সম্প্রতি আমাদের সপ্তদশ লোকসভা গঠনের জন্য দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন
হয়ে গেছে। এর গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এর ফলের ওপরেই নির্ভর করে সরকার
গঠনের কাজটা। নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধান রচয়িতারা সরকারের ওপর আদৌ
নির্ভর করতে চাননি, কারণ তাতে রাজনীতির স্বার্থবোধ নির্বাচন-ব্যবস্থাকে
কলুষিত করার ফাক থেকে যেতে পারে। গণপরিষদে হৃদয়নাথ কুর বলেছিলেন,
‘democracy will be poisoned at the root। এই কারণে তারা একটা নির্বাচন
কমিশন গঠনের ব্যবস্থা করেছেন যার কাজ হলো সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠিত করা। আর সেই সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে তারা একটা পৃথক অধ্যায়ও।
সংবিধানে রেখেছেন। এমএল সিক্রির ভাষায়— ‘India is perhaps the only
country which has a chapter self-contained on the election in its
constitution’— (ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ৯৫)। এতে
বলা হয়েছে নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রনয়ণ নির্বাচন-তদারকি,
পরিচালনা, ফল ঘোষণা ইত্যাদির জন্য একটা নির্বাচন কমিশন থাকবে। তার থাকবে
স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য। এই জটিল কাজের জন্য কমিশন কেন্দ্র ও রাজ্যের
কাছে কর্মীবাহিনী চাইবে এবং নির্বাচন কর্মীরা তখন কমিশনের হয়েই কর্তব্য
পালন করবেন।এই বিস্তারিত ও জটিল ব্যবস্থা রাখা হয়েছে একটাই কারণে।
গণতন্ত্র আসলে জনগণের শাসন নির্বাচনের মাধ্যমেই স্থির হয় কারা শাসন
ক্ষমতায় বসবেন। সুতরাং নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বাধীন, স্বচ্ছ ও
ন্যায়-ভিত্তিক মতেই হবে। ড. বি সি রাউত মন্তব্য করেছেন, “The success of
democracy depends upon fair and free election— (ডেমোক্র্যাটিক
কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২০১)। এই কারণেই রচয়িতারা এই ব্যাপারে
সতর্কতা ও উদ্বেগ দেখিয়েছেন। যাতে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নির্বাচন
প্রক্রিয়াকে কুক্ষিগত করতে না পারে, সেই জন্য সংবিধান পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও
নিয়েছে। ড. হরিহর দাস মন্তব্য P651650, ‘Thus, elections in our country
are centralised under the sole control of a single integrated body’–
(ইন্ডিয়া : ডেমোক্র্যাটিক গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ৩৩৫)।শান্তি ও
শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে নির্বাচন শেষ করার জন্য কমিশন পর্যাপ্ত রাজ্য-পুলিশ ও
কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিয়োগ করতে পারে, রাখতে পারে যথেষ্ট সংখ্যক
পর্যবেক্ষক ও প্রতিনিধি।
এত কিছু সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের
নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও স্বাধীনভাবে হচ্ছে না। ৩২৬নং অনুচ্ছেদ
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীকে ভোটাধিকার দিয়েছে যাতে তারা স্বাধীনভাবে
পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন। পরোক্ষ গণতন্ত্র এভাবেই বুলেটকে
সরিয়ে ব্যালটের ব্যবস্থা করেছে।
কিন্তু ক্রমে বুলেটই কার্যত ব্যালটকে
নিয়ন্ত্রিত করে চলেছে দীর্ঘকাল ধরে। স্বাধীনতার পর প্রথম দিকে কিছু কিছু
ছাপ্পা ভোট পড়ত, দু-এক জায়গায় বচসা হতো, কেউ কেউ ফিরে আসতেন ভোট না
দিয়েই। এখন কিন্তু নির্বাচনের সঙ্গে অপরাধ জগৎ জড়িয়ে গেছে, রাজনীতি ও
গুন্ডামি একত্রিত হয়েছে। বুথ-জ্যা, বুথ দখল, দাঙ্গা, হামলা, ভীতি
প্রদর্শন, প্রাণনাশ, নির্বাচনকর্মীর ওপর আক্রমণ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো
নির্বাচনের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গেছে। ড. এ. সি. কাপুর লিখেছেন, ‘capturing
of polling booths has now become a routine process by organised and
armad gange of hood-lums’— (দ্য ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সিস্টেম, প. ৪২৫)।
তাঁর মতে, এই ব্যাপারে শীর্ষ স্থানে আছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং
পশ্চিমবঙ্গ—(Bihar, West Bengal and UP fell pray to the violence and the
Police had to report to firing’—ঐ)। এর পেছনে আছে রাজনৈতিক কর্ম ও তাদের
কিছু নেতা।তাই প্রত্যেক নির্বাচনে গুলি চলে, বোমাবাজি হয়। বহু মানুষ তাতে
হতাহত হন। বাদ যান না প্রিসাইডিং অফিসার ও অন্যান্য নির্বাচন-কর্মীরা। কারও
কারও খণ্ডিত মৃতদেহ পাওয়া যায় নিকটবর্তী রেললাইনে।
এবারের নির্বাচনেও
এর ব্যতিক্রম ঘটেনি— বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গ সগৌরবে এই বিষয়ে শীর্ষস্থান
দখল করেছে। এই অরাজকতাকে রোধ করার জন্য কমিশন নতুন নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে।
কিন্তু এ.এস. সি.কাশ্যপ জানিয়েছেন, এই নিয়ে কোনো কোনো সরকার বিরূপতা
প্রকাশ করেছে—(আওয়ার কনস্টিটিউশন, পৃ. ২৫৬)।
নির্বাচনের আগে থেকেই
বিভিন্ন নেতা প্রচারের নামে কুৎসা-খেউড় শুরু করেছিলেন। তাতেই বোঝা
গিয়েছিল যে, এবার কমিশনের কাজটা কঠিন হবে। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গে কিছুদিন
আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামে যে নির্লজ্জ প্রহসন ঘটেছে, তাতে আশঙ্কাটা
বেড়ে গিয়েছিল। এই কারণে কমিশন নির্বাচনকে পাঁচ দফা—এমনকী, উত্তরপ্রদেশ ও
পশ্চিমবঙ্গে সাত দফায় ভাগ করেছিল। তার যুক্তি ছিল, এতে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও
পর্যবেক্ষকদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব জায়গায় নেওয়া যাবে। তাতে কেউ কেউ
ক্ষুব্ধ হয়েছেন, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছেন। কেউ কেউ জানিয়েছিলেন
কেন্দ্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে টাকা ছড়ানো হয়েছে। কেউ বলেছেন— কমিশন
কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে কাজ করছে। কেউ ই.ভি.এম.-এ কারচুপির অভিযোগও
তুলেছেন।
এটা লক্ষণীয় যে, পূর্ব-অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনেক জায়গায়
নির্বাচন কর্মীরাই তাদের ও ভোটারদের নিরাপত্তার জন্য প্রত্যেক বুথে
কেন্দ্রীয় বাহিনী রাখার দাবি তুলেছিলেন। তার ফলে ক্রমে এই বাহিনীর সংখ্যা
বাড়ানো হয়েছে। কয়েকজন পর্যবেক্ষক মাইক্রো অবজার্ভার, বিশেষ নজরদারি
ইত্যাদির ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু কিছুই কাজে দেয়নি। বিশেষ করে, এই রাজ্যে
ভোটের দিন এমনকী, পরবর্তী দিনগুলোতেও অশান্তি, রক্তপাত, সংঘর্ষ, গুলি বোমা
ইত্যাদি চলেছে প্রায় অবাধে।
অবশ্যই নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও অবাধ রাখা
নির্বাচন কমিশনের কাজ। কিন্তু এই ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো ও বিভিন্ন
সরকার সহযোগিতা না করলে আসল কাজটা হতেই পারে না।
আসলে, সমস্যাটা হলো–
আমাদের নেতারা মনে রাখেন না যে, একটা নির্বাচনই শেষ কথা নয় উত্থান-পতন
আছে। শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস দল একচ্ছত্র ক্ষমতা হারিয়েছে। এবার তাদের
আসনসংখ্যা ৫২। সঙ্গীদের নিয়ে ৯৪। এই রাজ্যে ৩৪ বছর একাদিক্রমে ক্ষমতায়
থাকলেও বামপন্থীরা একটা আসনও এবার পাননি—৪০ জনের মধ্যে ৩৯ জনেরই জামানত
বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সুতরাং বিজয়ীদের উচিত তাদের জয়ের কারণগুলো অব্যাহত
রাখা, আর পরাজিতদের উচিত ব্যর্থতা নিয়ে পোস্টমর্টেম’ করা। কিন্তু দুঃখের
বিষয় এই ধরনের এলেম অধিকাংশ নেতারই নেই। তাই ক্ষমতা রক্ষা বা দখলই তাদের
জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছে। নেতা, গুন্ডা, পুলিশ ও কিছু আধিকারিকের মাঝে
মাঝেই মহামিলন ঘটে। কমিশন অনেক সময়। কর্মী ও অফিসারদের বদলিও করে।
১৯৮২
সালে বিজেপি প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করে মাত্র ২টো আসন পেয়েছিল।
সেই দলই কেমন করে ৬ বার কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসেছে, ২৯টা রাজ্যের মধ্যে ২১
টাতে সরকার গঠন করেছে এবং এবার একাই ৩০১ টা এবং সঙ্গীদের নিয়ে ৩৫২টা আসন
দখল করেছ, সেই রহস্যটা নিপুণ ভাবে ভেদ করতে হবে— বিরোধীদের এটাই হবে প্রধান
কাজ। লাগাতার ‘রাফাল’ নিয়ে নিন্দা, সুপ্রিম কোর্টে ক্ষমা চাওয়া, অন্যকে
সাম্প্রদায়িক বলে গালি দিয়ে মন্দিরে মন্দিরে ‘শিবভক্ত ব্রাহ্মণ’ সাজা,
একই সঙ্গে ঈশ্বর ও আল্লা বলে প্রগতিশীল সাজা, সেনাবাহিনীর কৃতিত্ব নিয়ে
প্রশ্ন তোলা, পাকিস্তানের প্রতি প্রীতি প্রদর্শন, ইমাম ভাতা প্রদান, এন আর
সি নিয়ে অপপ্রচার ইত্যাদি দিয়ে। কাজ হয় না। বস্তুত নোটবন্দি, জিএসটি,
‘চৌকিদার চোর হ্যায়’, ‘চা-ওয়ালা’ইত্যাদি নিয়ে প্রচার দেশের অধিকাংশ
মানুষকে আদৌ প্রভাবিত করতে পারেনি। তাছাড়া ঘটেছে। ‘হিন্দুত্ব’
প্রতিক্রিয়াও। আর ২১টা দলের নেতাদের নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা পুরোপুরি
ব্যর্থ হয়েছে। কেউ এই ধরনের ‘সবাই রাজা’র রাজত্ব চাননি। তবে একটা কথা
বুঝলাম না— নির্বাচন কমিশনের কাছে ২০০০-এর বেশি রাজনৈতিক দলের নাম নথিবদ্ধ
আছে— এনডিএ-র বাইরের সবাইকে জোটের জন্য ডাকা হলো না কেন? দেশবাসী তাহলে
একটা ডামাডোল দেখতে পেতেন।
সব শেষে একটা কথা বলি। হিন্দুত্বের জাগরণ,
এনডিএ নেতৃত্বের সুশালীন রাজনীতি, বিচক্ষণ বৈদেশিক কূটনীতি, মজবুত
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্থায়িত্ব ব্যবস্থা ইত্যাদি তার সাফল্য এনে
দিয়েছে। এটা লক্ষণীয়, উত্তরপ্রদেশে ৮০টির মধ্যে ৬২টা, অসমে ১৪ টার মধ্যে
৯টা, গুজরাটে ২৬টার মধ্যে ২৬টা, মহারাষ্ট্রে ৪৮টার মধ্যে ২৬টা, হরিয়ানার
১০টার মধ্যে ১০টা, মধ্যপ্রদেশে ২৯টার মধ্যে ২৮টা, বিহারে ৪০টার মধ্যে ১৭টা,
ছত্তিশগড়ে ১১টার মধ্যে ৯টা, হিমাচলের ৪টার মধ্যে ৪টা, রাজস্থানে ২৫টা
মধ্যে ২৪টা, জম্মু-কাশ্মীরে ৬টার মধ্যে ৩টা, উত্তরাখন্ডের ৫টার মধ্যে ৫টা,
ত্রিপুরার ২টার মধ্যে ২টা, ঝাড়খন্ডের ১৪টা আসনের মধ্যে ১১টা, দিল্লির
সবগুলো (৭), কর্ণাটকের ২৮টার মধ্যে ২৫টা, অরুণাচলের ২টার মধ্যে ২টা আসন
এনডিএ দখল করেছে। ওড়িশা (৮), পঞ্জাব (২), গোয়া প্রভৃতি রাজ্যেও বিজেপি
ভালো ফল করেছে। এমনকী পশ্চিমবঙ্গের নেত্রী তার খাতায় বিজেপিকে শূন্য
দিয়েছিলেন সেটা এক অদ্ভুত ম্যাজিকে ১৮ হয়ে গেছে। সুতরাং বলা যায়— জয়টা
হয়েছে। সার্বিক ও সর্বভারতীয়।
প্রধানমন্ত্রীর পদটা উত্তরাধিকারসূত্রে
রাহুল গান্ধীরই পাওয়ার কথা ছিল। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দাবি ছিল—
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা গঠনের ব্যাপারে তারই মুখ্য ভূমিকা থাকবে। কারণ ‘২০১৯
বিজেপি ফিনিশ’ হবে। চন্দ্রবাবু নাইডু প্রমুখ নেতাও অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন।
কিন্তু কথায় বলে গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল। চন্দ্রবাবুকে নিজের রাজ্যপাটই
হারাতে হয়েছে।
কিন্তু এখন জরুরি কাজ একটাই। খুঁজতে হবে কারণ বিশেষ
পর্যবেক্ষক অজয় নায়েক কেন বলেছেন বিহারের চেয়েও এই রাজ্যে ভোট করা কঠিন?
কেন? কেন তিনি আর আসবেন না?
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত
2019-06-23