তার রাজনৈতিক জীবনকেও যে প্রভাবিত করেছিল তারই প্রমাণ। এই ওকালতি সংক্রান্ত একটি চমকপ্রদ ঘটনাসূত্রে অধ্যাপক বোস বলেন একটি মামলার সওয়াল চলাকালীন তাকে খবর দেওয়া হয় যে তার স্ত্রী সদ্য মারা গেছেন। প্যাটেল মামলা শেষ করে মক্কেলের কোনো ক্ষতি না হতে দিয়ে বাড়ি ফেরেন। এই একটি ঘটনাই কর্তব্যনিষ্ঠা, আন্তরিকতাও চারিত্রিক ঋজুতা বোঝাতে ‘মিথ’ সমকক্ষ হওয়ার ক্ষমতাধারী হতে পারত। কিন্তু প্রায় অনুল্লেখিত অপরিজ্ঞাতই রয়ে গেল। সোমনাথ মন্দির নির্মাণের সাফল্যে হিন্দু ভারতে পরিচয় প্রতিষ্ঠায় সেকুলারি আক্রমণ তিনিই প্রথম প্রতিহত করেন। সেটিও তার বিস্মৃতির আবর্তে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে।
কোঅপারেটিভ, গৃহসমস্যা নিরসনের সঙ্গে ইংরেজের তৈরি আইসিএস-এর ধাঁচা ভেঙে দেশোপযোগী যে প্রশাসনিক কাজ পরিচালনায় আই এ এস প্রথা চালু হলো তারও সূচনাকারী ছিলেন প্যাটেল। আমেদাবাদ মিউনিসিপ্যালিটি পরিচালনার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা একমাত্র তাঁরই ছিল। সেই সুবাদে ভারতীয় প্রশাসনিক চাকরির প্রতিটি খুঁটিনাটি তারই হাত দিয়ে বেরিয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কংগ্রেসের ভেতর নেহরুপন্থী সেকুলারবাদীর সংখ্যা কম ছিল না। তবু‘দেশ প্রধান ও প্রথম এই নীতি থেকে প্যাটেল কখনও টলেননি। ড. বোস যথার্থই আচার্য কৃপালনীকে উদ্ধৃত 765 176676901— “Man of decision man of action’। দেশে কারোর কারোর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও প্যাটেলকে তেমন দেখা যায় না। তাই লিঙ্কন মেমোরিয়ালের মতো Statue of Unity তৈরির মাধ্যমে তাঁকে বহু দিনের প্রাপ্য সম্মানই জাতি অৰ্পণ করেছে। দিনটি ‘একতা দিবস’বলে ঘোষিত হয়েছে। এগুলি সবই তার জীবনচর্যায় অর্জিত। তাই সরকারের তরফে এটি প্রত্যার্পণ বই কিছু নয়।
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
2019-11-08