তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী তালিকা দেখে আপনি কি খুব উল্লসিত? তালিকায় তারকাদের প্রাধান্যে আপনি কি ভাবছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এটা একটা মাস্টারস্ট্রোক? তাহলে আসুন, সবার আগে এই সব তারকাদের একটু যাচাই করে নেওয়া যাক কতকগুলি তথ্য এবং তত্ত্বের ভিত্তিতে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী তালিকায় ছিলেন দেব (দীপক অধিকারী), মুনমুন সেন (শ্রীমতী দেববর্মা), সন্ধ্যা রায়, শতাব্দী রায় এবং মঞ্চাভিনেত্রী অর্পিতা ঘোষ। চলুন দেখে নিই, সাংসদ হিসেবে সংসদের হিসাবে এঁদের ভূমিকা কেমন ছিল। পার্লামেন্টের হিসাব জানাচ্ছে ২০১৪ সালের নির্বাচনোত্তর সংসদের অধিবেশনে সাংসদ প্রতি গড় হাজিরা ছিল ৮০ শতাংশ। সাংসদ প্রতি বিতর্কে অংশগ্রহণের গড় হিসাব ৬৭.১ শতাংশ আর বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে মাথাপিছু ২৯৩টি। এবার দেখা যাক, তৃণমূল কংগ্রেসের তারকা সদস্যরা সংসদের অধিবেশনকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। দেব হাজির ছিলেন মাত্র ১১ শতাংশ অধিবেশনে। বাকি সময়টা তিনি ব্যয় করেছেন তার পেশা চলচ্চিত্রে অভিনয় এবং প্রযোজনার পিছনে। পাঁচ বছরের অধিবেশনে তিনি প্রশ্ন করেছেন সাকুল্যে তিনটি আর দুটি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। এই দেব এবারও প্রার্থী। সন্ধ্যা রায়। ৭৭ বছর বয়স। বেশিরভাগ সময় কাটত হাসপাতালেই। তিনি হাজির থেকেছেন ৫৩ শতাংশ অধিবেশনে। তিনটি বিতর্কে অংশ নিয়ে ২|৪ লাইন পাঠ করেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রশ্ন ? না, একটি প্রশ্নও উত্থাপন করেননি। এবার বাদ পড়েছেন।
মুনমুন সেন ওরফে শ্রীমতী দেববর্মা। গ্ল্যামারাস নায়িকা। যদিও বয়স ৬৪ পার। ৬৯ শতাংশ হাজিরা দিয়েছেন কিন্তু একটি প্রশ্ন করার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেননি। কোনওরকমে কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে একটা বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। এবার প্রার্থী। তবে বাঁকুড়ার বদলে আসানসোলে। ভোট পাবেন? শতাব্দী রায়। অনেকদিনের নায়িকা। ৭৪ শতাংশ অধিবেশনে হাজিরা দিয়েছেন বটে কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস দেখিয়েছেন মাত্র দুবার। বিতর্কে অংশ নিয়েছেন চারবার। হ্যাঁ, প্রার্থী এবারও। ভোট দেবেন? বরং কিছুটা সিরিয়াস গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেত্রী অর্পিতা ঘোষ। ৬২ শতাংশ অধিবেশনে হাজিরা দিয়ে ২৬টি প্রশ্ন করেছেন, ২১টি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই এবারও প্রার্থী। বালুরঘাটে স্থানীয় দলীয় নেতৃত্বের রোষকষায়িত চক্ষুরাগের ভয় মাথায় নিয়েই।
এই হিসাব সহজেই প্রমাণ করে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টারস্ট্রোক সস্তার চমক ছাড়া কিছুই নয়। আসলে উনি ভুলে গেছেন, এবার ভোটে বাঙালি ভোট দেবে প্রার্থীকে আতস কাচে যাচাই করে। যেমন ধরুন— এবার যোগ হয়েছে আরও দুই তারকা। বসিরহাট কেন্দ্রে নুসরত জাহান যিনি রুপোলি পর্দায় তৃতীয় শ্রেণীর নায়িকা কিন্তু দিদির হিসাবে প্রথম শ্রেণীর প্রার্থী। কারণ তিনি মুসলমান। দুটো হিসাব এক্ষেত্রে আরও মেলানোর দরকার ছিল এবং সে হিসাব দিদি না মেলালেও বাঙ্গালি মেলাবে, কারণ এই নুসরত জাহানের বয়ফ্রেন্ড কাদের ধর্ষণ করেছিল সুজেটকে, পার্কস্ট্রিটে চলন্ত গাড়িতে। যে ঘটনাটা দিদির কাছে ছিল ‘ছোটো ঘটনা’। আর ওঁকে প্রার্থী করা হয়েছে গতবারের বিজয়ী প্রার্থী ইদ্রিশ আলিকে সরিয়ে। এই সেই ইদ্রিশ আলি যিনি নিজের স্বার্থে যে কোনো মানুষের গলায় কোপ মারতে দ্বিধা করেন না।
আর এক তারকা মিমি চক্রবর্তী। প্রথম আবির্ভাব (বাংলা সিরিয়াল গানের ওপারে)-এই ব্যর্থ নায়িকা। এখন চটুল নায়িকার শিরোপায় ভূষিত। ২১ জুলাই-এর মঞ্চে দাপাদাপি করে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের মন ভিজিয়েছেন। অতএব প্রার্থী। যাদবপুরে। যাদবপুরবাসী ভোট দেবেন? আপনারা সোমনাথ চ্যাটার্জিকে ভোট দিয়েছেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ভোট দিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। সেই হাতে মিমিকে? লজ্জা করবে না ? দেব ফের ঘাটালে। কেন ভোট দেবেন ঘাটালবাসী যিনি মাত্র ১১ শতাংশ অধিবেশনে হাজির ছিলেন? বাকি সময়টা কাটিয়েছেন শ্রীকান্ত মোহতার ল্যাজ ধরে? পাঁচ বছরে তিনটি প্রশ্ন। লজ্জায়? নাকি মুখ খুললেই তোতলামি ধরা পড়ে যাবে বলে !
মুনমুন সেন। অভিনয়টা একেবারেই জানেন না। সুচিত্রা সেনের মেয়ে বলেই গ্ল্যামার। গতবার বাঁকুড়ায় জিতেছিলেন। এবার তাহলে আসন বদলালো কেন? নির্ঘাত হারবেন বলেই তো! এবার টক্কর বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে। আসানসোলে। মলয় ঘটক সঙ্গে থাকলে অন্তত টক্করটা দিতে পারবেন। নাহলে আমও যাবে, ছালাও যাবে।
বারাকপুরে এবার দীনেশ ত্রিবেদীর সর্বনাশ! অর্জুন সিংহ বিজেপিতে। শোনা যাচ্ছে, প্রার্থী তালিকার ঘোষণার দিন অর্জুন সিংহকে ঠারেঠোরে গালাগাল না দিলে নাকি তিনি দলত্যাগ করতেন না। দিদিনাকি ইচ্ছে করেই করেছেন যাতে বারাকপুরে দীনেশ হারেন। কারণ পুরনো রাগ। অথচ অন্যরাজ্যের তারকা সাংসদদের ভূমিকাটা মেলান। জয়াপ্রদা। সমাজবাদী পার্টির সাংসদ ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০১৪-র পার্লামেন্টে ৩৯ শতাংশ হাজিরা দিয়েছেন। ২৭টি বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। ৩৯৫টি প্রশ্ন করেছেন। জয়া বচ্চন ৭৮ শতাংশ হাজিরা। ১৬৮ বার। বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। ৪৫১টি প্রশ্ন করেছেন। কম যান না হেমা মালিনীও। বিজেপির সাংসদ হিসেবে ৩৯ শতাংশ অধিবেশনে হাজিরা সত্ত্বেও ১৭টি বিতর্ক অংশ নিয়েছেন। ২১০টি প্রশ্ন করেছেন।
একমাত্র ব্যতিক্রম শত্রুঘ্ন সিনহা। বিজেপির সাংসদ। ৬৭ শতাংশ হাজিরা সত্ত্বেও একটা প্রশ্নও করেননি কখনও। একটা বিতর্কেও অংশ নেননি। যখন বুঝেছেন, বিজেপি এবার আর টিকিট দেবে না তখন দিদির দলে ভেড়ার আশায় ব্রিগেডের মঞ্চে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসে একটা হিল্লে হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্য শত্রুঘর। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেড়েনি।
নারদা মামলায় অভিযুক্তরাও যথারীতি আছেন। সৌগত রায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় মায় অপরূপা পোদ্দারও। আছেন রোজভ্যালি মামলায় অভিযুক্ত সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। প্রচারে তো তাদেরও বেরোতে হবে। ভিডিও দেখবে মানুষ। প্রশ্নও করবে। জবাব দিতে পারবেন তো?
বনগাঁর প্রার্থী মমতাবালা ঠাকুর। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মতুয়া বংশের মূল ধারার কেউ নন। তার জন্যই নাকি মতুয়া ভোট এবার চার ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তিন ভাগই নাকি বিজেপির পকেটে। তারওপর মমতাবালা পারিবারিক ঝামেলা এড়াতে ৭৩ শতাংশ অধিবেশনে হাজির থাকলেও সংসদে একটা প্রশ্নও করেননি কোনওদিন। বাকি প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছে সব দলছুটের দল। পরেশ অধিকারী, কানাইয়ালাল আগরওয়াল, মৌসম বেনজির নূর, মহুয়া মৈত্র। কেউ কংগ্রেস থেকে। কেউ ফরোওয়ার্ড ব্লক থেকে। এদের পিঠে তো ‘বিশ্বাসঘাতক’ স্ট্যাম্প পড়েই গেছে। মানুষ কেন ভোট দেবে বিশ্বাস করে ? হ্যাঁ মহুয়া মৈত্রকে নিয়ে একটু হৈ চৈ হচ্ছে বটে। কিছু বাচনভঙ্গি, কিছুটা গ্ল্যামারের কারণে। রাহুল গান্ধীর প্রিয়পাত্রী ছিলেন বছর ৪৫-এর এই ছিপছিপে মহিলা। আম আদমি কা সিপাহির চাবুক বক্তা হিসেবে নাম কুড়িয়েছিলেন। বড়ো মাপের চাকরিও করতেন। আর্থিক কেতাও আছে। ঘোষিত সম্পত্তিই ২.৫ কোটি টাকা। শুধু অন্ধকারাচ্ছন্ন ওনার ব্যক্তিগত জীবনের অনেকটা অংশ। তা নিয়ে রয়েছে অনেক কানাঘুষো। তা থাক। দলছুট হয়ে বিধায়িকা হয়েছিলেন তৃণমূলের টিকিটে। এবার সাংসদ পদের প্রতিযোগী কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে। ঘাগু নেতারা সব অপেক্ষায় রয়েছে ল্যাং মারবেন বলে। তবে মহুয়া পাল্টা ল্যাং দিতেও অভ্যস্ত। দেখা যাক।
সত্যি বলতে কী, এবার প্রার্থী তালিকায় সৌগত রায় বা রত্না দে বা মমতাজ সংঘমিত্রার মতো দু-চারজনই রয়েছেন যাঁরা প্রমাণ করেছেন, সাংসদ হওয়ার যোগ্যতা তাঁদের আছে। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আপাতত বাদ পড়েছেন দলের সভাপতি সুব্রত বক্সী নিজেই।হয়তো আরও লোভনীয় পদ পাবেন এই আশায় চুপচাপ। কিন্তু সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে একেবারে কলকাতা থেকে ঠেলে বার করে দেওয়া হলো কেন? তাও বাঁকুড়ায় ! বেশ সন্দেহজনক। নিন্দুকরা বলাবলি করছেন, রাঢ় বাংলা এবার পুরোপুরি গেরুয়া। বাঁকুড়া তো রাঢ় বাংলারই অন্যতম। চরম চ্যালেঞ্জের মুখে বর্ষীয়ান নেতা, মমতাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর হাতের চাবুক খাবেন আর কতদিন। শেষ পর্যন্ত কি মেনে নিচ্ছেন। সুব্রত? উনি বলছেন, মানুষ মেনে নিলেই হলো।
তা তো ঠিক। প্রশ্নটা সেখানেই। ২০১৯-এর বাংলা ২০১৪-র বাংলা নয়। রাজনৈতিক ধারাবাহিকতাটাই পাল্টে গেছে। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেঁচাতে হচ্ছে। আর্তনাদ করছেন উনি। কারণ উনি ভয় পাচ্ছেন। বিজেপিকে যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মোদীজীকে। ওই একটি মানুষকেই তিনি যমের মতো ভয় করেন। কারণ মানুষটা জানেন, কোন অসুখের ওষুধ কোনটা! দাবার বোর্ডে কোন চালটা চালতে হবে কখন। তৃণমূলের তারকারা যখন খসে পড়বেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আঁচও পাবেন না।
সৃজিত রায়