চলচ্চিত্র তার সুচনা লগ্নে প্রারম্ভিক যে অভিমুখ স্থির করে যাত্রা শুরু করেছিল তা ছিল বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মনোরঞ্জন। এই কথার প্রতিধ্বনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু হৃদয়বিদারক ভাবে একেবারে হালে শোনা গেছে Dirty Picture ছবিতে। ৭০-এর দশকের দক্ষিণী নৃত্যপটিয়সী চলচ্চিত্র শিল্পী সিল্ক স্মিতার চলচ্চিত্র-কলঙ্কিত জীবনভিত্তিক এই ছবিতে নায়িকা বিদ্যাবালন বলছেন তার কাজ ও লক্ষ্য একটাই তা হলো entertainment, entertainment ও entertainment তা যেভাবেই হোক না কেন।
৭০-এর দশক থেকে ৯০-এর দশক অবধি কেবলমাত্র মনোরঞ্জনের খাতিরে হিন্দি ছবিতে নারী শরীরের প্রদর্শনী সংবলিত একাধিক নৃত্যদৃশ্য নির্মাণ ছিল আবশ্যিক শর্ত। আর এটিই মূলত সাহিত্যকেন্দ্রিক ও সিরিয়াস ভাবনার ছায়াছবিতে অভ্যস্ত বাঙ্গালি দর্শকের ও তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে ছিল নিতান্তই অবক্ষয়ী চিন্তার নিদর্শন।অবক্ষয় কথাটি গোলমেলে। বাঙ্গলা চলচ্চিত্র সমাজের প্রতিবিম্ব ও প্রতিধ্বনি হওয়ার দায়বদ্ধতা ১৯৫৫-য় পথের পাঁচালির জন্মলগ্ন থেকেই এক রকম স্বীকার করে নেয়।
ঋত্বিক ঘটক সদম্ভে বলেছিলেন “যে দিন বুঝব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষের কাছে নিজের সৎ বক্তব্য তুলে ধরতে পারছি না সেদিনই এই মাধ্যমকে লাথি মেরে চলে যাব।” এ সবই ৫০-এর দশকে সবাক চলচ্চিত্রের আগমনের পরবর্তী সময়ের কথা। ৩০ থেকে ৫০-এর দশক অবধি মূলত শরৎচন্দ্র, নিরুপমাদেবী বা নিউ থিয়েটার্সের নিজস্ব কাহিনি লিখন বিভাগের রচনার ভিত্তিতে যে ছবিগুলি নির্মিত হতো দর্শক তা সানন্দে গ্রহণ করেছে। সেই সময় যেহেতু বিদেশি কিছু ছবি ছাড়া দশকের হাতে প্রতি তুলনা করার মতো কিছু ছিল না তাই অবক্ষয়ের অর্থাৎ অবনমন বা মূল্যবোধহীনতা যাই বলা যাক না কেন তা ছিল অস্তিত্বহীন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক ইংরেজের বহু ছবি বাঙ্গলা প্রেক্ষাগৃহগুলিতে সাড়ম্বরে প্রদর্শিত হতো। সেসব ছবি সেনসর ছাড়পত্র পেলেও সেখানে চুম্বন ও খোলামেলা দৃশ্যের অভাব ছিল না। এক সময়ের বোম্বে টকিজের ৩০-এর দশকের বহু ছবিতেও ইংরেজি ছবির দেখাদেখি চুম্বন দৃশ্য ছিল আকছার। পরবর্তীকালে সমাজ মানসের বিচিত্র টানাপোড়েনে তা ব্রাত্য হয়ে পড়ে। ফলে নায়ক নায়িকার সরল চুম্বন দৃশ্যের বিকল্পে বিচিত্র ভঙ্গিমায় পরস্পরের নৈকট্য বোঝাতে নানা কদর্য দৃশ্যের অবতরণা হয়। নির্দিষ্ট চলচ্চিত্র রুচির, মানসিকতার এটি নিশ্চিত অবক্ষয়।
বাঙ্গলায় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রের বাজার পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিল। দেশভাগজনিত হতাশার ছায়া চলচ্চিত্রে পড়েছিল। অবক্ষয় নিয়ে বুক চাপড়ানোর আগে চলচ্চিত্রের মতো চূড়ান্ত অনিশ্চিত একটি মাধ্যমে অর্থ লগ্নি করে পরের ছবিটি তৈরি করার নিশ্চয়তা পাওয়া যে দুষ্কর সেটা মনে রাখা জরুরি। এখানে সদাসর্বদাই পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে সেই মন্থনে অযান্ত্রিক জলসাঘর সুবর্ণরেখার সঙ্গে ৩৬ চৌরঙ্গী লেন বা একেবারে সাম্প্রতিক সিনেমাওয়ালা বা বেলাশেষে কিংবা রামধনুর মতো ছবি উঠে আসতে পারে। উত্তম ৫৫ থেকে ৮০ আমৃত্যু বাঙ্গালিকে তার পরিচিত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সফলভাবে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। মনে পড়বে তার কালজয়ী ‘সপ্তপদী’তেও তিনি ধুতি পরে বাইক চালিয়েছিলেন। অধিকাংশ ছবিতে বাঙ্গালির পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবিই ছিল তার পরিধেয়। সময়ের প্রয়োজনে এই পোশাক পরিবর্তন কালপ্রবাহ, সাংস্কৃতির মিশ্রণ ও দৈনন্দিন প্রয়োজনের অঙ্গীভূত— একে কি অবক্ষয় বলা যাবে? একটা সময় রেডিয়োতে হিন্দি গান শোনাও ছিল বাঙ্গালির রুচিহীনতার পরিচায়ক। হিন্দি ছবি যারা দেখতেন তাদের তকমা ছিল অশিক্ষিত মনন ও অর্ধশিক্ষার ফসল। অথচ ৫০-এর দশকে ‘মাদার ইন্ডিয়া’ বা ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজতে’ সামাজিক আপত্তি ছিল না। নিশ্চিতভাবেই সিনেমা শিল্পে টিকে থাকতে অনেক সময় বহু পরিচালককেই এর নান্দনিক দিকটিকে কাটছাঁট করতে হয়। ববি, শোলে, দিওয়ারের সাফল্য হিন্দি বাঙ্গলার দৃশ্যমান বিভাজনরেখা মুছে দেয়। বাঙ্গলা ছবি যখন উত্তম মৃত্যুর পর দিশাহীনতায় ভুগেছে তখন মোটা দাগের হিট হিন্দি বা তামিল ছবির অন্ধ অনুকরণে টিকে থাকতে চেয়েছে। চলচ্চিত্রের প্রবাহ কিন্তু রুদ্ধ হয়নি। বাঙ্গলা ছবি নির্মাণের সংখ্যা বা আবেগ কোনোটাই কমেনি। বুদ্ধদেব, গৌতম, অপর্ণা, ঋতুপর্ণর পর চমৎকার সব নতুন আঙ্গিক আর অভাবনীয় বিষয়বস্তু নিয়ে সার্থক মনোরঞ্জন ও নান্দনিকতার চূড়ান্ত মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন শিবপ্রসাদ, কৌশিক কমলেশ্বররা। সব সময়ই খাওয়ার পদে ডাল, সুক্তো, চচ্চড়ির সঙ্গে পায়েসও থাকে। হতাশ হওয়ার প্রশ্নই নেই। চলচ্চিত্র কোনো স্থির নিরালম্ব মাধ্যম নয়। এটি প্রযোজক-পরিচালক-দর্শকদের যৌথ অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে কালানুবর্তী তো নিশ্চয়। তাই বিবর্তন ও অবক্ষয়ের ভেদরেখা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে।
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়