রাজনীতিতে পালাবদলের হাওয়া উঠলে চতুর্দিকে কেমন একটা উসখুস ভাব শুরু হয়ে যায়। সাংসদ থেকে সাধারণ নেতা, ক্যাডার থেকে কর্পোরেট, চামচা থেকে চোর, বুদ্ধিজীবী থেকে মিডিয়ার ছায়াব্যাকুলেরা ছাতাবদলের জন্য ফল্গুস্রোতে ধরাধরি ও দরাদরি শুরু করে দেন। এটি চশমখোর রাজনীতির আবশ্যিক নীতিমালার মধ্যেই পড়ে, এর নাম দেওয়া যেতে পারে, ‘ছাতানীতি’। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে সেই হাওয়া এবং ভিড় বাড়িয়ে ভিড়ে যাওয়ার ব্যাপক তোড়জোড় চলছে!
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, জনগণ যাঁদের মাথায় করে রাখেন, তাঁদের চট করে নামান না। কিন্তু একবার জনগণ বিমুখ হয়ে গেলে কোন ট্যাক্টিসই কাজ করে না। তাঁদের এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলেন যে, আবার সরকারে আসা তো দূরের কথা, বিরোধী হিসেবে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও আর রাখেন না। লোকসভা ভোটে ব্যাপক বিপর্যয়ের পর মুখ্যমন্ত্রী সেই ললাটলিখন পড়ে ফেলেছেন।
বুঝে গেছেন, রাজ্যের যুবসমাজ সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন, দূরে সরে গেছেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। সেই ক্ষোভেরই প্রকাশ ঘটেছে ইভিএমে, জুনিয়ার ডাক্তারদের স্ট্রাইকে, শিক্ষকতার চাকরিপ্রার্থীদের ধর্ণায়। এবং এই বিক্ষোভ যথাসময়ে সামাল দিতে, রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে এবং সাধারণের সহানুভূতি আদায় করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যর্থ। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই কিন্তু ডাক্তারদের স্ট্রাইকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকেই দায়ী করেছেন, প্রশাসনকে দায়ী করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে এতদিন ডাক্তার ও সরকারের মধ্যে চাপানউতোর জিইয়ে রেখে শেষমেশ, যা আশা করাই গিয়েছিল, সমঝোতায় আসা হল, এমনটা কেন করা হল? লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই স্ট্রাইকের আগে ও সমসময়ে ভোটপরবর্তী রাজনৈতিক খুনোখুনি বেশ বেড়ে গিয়েছিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুল উঠছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
সেদিক থেকে সাধারণের চোখ ফিরিয়ে দিতেই কি এই স্ট্রাইক প্রলম্বিত হতে দেওয়া হল? কিন্তু সেটা করেও সরকার বা দলের এবং মুখ্যমন্ত্রী বা নেত্রীর ভাবমূর্তি একটুও উজ্জ্বল হল না। ব্যর্থতার ছাপটা রয়েই গেল। মুখ্যমন্ত্রী জানেন, জুনিয়ার ডাক্তারদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও না পাওয়া গেল তাঁদের মন, না আদায় করা গেল সাধারণের সহানুভূতি। বঙ্গে এখন চলছে ‘মুষল পর্ব’, খেলা ভাঙার খেলা। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে কে যে পাড়ি জমাবে, সেটাই যেন সারপ্রাইজ! বিজেপি বেকার ও কর্মপ্রার্থী যুব সমাজের মধ্যে নিজেকে তলে তলে এদ্দিনে চারিয়ে দিতে পেরেছে এবং বিভিন্ন সংগঠিত কর্মী সংগঠনের মধ্যেও ঢুকে পড়তে শুরু করেছে। ফলে, আর ক্ষমতা দিয়ে হবে না, টিকে থাকতে গেলে সহানুভূতি চাই, যে সহানুভূতি পেয়ে মানুষের মনে প্রত্যাশা জাগিয়ে যেভাবে এগারোয় ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই পরিস্থিতির পুনরাবর্তন চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সেই জন্য চাই সেই হোর্ডিং থেকে হঠে যাওয়া সততার বিজ্ঞাপন। সেই জন্য চলছে শুদ্ধিকরণের প্রচেষ্টা। কাটমানি কাণ্ডে ধরপাকড়! কিন্তু যে সময় চলে যায়, সে যে আর ফেরে না! জনগণও যে ছাতা চেনে! তার মন একবার বিগড়ে গেলে ফেরানো বড় মুশকিল! মরার আগে হরিনাম করে কি স্বর্গলাভ হয়? কে জানে!