ধর্মরক্ষার্থে আত্মঘাতী হন জমিদার চিত্তরঞ্জন

অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর ইছাপুরা গ্রামে বাস ছিল আমার পূর্বপুরুষদের। এক বর্ধিষ্ণু, স্বচ্ছল পরিবার। পাকাবাড়ি, চাষের জমি, ঠাকুরদালান, পুকুর সমেত স্বচ্ছন্দে দিনযাপন করত। প্রতিবছর শরৎকালে নিয়ম করে অনুষ্ঠিত হতো দুর্গপুজো (যা বর্তমানে কলকাতার বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালের শেষের দিকে কপর্দক শূন্য হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল কেবলমাত্র প্রাণটুকু সম্বল করে। একই অবস্থা হয়েছিল আমার অধিকাংশ বর্তমান প্রতিবেশীদের। পাবনা থেকে সমতুল পরিস্থিতিতে আমার মামার বাড়ির পরিবারকেও দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। প্রশ্ন জাগে কেন, কী এমন ঘটেছিল তৎকালীন বাংলাদেশে, যার পরিণতিতে ভিটেমাটি ছেড়ে এই অসহায় মানুষগুলোকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল? আর কোন অবলম্বনের ভিত্তিতেই বা তারা পশ্চিমবঙ্গকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন? এই প্রতিবেদনে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার একটু চেষ্টা করব।
পূর্ববঙ্গে পূর্বপুরুষদের বসতবাড়ি, খেত, পুকুর, গৃহপালিত পশুপ্রাণী সব ছেড়ে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করে ‘উদ্বাস্তু বাঙ্গাল’ তকমা গায়ে নিয়ে নিঃস্ব হয়ে গঞ্জনার স্বীকার হতে হয় বারবার। স্বচ্ছল বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল হয় রিফিউজি ক্যাম্পে অথবা হোগলাপাতার ছাউনিতে। সুবিশাল জমির মালিকানা ছেড়ে জোটে সর্বসাকুল্যে আড়াই কাঠা কলোনির জমি। বিনা কারণে বা শখে কি তাদের এহেন দেশত্যাগ ? আজ অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেও তারা উত্তর দিতে পারে না বাংলাদেশের কোথায় তাদের বাড়ি ছিল। একি আমাদের জাতীয় লজ্জা নয় ? দেখা যাক কী এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ঘটনার আঁচ ধিকি ধিকি করে জ্বললেও দাবানলের আকার নিল নোয়াখালিতে হিন্দু নিধনের মধ্য দিয়ে।‘হিন্দু নিধন’শব্দটি ব্যবহার করলাম ‘দাঙ্গা’র বদলে। কারণ একতরফা হিন্দুরাই সেখানে লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত হয়েছিল প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলমানদের দ্বারা। অবাধে লুঠপাট, প্রাণহানি, নারী ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণ-সহ মানবতা বিরোধী সবপ্রকার ঘটনা সংঘঠিত হয়েছিলো নির্বিচারে। এই উন্মাদনা ও ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র পূর্ববঙ্গ জুড়ে, যার পরিণতিতেই দেশত্যাগ অভাগা হিন্দুদের। অবশেষে বঙ্গ বিভক্তকরণের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের জন্ম।
হিন্দু হত্যার নায়ক ছিল কুখ্যাত গোলাম সায়োয়ার নামক এক যুবক। সে মুসলিম লিগের নির্বাচনী টিকিট না পেয়ে দুরভিসন্ধি করেছিল হিন্দুদের গণহত্যা ও অত্যাচারের মাধ্যমে নিজেকে মুসলমান নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে।তৎকালীন নোয়াখালি বলতে বোঝাতো মেঘনা নদীর মোহনা লাগোয়া এক প্রত্যন্ত অঞ্চল, যা নোয়াখালি, লক্ষীপুর ও ফেনী জেলাগুলিকে নিয়ে একত্রে গঠিত। সালটা ১৯৪৬, লক্ষ্মী পূজার দিন অর্থাৎ (১০ই অক্টোবর)। শুরু হল অত্যাচার যা চলেছিল পরবর্তী একপক্ষকাল জুড়ে। উগ্র সাম্প্রদায়িক ও জেহাদি আগ্রাসনে প্রাণ গিয়েছিল শতশত হিন্দু নর-নারীর। এ তো কেবলমাত্র নোয়াখালিতে। এছাড়াও সমগ্র পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। শয়ে শয়ে হিন্দু নিধন শুরু হলো। ধর্মান্তরকরণ, হিন্দু সম্পত্তি দখল, নিরীহ হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণের মতো পাশবিক ঘটনাগুলি ঘটতে থাকল। সমগ্র পূর্ববঙ্গ জুড়ে। আতঙ্কিত, ত্রস্ত হিন্দুরা দলে দলে দেশত্যাগ করে পদ্মার পশ্চিমপাড়ে আশ্রয় নিতে থাকল। ইতিপূর্বেও ১৯৪১ সালে ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকাতে সংগঠিত ভাবে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করা হয়েছিল। সে দিনও ড. শ্যামাপ্রসাদমুখার্জি ছাড়া অন্য কোনো নেতা তাদের পাশে দাঁড়াননি। বিক্ষিপ্তভাবে তখন থেকেই সমগ্র পূর্ববঙ্গে হিন্দুশূন্য করবার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল, তা প্রথমে প্রয়োগ হলো নোয়াখালিতে। উকিল রাজেন্দ্রনাথ চৌধুরীর গোটা পরিবারের ২৬ জন সদস্যকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। নারায়ণপুরের জমিদার সুরেন্দ্রনাথ বসু ও তাঁর কর্মচারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। খিলপাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক নলিনী মিত্রের পরিবারকে জোর করে ধর্মান্তরকরণ; ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করায় মজুপুর গ্রামের এক নিরপরাধ দম্পতিকে কেরোসিন তেল ঢেলে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এহেন অসংখ্য ঘটনা যা সীমিত পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। হামলার তৃতীয় দিনে মহাবলী রায়পুর থানার সায়েস্তানগরের জমিদার চিত্তরঞ্জন দত্ত রায়চৌধুরীর বাড়ি আক্রন্ত হলে তিনি বীরবিক্রমে দস্যুদের সঙ্গে লড়াই করেন। অবশেষে নিজ ধর্ম রক্ষার্থে সপরিবারে আত্মহননের পথ বেছে নেন। গোপাইরবাগের দাস বাড়ি, নোয়াখালির চৌধুরী বাড়ি, বেগমগঞ্জের পাল বাড়ি-সহ বহু হিন্দু বাড়ির সকল সদস্য সদস্যাদের হত্যা করে জনশূন্য করে দিয়েছিল এই নরখাদকের দল। এমনকী সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিল যে বেগমগঞ্জ থানার বটগ্রামের এক বৃদ্ধ পাঠশালার মাস্টার মশাই শ্ৰীযুক্ত অক্ষয় চক্রবর্তীকেও তারা ছাড় দিল না। জোর করে ধর্মান্তরকরণের পরও চক্রবর্তী মশাই দুর্গানাম লেখা না ছাড়তে পারায় প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। এমনকী গোলাম সায়োয়ারের যে মাস্টার মশাই, অশীতিপর বৃদ্ধ হরিশ পণ্ডিতকেও সায়োয়ার বাহিনির হাতে প্রাণ দিতে হয়। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে এটা কিন্তু ‘মাকু -সেকু’দের দাবি করা তথাকথিত শ্রেণিসংগ্রাম’-এর ঘটনা ছিল না। কারণ সমাজের সকল শ্রেণীর হিন্দুরাই অত্যাচারের স্বীকার হয়েছিল। উচ্চবিত্ত জমিদার থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এমনকী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য, শূদ্র সকল শ্রেণীই এই ক্ষেত্রে অত্যাচারিত। গরিব চাষি, জেলে, ধোপা, নাপিত, কুমোর, কামার, উকিল-মোক্তার, ডাক্তার সবাই ছিন্নমূল হয়েছিলেন। সুতরাং অর্থনৈতিক বৈষম্য এর কারণ নয়। ঘটনার মূল হলো সাম্প্রদায়িকতার জেহাদি আগ্রাসন।নিরীহ মানুষগুলির অপরাধ ছিল তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
গান্ধীজী নিজে পদযাত্রা করে হিন্দুদের ঘরে ফেরাতে সচেষ্ট হলেও তার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কারণ পুনরায় আক্রমণে ওই হতভাগ্য পরিবারগুলিকে একবছরের মধ্যেই কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য করা হয়।
ভারত কেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছিলেন সেদিন হিন্দুদের পরিত্রাতা। দাঙ্গা বিধ্বস্ত পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা দেশত্যাগ করে প্রাণ বাঁচাতে পশ্চিমভাগের দিকে অগ্রসর হলেও সকলে নিস্তার পেলেন না। রক্তপিপাসুদের দল রাস্তায় ও ট্রেনে উঠেও তাদের পাশবিক হত্যালীলা সংঘটিত করেছিল। ট্রেনভর্তি মৃতদহ সারি শিয়ালদহের স্টেশনে পৌছাত। সে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। হিন্দুদের এই চরম দুর্দিনে শ্যামাপ্রসাদ নোয়াখালি-সহ পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের পাশেই শুধু দাঁড়ালেন না, বলিষ্ঠ ও দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন এই জোর করে ধর্মান্তকরণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, তাদেরকে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনতে হবে। এমনকী যাদের জোর করে গোমাংস ভক্ষণ করানো হয়েছে বা যেসকল নারী ধর্ষিত হয়েছেন তাদের প্রত্যেককে কোনো ধর্মীয় গোড়ামি বা কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করানো যাবেনা।তারা হিন্দু ছিলেন, হিন্দুআছেন, হিন্দুই থাকবেন। যা ঘটেছে তা তাদের সম্পূর্ণ অনিচ্ছাবশত। যেসকল কুমারীকে জেহাদিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, দ্রুত তাদের উদ্ধার করে বিবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিস্থিতি বিচার করতে হবে মানবিকতা দিয়ে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। কারণ কোনোরূপ সংকীর্ণতা এক্ষেত্রে হিন্দুধর্মের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বহু নর-নারী সসম্মানে যাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করাহয়েছিলো, হিন্দুধর্মে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিল। একদিকে কলকাতা ‘গ্রেটা ক্যালকাটা কিলিং’-এ ক্ষতবিক্ষত, অপরদিকে নোয়াখালি-সহ সমগ্র পূর্ববঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া হিন্দু নিধন—দলে দলে হিন্দুদের বাধ্য করেছিল নিজেদের বহু পুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতা সহ পদ্মার পশ্চিমপাড়ে চলে আসতে। ঢাকার গ্রামীণ অঞ্চলের ভয়াবহ জেহাদি আগ্রাসন সেদিন আমার হতভাগ্য পরিবারকেও বাধ্য করেছিল দেশত্যাগ করতে।
হুসেন সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বে সংঘটিত ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ রক্তস্নাত করেছিল কলকাতার রাস্তাঘাট। তখনও সেই বিভীষিকা বহন করছে কলকাতা। কিন্তু কংগ্রেসি নেতা যেমন শরৎ চন্দ্র বসু, কিরণ শংকর রায় প্রমুখও সোহরাওয়ার্দির কুচক্রী জালে জড়িয়ে পড়লেন। তারাও স্বপ্ন দেখতে থাকলেন এক সার্বভৌম অখণ্ড বাংলাদেশ গঠনের। এই চক্রান্তে মদত দিয়েছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না, গভর্নর বারোজের, বড়লাট মাউন্টব্যাটেন, লিয়াকত আলি প্রমূখ। সেদিন যে ব্যবস্থাপক সভা গঠনের পক্ষে শরৎচন্দ্র বসুরা মত দিয়েছিলেন তাতে আদপেও কোনো ধর্মীয় ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি। ১৪ জন হিন্দু ও ১৬ জন মুসলমানকে নিয়ে সভা গঠনের মাধ্যমে চক্রান্ত করা হয়েছিল ধর্মীয় মেরুকরণের। ড. মুখার্জী প্রমাদ গুনলেন। বুঝতে পারলেন কী সর্বনাশ ঘটতে চলেছে। ইতিপূর্বেই ভারত যাতে ভাগ না হয় তার জন্য তিনি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিলেন। এমনকী মুসলমান নেতৃত্বের কাছে তার প্রস্তাব ছিলো মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে নিয়ে প্রাদেশিক সীমানার পুনর্বিন্যাস করেও অখণ্ড ভারতের কাঠামোর মধ্যে থেকেই তারা পাকিস্তানের সাধ পূরণ করতে পারেন। তিনি f7216491— “We can legitimately ask that if the communal problem is really capable of an amicable adjustment under Pakisthan Scheme, Why should not that adjustment be made in existing or re-distributed provincial spheres without the vivisection of India. If the claim is put forward that certain zones predominantly Moslem should remain under the control of their own government so as to advance Moslem interests, it is possible to achieve this, if desired, by a proper redistribution of the provincial boundaries which will not be harmful to the solidarity and stability of a particular zone”.
এমনকী মুসলমান-অধ্যুষিত অঞ্চলে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়েও তিনি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি এই প্রসঙ্গে বললেন ঃ “But even in such as event, there will still be a small percentage of non-Moslem inhabitants enjoying equal citizenship and one may well ask what exectly will be the method of safeguarding their rights and privileges”। দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুই প্রকার বিপদের আশঙ্কা করে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করলেন :
“I have analyzed in some details that two dangers that stand in the way of our future national progress. One is British determination to keep us in bondage as long as it possibly can. The other is the growth of an undefined Pakistan outlook which, if not counteracted, is bound to inflame more and more the minds of masses and their leaders with a dream of Moslem Raj in India.”
ভারতের মাটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রতিষ্ঠার চিন্তা ত্যাগ করে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলবন্ধন ও পারস্পর্যের ভিত্তিতে সুখী ও স্বাধীন ভারত গঠনের উপদেশ Thomas — “It is only when Hindus and Moslems will stand together, strong, fearless and well trained, both un derstanding each other’s point of view and realising that it is not Hindustan and Pakistan they now live-in but Englishstan in the truest sense of the word, they will then unite for the attainment of their country’s freedom. যে পথে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া সম্ভব তাও তিনি নির্দেশ করেছেন—“Let each of them follow his own religion, pursue his own culture, contribute to the growth of a common civilisation, imbibing the best elements of both. Let them regard themselves not as belonging to two separate nations that cannot amicably live together, but as two arms of the greatmother which by virtue of their strength and unity will protect her truest interest now and for generations yet unborn”.
এই প্রসঙ্গগুলো উত্থাপন করলাম প্রামাণ্য দলিল হিসাবে। কারণ ইতিহাস না জেনে আজও শ্যামাপ্রসাদের মহত্ত্বকে খর্ব করবার জন্য কেউ কেউ দেশভাগের জন্য তাঁকে দায়ী করেন। এত কিছুর পরও শ্যামাপ্রসাদ দেশভাগ আটকাতে পারলেন না। কারণ সীমিত রাজনৈতিক শক্তির জন্য তার পক্ষে একাধারে মুসলিম লিগের পাকিস্তান দাবি, অপর দিকে ক্ষমতা লিপ্সায় জর্জরিত কংগ্রেস নেতৃবর্গের তাৎক্ষণিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টাকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিহত করা সম্ভবপর ছিল না, কিন্তু তিনি ও তার বিশিষ্ট সহযোগী প্রখ্যাত আইনজ্ঞ নির্মল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ উদ্যোগে ‘ক্রিপ্টস্ কমিশন গঠনের মাধ্যমে বার্তা দিলেন বঙ্গবিভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সকল বাঙ্গালির কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করা উচিত। যার ফলশ্রুতি আজকের পশ্চিমবঙ্গ। তা না হলে দেশভাগের সময় গঙ্গার পূর্বপার পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতো। আর তথাকথিত নেতা যারা কলকাতায় বসে শ্যামাপ্রসাদকে ‘সাম্প্রদায়িক তকমা লাগিয়ে স্বর্গসুখ অনুভব করেন, তাদেরও আজ বাংলাদেশে বসে থাকতে হতো! শ্যামাপ্রসাদ দেখালেন অখণ্ড বঙ্গে মোটেই মুসলমান প্রাধান্য নেই। সুতরাং দেশভাগের সময় পাকিস্তান গঠনের দাবির ক্ষেত্রে পুরো বঙ্গ কখনই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। পদ্মার পশ্চিমভাগ যা হিন্দুপ্রধান তা অন্তর্ভুক্ত হবে ভারতের। সেদিন শ্যামাপ্রসাদ অত্যন্ত সফলভাবে আইনসভার হিন্দু সদস্যদের তার এই প্রাসঙ্গিক দাবি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলশ্রুতি ২০শে জুন ১৯৪৭, সিদ্ধান্ত গৃহীত হল বঙ্গ দ্বিধা বিভক্ত হবে। হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ ভারতের আর মুসলিম। প্রধান পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। ভারতকেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদের উদ্যোগেই সেদিন পশ্চিমবঙ্গ গঠিত হয়েছিল। তাই ‘পশ্চিমবঙ্গ’এই নামকরণেরও একটি ইতিহাস রয়েছে, যাকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে শ্যামাপ্রসাদের উজ্জ্বল ইতিহাসকে অবমাননার শামিল।
যারা সেদিন দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে অতিদ্রুত ক্ষমতা দখলের জন্য দেশকে টুকরো করেছিল, তারাই হঠাৎ করে হয়ে উঠলেন পরম শ্রদ্ধেয়, দেশপ্রেমিক, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় নেতা। আর তৎকালীন বাঙ্গের কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লিতে হিন্দু সদস্যদেরকে বুঝিয়ে ড. মুখার্জি রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গ ভাগের পক্ষে। কারণ দূরদর্শী শ্যামাপ্রসাদ বুঝেছিলেন অখণ্ড বঙ্গ পাকিস্তানে গেলে হিন্দুদের নিরাপত্তা সম্পূর্ণরূপে বিপন্ন হবে। তাই তিনি হয়ে উঠলেন ‘সাম্প্রদায়িক! যেহেতু তিনি হিন্দু নিরাপত্তার কথা সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন 498 ‘Complete population exchange’ অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া দেশে পূর্ণরূপে ধর্মের ভিত্তিতে জনবিনিময়ের দাবি তুলেছিলেন (যদিও তা গৃহীত হয়নি), তাই তাঁর সৃষ্টি করা হিন্দুদের বাসযোগ্য ভূমি পশ্চিমবঙ্গে কিছু হিন্দু নেতার কাছেও হয়ে উঠেছিলেন ‘সাম্প্রদায়িক’। সম্ভবত তার জনপ্রিয়তাই তাদের ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছিল। তার বিরাট অপরাধ ছিল নিরাপদে হিন্দুদের বাসযোগ্য ভূমির দাবি করা। ধন্য বিচক্ষণতা! এই প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের সংসদ ভবনে এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু যখন বঙ্গভাগের জন্য তাঁকে দায়ী করেছিলেন, উত্তরে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন “আপনারা ভারতবর্ষকে ভাগ করেছেন, আর আমি পাকিস্তানকে ভাগ করেছি।” মহম্মদ আলি জিন্নারও প্রবল আগ্রহ ছিল কলকাতার উপর।শ্যামাপ্রসাদের উদ্যোগে মুসলিম লিগ কলকাতাকে তো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে পারলই না, উপরন্তু পঞ্জাব (পূর্ব)ও হাতছাড়া হলো। এই প্রসঙ্গে জিন্না বললেন “এই পোকায় কাটা পাকিস্তান আমার চাই না।”
শ্যামাপ্রসাদের তাৎক্ষণিক ও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তের জন্যই আজ আমরা পশ্চিমবঙ্গে বাস করতে পারছে। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত অসংখ্য হিন্দু বাঙ্গালি শরণার্থী হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছেন।কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় সামান্য রাজনৈতিক স্বার্থে যদি মুসলমান অনুপ্রবেশ ঘটানো হয় তবে ভারসাম্য নষ্ট হবে। আশঙ্কা হয় দেগঙ্গা ধুলাগড়, ক্যানিং বা সদ্য ঘটা সন্দেশখালির মতো ঘটনাগুলি দেখে। এগুলি কীসের ইঙ্গিত বহন করছে। শ্যামাপ্রসাদের মতো পরিত্রাতা কোথায় যিনি নিঃস্বার্থভাবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করবেন হিন্দু বাঙ্গালিদের রক্ষার্থে। তাই পুনরায় উদ্বাস্তু হলে এই হিন্দুদের আশ্রয়স্থল কী হবে? দুঃশ্চিন্তা হয়। ঘরপোড়া গরুতো তাই সিন্দুরে মেঘ দেখলে ভয় হয়। আজ এত বছর পরেও শ্যামাপ্রসাদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। পাশ্ববর্তী দেশে (বাংলাদেশে) তথাকথিত পরধর্ম সহিষ্ণু । সরকারের আমলেও হিন্দু নির্যাতন ও সম্পত্তি দখল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্বাস্তু হিন্দুরা, শরণার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে আজ যার জন্য নিশ্চিন্তে বসবাস করছে, দুর্ভাগ্য একবারের জন্যও অধিকাংশই তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে না। উদ্বাস্তু শরণার্থী সম্পর্কে শ্যামাপ্রসাদের বলিষ্ঠ চিন্তা হলো তাদের আশ্রয় দিতে হবে, কারণ ধর্মীয় কারণে তারা বাস্তুভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। কিন্তু মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থে তারা কোনো পররাষ্ট্রে প্রবেশ করে। এদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। অবিলম্বে এদের ফেরত পাঠাতে হবে। সুতরাং চিহ্নিতকরণ ও নাগরিক পঞ্জি (NRC) গঠন অত্যন্ত জরুরি। তাই পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিবসের প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালির পরিত্রাতা, ভারতকেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বিনম্রচিত্তে তার পাদপদ্মে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু বাঙ্গালিরা যতদিন থাকবেশ্যামাপ্রসাদ অক্ষয় ও অমর হবেন। হিন্দু বাঙ্গালি বিশেষত উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙ্গালিরা কোনোদিনই শ্যামাপ্রসাদের স্বর্গীয় ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না।
শুভদীপ গাঙ্গুলী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.