পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখন এক তুমুল আলোচনা। ভোটদান পদ্ধতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দাবি তুলেছেন, ভোটদানের পদ্ধতি হিসেবে ইভিএম বাতিল করে পুরনো আমলের ব্যালট পদ্ধতি প্রচলন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল যারা মূলত ভারতীয় রাজনীতিতে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে তারা মমতা ব্যানার্জির এই ব্যালট ফেরানোর দাবিতে সুর মেলাতে শুরু করেছে। ব্যালটের দাবিদাররা কারণ দিয়েছেন ইভিএম নাকি হ্যাক করা সম্ভব। তারা বলতে চাইছেন, ইভিএম যন্ত্রে আগে থেকে কোনো একটি নির্দিষ্ট দলের পক্ষে ভোট করানোর ব্যবস্থা করে রাখা যায়। অর্থাৎ যে বোতাম টিপে ভোট দিন না কেন সবই বিজেপির পক্ষে ভোট পড়ে যাচ্ছে। তাদের আশঙ্কা এই স্পেশাল প্রোগ্রামিং-এর ফলেই বিজেপির এত বেশি পরিমাণে প্রার্থী জিতেছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এই দাবি পত্রপাঠ বাতিল করে দিয়েছেন। তথাপি মমতা ব্যানার্জি তার দাবি থেকে একচুল সরেননি, বরং গত ২১ জুলাই ব্রিগেড সম্মেলনে ব্যালট ফেরানোর জন্য চরমভাবে আন্দোলনে নামার হুমকি দিয়েছেন।
ব্যালট পদ্ধতিতে ভোটদান একটা বহুল প্রচলিত এবং পুরনো পদ্ধতি, যা বিশ্বের বেশ কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশে এখনো চলছে। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে ভোট দানকে রাজনৈতিক দলগুলি একটা প্রহসনে পরিণত করেছে, যা ইদানীং গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে লজ্জাজনক। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে যে ঘটনা শাসকদল ঘটিয়েছে। তাতে ভোট হওয়া মানে নির্বাচনের নামে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। স্থানীয় এলাকার ক্ষমতাসীন নেতা-নেত্রীদের মদতে হওয়ায় প্রশাসনিক বাহিনী কিংবা ভোটকর্মীদের তোয়াক্কা না করে ভোটকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনেই অবাধে ছাপ্পা চলেছে। যে খরবগুলি পয়সা খাওয়া মিডিয়াগুলি না দেখালেও সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে ধরা পড়েছে। গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে নির্বাচনকে হাসির নাটক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু ইভিএমের ক্ষেত্রে চুরি বা ছাপ্পা ভোট করার মতন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অতীব কম।
প্রশ্ন হলো, ইভিএমের দ্বারা ২০১১ সালে ক্ষমতা দখল করেছেন যে মমতা ব্যানার্জি, তিনি এখন ব্যালট ফেরানোর দাবি করছেন কেন?তৃণমূল সুপ্রিমো মুখে ব্যালট ফেরানোর সপক্ষে যতই কারণ দেখান না কেন, নির্বাচন কমিশন এবং সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন। ব্যালট ফেরানোর আসল কারণ। বিগত আট বছরে রাজ্যের সমস্ত দুষ্কৃতীদের এবং ভোট চুরির মেশিনারি কুক্ষিগত করেছেন মমতা ব্যানার্জি। যা সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘উন্নয়ন বাহিনী’ নামে কুখ্যাত। মমতা ব্যানার্জির সেই উন্নয়ন বাহিনী পুলিশ কিংবা কেন্দ্রীয় বাহিনী কাউ কে রেয়াত করে না। তা বিগত নির্বাচনগুলোতে প্রমাণ হয়েছে। ভারতবর্ষের নির্বাচনেরইতিহাসে ভোট গণনা কেন্দ্রে গিয়ে ছাপ্পা ভোট দেওয়া এবং নির্বাচিত অর্থাৎ জয়ী প্রার্থীকে বিজয়ী সার্টিফিকেট না দিয়ে নিজের । দলের পরাজিত প্রার্থীর নামে সার্টিফিকেট জোর করে লিখিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা গত নির্বাচনে প্রথম ঘটল, যা আন্তর্জাতিক মিডিয়াকেও অবাক করে দিয়েছে। কিন্তু আসল কথা হলো ক্ষমতালোভী মমতা ব্যানার্জি সারা বিশ্বে কে কি সমালোচনা করলেন সে বিষয়ে তিনি বিশেষ আমল দেন না।
ইভিএম হ্যাক করা কি সম্ভব? জাতীয় নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়াররা ঘোষণা করেছেন যে বর্তমানের ইভিএম হ্যাক করা সম্ভব নয়। তারা বলেছেন মকপোলিং করে ভোট শুরুর আগে দেখিয়ে দেওয়া হয় যে, যে বোতামে ভোট দেওয়া হচ্ছে সেই বোতামেই ভোট পড়ছে কিনা। তাছাড়া যিনি যে চিহ্নে ভোট দিচ্ছেন সাত সেকেন্ডের জন্য তিনি ভিভি প্যাটে সেই চিহ্নের ছবি দেখতে পান। এবং সেই ভোটপ্রদত্ত চিহ্নটি একটি কাগজে ছাপা হয়ে যায়। সুতরাং যে কোনো বোতাম টিপলে একটি বোতামেই ভোট পড়ে সেই দাবি মানা যায় না। যদি ধরেই নেওয়া যায় বিজেপির হয়ে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রার্থীকে জেতাবার জন্য আগে থেকে মেশিনে ভোট দিয়ে রেখেছেন তবে ৪২ টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৮টিতে কেন বিজেপি প্রার্থী জিতল ? ব্যালট ফেরানোর দাবির কারণ হিসাবে আর একটা বিষয় বলা হচ্ছে যে, লোকসভা পরবর্তী পৌর বা পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলিতে যেখানে নির্বাচন হচ্ছে অধিকাংশ জায়গায় বিজেপির প্রার্থীরা পরাজিত হচ্ছেন। সুতরাং ব্যালটে ভোট হলে বিজেপির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আসলে বিজেপি অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদীর সুদক্ষ প্রশাসনে দেশটি যে সত্যিই ধীরে ধীরে অগ্রগতির পথে চলছে তা আমজনতা বুঝতে পেরেছেন। তাই লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনগণ সেই রাজনৈতিক দলকেই নির্বাচিত করছেন যে রাজনৈতিক দলটি এবং তার প্রধান কাণ্ডারী সৎ সাহসী এবং সুশাসক। প্রান্তিক গ্রামীণ এবং পৌর নির্বাচনে বিজেপির বর্তমান প্রার্থীরা যে সবাই সুদক্ষ এবং সুশাসকতা কিন্তু নয়। তাছাড়া স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় । ব্যক্তিদের প্রভাব কাজ করে অধিকাংশ ভাবে। সুতরাং সেই সমস্ত নির্বাচনে বিজেপির হার হচ্ছে এটা সুদৃঢ়ভাবে মানা সম্ভব নয়।
মমতা ব্যানার্জি যদি ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নিজের ধ্বংস দেখতে না চান, তবে অবশ্যই জনতাকে বোকা বানানোর চেষ্টা না করে সঠিক পদ্ধতিতে রাজ্য পরিচালনা করা দরকার। ইভিএমের ধোঁয়া তুলে পুরনো বাতিল হয়ে যাওয়া ব্যালটের দাবি না করে তার উচিত বায়োমেট্রিক ভোট মেশিনের জোরালো দাবি করা। তাহলে তার সততার বিজ্ঞাপনটা আরেকটু উজ্জ্বল হতো। বায়োমেট্রিক ভোটিং মেশিন মানে ভোটারের আঙুলের ছাপ ছাড়া ভোট দেওয়া যাবে না, কিন্তু সেই বাস্তব বুদ্ধি কি মমতা ব্যানার্জির আছে? যদি না থাকে প্রশান্ত কিশোর কেন, কোনো দিগ্গজই আগামী একুশে তাকে বাঁচতে পারবেন না।
বরুণ মণ্ডল
2019-08-17