গত ২৭ এপ্রিল দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এক ভয়ংকর খবর। বিশিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থা মারফত জানা গিয়েছে যে, ইসলামিক স্টেট নামক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটির একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে বাঙ্গলায় লেখা একটি পোস্টার। পোস্টারে লেখা, ‘শীঘ্র আসছি, ইনশাআল্লাহ’ এবং তাতে রয়েছে আল্-মুসালাত নামক একটি সংস্থার লোগো। এহেন পোস্টার দেখে গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহ যে বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে হয়তো বা কোনো হামলার পরিকল্পনা করছে আইসিস।
বাংলাদেশের সীমান্ত-সংলগ্ন যে রাজ্যে ইসলামি জেহাদ এতখানি বিস্তার লাভ করেছে প্রথমে বামপন্থী, তার পর অতিবামপন্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে, সে রাজ্যে যে আইসিসের মতো ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন পদার্পণ করতে পারে, তাতে আশ্চর্য কী!
তবে ‘শীঘ্রই আসছি, ইনশাআল্লাহ’ পোস্টারটি কোনো হামলার পূর্বাভাস না-ও হতে পারে। বরং এ হয়তো এ রাজ্যে আইসিসের প্রবেশের সদর্প ঘোষণা। বাংলাদেশে আইসিসের জোরালো উপস্থিতি ইতিমধ্যেই রয়েছে। জামাত-উল-মুজাহিদিন নামক বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনটি কেন্দ্রীয় আইসিসের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তার পরেও এ হেন বাংলা পোস্টার সার্কুলেট করার মাধ্যমে তারা হয়তো জানাতে চাইছে যে শীঘ্রই তাদের কর্মক্ষেত্র তারা সরাসরি বিস্তার করতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গেও।
কিন্তু শুধুমাত্র এই অনুমানের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখার উপায় নেই গোয়েন্দা দপ্তরের, কারণ শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের পিছনে ছিল আইসিসেরই হাত। তাছাড়া গত ৩০ এপ্রিল কেরল থেকেও এনআইএ-র হাতে ধরা পড়েছে এক আইসিস জঙ্গি যার পরিকল্পনা ছিল শ্রীলঙ্কার কায়দায় এদেশেও জঙ্গি বিস্ফোরণ ঘটানোর। বাংলাদেশের জামাত-উল-মুজাহিদিনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় আইসিসের সরাসরি, সুপ্রতিষ্ঠিত সংযোগ এবং তার পর এহেন বাংলা পোস্টার যুক্তিসঙ্গত ভাবেই এমন সম্ভাবনার সন্দেহ উস্কে দিচ্ছে যে এই পোস্টারের মাধ্যমে হয়তো পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলাদেশে কোনো হামলার পরিকল্পনার আভাস দিচ্ছে আইসিস। ফলে গোয়েন্দা দপ্তর স্বাভাবিকভাবেই সতর্কতা অবলম্বন করছে।
সংগঠনে নতুন জঙ্গি নিয়োগ এবং এ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে তাদের গুপ্ত ঘাঁটি তৈরির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের জামাত-উল-মুজাহিদিনের প্রতিনিধিদের নিয়মিত যাতায়াত আছে কলকাতায় এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গায়। এ বিষয়ে ওপেন সিক্রেটটি হলো, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের উপর জামাত-নেতাদের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট বেশি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভোট একত্রে নিজের ঝুলিতে পোরার জন্য এই জঙ্গি সংগঠনটিকে যে যথেষ্ট সহযোগিতা ও তোষণ করেন মমতা, এমন অভিযোগ তার দলের অন্দরেই কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। যে ঘনঘন ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে এই জামাত নেতাদের সঙ্গে মমতার অতিরিক্ত যোগাযোগ দলের অ-মুসলমান নেতারাও ভালোভাবে মেনে নিতে পারছেন না। জামাত ও আইসিস জঙ্গিদের যে এ রাজ্যে অবাধ গতি, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো, বুদ্ধগয়া বিস্ফোরণের অন্যতম অভিযুক্ত আরিফুল ইসলাম নামক এক জামাতি জঙ্গি এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই ধরা পড়েছে কলকাতার বাবুঘাটে। আবার গত বছর জুলাই মাসে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতে বর্ধমান স্টেশনে এক ট্রেনের কামরা থেকে গ্রেপ্তার হয় মসিরদ্দিন ওরফে মুসা নামক এক জামাত-আইসিস জঙ্গি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমেরিকান এফবিআই। মুসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছিল যে ২০১৪ সালে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর গ্রেপ্তার হওয়া জামাতি জঙ্গি আমজাদ শেখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল মুসার। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ্য যে, বছর তিনেক আগে, ২০১৬ সালে জামাতের স্লিপার সেল তাদের জঙ্গি কার্যকলাপে কর্মী নিয়োগ করতে চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়।
এই সমস্ত তথ্য একটিমাত্র দিকনির্দেশ করে তা হলো, সেকুলারিজমের নামে বামপন্থীদের মুসলমান তোষণ, অনুপ্রবেশে মদত জোগানো এবং তৎপরবর্তীকালে ক্ষমতা ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরাসরি জঙ্গি-ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমবঙ্গকে করে তুলেছে এক বারুদের স্তূপ। এই প্রসঙ্গে এও উল্লেখ্য যে, পশ্চিমবঙ্গে ড্রাগের রমরমাও বৃদ্ধি পাচ্ছে পাল্লা দিয়ে। জিহাদে দীক্ষা দেওয়ার অন্যতম প্রাথমিক প্রি-ট্রিটমেন্ট হলো ড্রাগ। কারণ জেহাদের দীক্ষা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব। তাই মগজ ধোলাইয়ের আগে ড্রাগের প্রয়োগের দ্বারা তাদের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে দিয়ে শুরু হয় ধ্বংসকার্যের দীক্ষা। ড্রাগের রমরমা, তারপর আইসিসের বাংলা পোস্টার, এহেন ঘটনাক্রম থেকে অনুমান করা যেতেই পারে যে পশ্চিমবঙ্গেও হয়তো জিহাদের প্রসার শুরু হতে চলেছে জোরদারভাবে, ঠিক কেরলের কায়দায়। কমিউনিস্ট শাসিত কেরল থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ উধাও হয় আইসিসে যোগ দেওয়ার জন্য।
আর একটা লক্ষণীয় বিষয় হলো, আরবান নকশালরা আইসিসের বিষয়ে বানিয়েছে একটা অদ্ভুত গল্প। ওরা বলে যে আইসিস নাকি আদতে কোনো ইসলামিক সংগঠন নয়, বরং আমেরিকা আর ইজরায়েলের যৌথ ষড়যন্ত্রে সৃষ্ট একটি সংস্থা, যার উদ্দেশ্য ইসলামকে বদনাম করা এবং নিজেদের অস্ত্র ব্যবসা জারি রাখা। অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে বিষয়টাকে অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে লিঙ্ক করে দেয় বলে কমিউনিস্টদের এই অপপ্রচার অনেকের মনে হয়তো কিছুটা ক্ষীণ বিশ্বাসও উৎপাদন করে। কমিউনিস্টদের এই অপপ্রচারের উদ্দেশ্য হয়তো আইসিসকে এবং তার প্রসারকে পরোক্ষ সমর্থন জানিয়ে বিশ্বজুড়ে এক চরম অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা। কারণ, কমিউনিজমের প্রসারের জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতা আবশ্যক।
কিন্তু বাস্তব হলো, আইসিস এমন একটি রাডিক্যাল ইসলামিক গ্রুপ যারা জোর করে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে ইসলাম আসার আগে, পৃথিবীতে কিছু ছিল না। পৃথিবীর সবকিছু শুরু হয়েছে ইসলামের থেকে। যে কারণে তারা প্রথমত প্রি-ইসলামিক পিরিয়ডের সমস্ত নিদর্শনকে ধ্বংস করতে চায় এবং সেইসব ধ্বংসকার্য সমাপ্ত হলে সমগ্র পৃথিবীতে তারা কায়েম করতে চায় শুধুমাত্র ইসলামের শাসন। গোটা পৃথিবীতে এই অযৌক্তিক মনোকালচার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে ধ্বংসাত্মক এই জেহাদি পদ্ধতি ছাড়া উপায় নেই। কারণ এমন নির্বিচার ধ্বংসকাণ্ড কোনো সুস্থ, যৌক্তিক চিন্তার ফসল হতে পারে না। তাই এই অযৌক্তিক জেহাদপন্থা। এ বিষয়ে সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কথা হলো, জেহাদ প্রসারের উদ্দেশ্যে তারা ছেলে-মেয়েদের জন্য ভালো টাকাপয়সা এবং আরামদায়ক জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে থাকে যা তরুণ প্রজন্মকে প্রলুব্ধ করতে সক্ষম।
এহেন উগ্রপন্থার কবল থেকে পশ্চিমবঙ্গের নবপ্রজন্মকে রক্ষা করতে গেলে আমাদের সমাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব কম নয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সম্মিলিত অবশ্যকর্তব্য হলো পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশ সীমান্ত সুরক্ষাকে নিচ্ছিদ্র ও অত্যাধুনিক করে তোলা যাতে ইসলামিক বাংলাদেশ থেকে অবারিত জঙ্গি-অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায়। এ বিষয়ে একটি গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য মশারি খাটিয়ে শুতেন। কিন্তু মশারিতে যাতে হাওয়া ঢুকতে পারে, সেইজন্য মশারির একটা দিক তুলে দিয়ে সম্পূর্ণ খোলা রাখতেন। অর্থাৎ মশারির তিন দিক আটকানো, একদিন পুরো খোলা! বৃদ্ধের এই অসামান্য কর্মকাণ্ডের ফলে মশারিতে হাওয়া খুবই ঢুকতো, কিন্তু মশাদেরও ঠেকানো যেত না। তারা এটা বিবেচনা করত না যে এদিকটা তাদের জন্য নয়, খোলা রাখা হয়েছে হাওয়া ঢোকার জন্য। মশাদের নৈতিকতা বোধ বলে কিছু
নেই!
অনুরূপভাবে, ভারতবর্ষেরও পশ্চিম সীমান্তে আঁটোসাঁটো সুরক্ষা, আর পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্ত প্রায় পুরোপুরিই খোলা। ঠিক যেন সেই বৃদ্ধের মশারি। খোলা পূর্ব সীমান্ত দিয়ে অনবরত ঢুকছে অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী— সন্ত্রাসবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীও। তাই পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্ত যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে সেখানে সিল করার দাবি ওঠা উচিত। আর যে অঞ্চলে বর্ডার সিল করা ভৌগোলিকভাবে অসম্ভব, যেমন নদী-সীমান্ত, সেখানে অত্যাধুনিক সীমান্ত সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা অবশ্য প্রয়োজন। আমাদের দেশের পূর্ব সীমান্তের ভৌগোলিক প্রকৃতি যেহেতু পশ্চিম সীমান্তের ভৌগোলিক প্রকৃতির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, তাই পূর্ব সীমান্তের সুরক্ষাবিধিও যুক্তিসঙ্গত ভাবেই আলাদা হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে যে, পূর্ব সীমান্তটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত সমতলভূমি অধ্যুষিত ও ঘনবসতিপূর্ণ। সেখান দিয়ে প্রবেশ করে স্বগোষ্ঠীর ভিড়ে মিশে যেতে একজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর কয়েক মিনিট মাত্র লাগে।
পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করতে হলে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্তের যথোপযুক্ত সুরক্ষার দাবিটি জোরদারভাবে তোলা আমাদের পরম কর্তব্য। সেই সঙ্গে আছে সামাজিক কর্তব্য। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলমান বাড়ির ছেমেয়েদের তথ্য দিয়ে বুঝাতে শেখাতে হবে জঙ্গি সন্ত্রাসবাদের আসন্ন বিপদ সম্বন্ধে। ড্রাগের নেশায় আসক্তি আটকাতে যেখানে সেখানে খাবার খাওয়ার আগে সাবধানতা অবলম্বন করার শিক্ষা তাদের দেওয়া প্রয়োজন। তাদের শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন পয়সাকড়ির জন্য প্রবল লালায়িত না হওয়ার এবং বন্ধুত্বপূর্ণভাবে নজর রাখতে হবে তাদের বন্ধুবান্ধব ও গতিবিধির উপর। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে এমনভাবে মিশতে হবে যাতে তাদের গল্পগুলো তারা অভিভাবক – স্থানীয় গুরুজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে দ্বিধা না করে। তাদের পাশে থাকতে হবে বন্ধুর মতো, যাতে চরম বিপদের হাত থেকে তাদের বাঁচানো যায়।
জঙ্গি ইসলামের থাবা থেকে পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচাতে হবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। হিন্দু বাঙ্গালিকে হতে হবে সম্মিলিত, ঐক্যবদ্ধ। চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, চরম বিপদের মুখে আত্মরক্ষা পরম ধর্ম।
দেবযানী ভট্টাচার্য
2019-05-10