নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে দল বদলের এক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে । প্রতিবার ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা হলেই বাংলাতে এইমত মানসিকতার সৃষ্টি হয় জনমানসে। এবার লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী পরিস্থিতিও তার ব্যতিক্রম নয়।
নির্বাচনের পর মূলত তৃণমূল কংগ্রেস দল থেকে বিজেপি দলে আগমণের একটা হিড়িক পড়েছে।বেশ কিছু মানুষ ইতিমধ্যে দল পরিবর্তনও সেরে ফেলেছে।তিন তিনটি পুরসভার দখলও বিজেপির দখলে চলে এসেছে শোনা যাচ্ছে, তৃণমূল দলের আরও এক বড় অংশ নাকি দল পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে । এইমত অবস্থায় বিজেপি দলের পুরণো বেশ কিছু কট্টরপন্থী মানুষ এই দল বদলের প্রক্রিয়ায় উষ্মাও প্রকাশ করছেন। সব চাইতে অবাক হয়েছি সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্বাচনের আগে বিজেপি তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পক্ষে লড়াই করেছি,প্রাণ প্রিয়তম সেই সব গুণী ও বিদ্বজনদের অনেকেই এইমত দল বদলের বিপরীতে কলমের কষাঘাত মারছেন দেখে।
আমার প্রশ্ন হলো,ভোটার কি পৃথিবীর বাইরে থেকে আসবে?ভোটার সীমিত এবং সেটা নির্বাচন ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ । প্রথমে এই ভোটাররা ছিল কংগ্রেস দলের,বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর এরাই হলো বামপন্থী ভোটার,তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর সবাই তৃণমুল দলের হয়ে গেল।সুতরাং এটাই নিয়ম যে আদর্শগত ভাবে হোক, আর প্রাপ্তির আশায় হোক-ভোটাররা দলবদল করবেই।সুতরাং এখন যাঁরা দলবদল করছে,তারা সবাই যে দোষী এমন ভাববার কারণ আছে বলে মনে হয়না। মনে করে দেখুন,সাতাত্তরের নির্বাচনে ব্যারাকপুর কেন্দ্রে এক কংগ্রেসি ভোট গগনাকালে ইন্দিরা গান্ধীর হারের খবর শুনে বলে উঠেছিল ‘তাহলে ওই ডাইনিটা হেরেছে!’ ওই মানুষটা কংগ্রেসি ভাব দেখালেও মনে মনে ছিলেন প্রচন্ড কংগ্রেস বিরোধী । বর্তমান তৃণমূলীদের একটা খুব বড় অংশ আজ ওইমত মানুষসম তৃণমূল হয়ে আছেন।তাঁদের কি বাদ রাখা সমীচীন হবে?
মনে রাখা দরকার এই পশ্চিমবঙ্গে এক সময় বিজেপি’র ভোট ছিল মাত্র 6%।সেই ভোট উঠতে উঠতে আজ 40%এর ওপর । কোথা থেকে এলো এই ভোট? আরও জেনে রাখা উচিত, বর্তমানে তৃণমূল সেজে বহু মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। বহু তৃণমূলী হিন্দু নেতা আছেন যাঁরা তৃণমূলে থেকে অযথা পুলিশি হয়রানির ভয়ে মুখ খুলতে ভয় পান মনে মনে তারাও কিন্তু হিন্দুত্ববাদী ও বিজেপির সমর্থক । এই সুযোগে সেই মানুষগুলি কিন্তু দলবদল করে হিন্দুত্বের সাহারা চাইবে।তাদের কি আমরা নেবোনা?
তবে একটা কথা,আমরা নেব তাঁদের যাঁরা বিজেপির দুঃসময়ে অত্যাচারের খড়গ নামিয়ে আনেনি।অধিকার হরণ, সম্পত্তি নাশ,জীবন দুর্বিসহ করে তোলা প্রভৃতি কাজ তৃণমূল দল করেছে,একথা মান্য করতেই হয়। তবে কথা হলো এই যে সবাই কিন্তু করেনি।এক আধজনের নেতৃত্বে ভয়ে হোক আর ভক্তিতে হোক, কিছু মানুষ করেছে।খেয়াল রাখুন সেই সব নেতৃত্বের দিকে তাদের কোনোদিনই নেওয়া উচিত হবে না। উপরন্তু তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে দেওয়া হোক এদের দলে নেওয়ার অর্থ হলো মানবতাকে উপেক্ষা করা।
পূর্ব বঙ্গের শরণার্থী মানুষদের প্রতি একটা অনুযোগ ছিল যে তাঁরা কখনোই বিজেপিকে চায়না।সীমান্ত এলাকার উদ্বাস্তু অধ্যুষিত এলাকায় দু’খানি আসন জিতিয়ে সেই কথার ওপর একটা প্রশ্ন চিহ্ন এবার তাঁরা একে দিয়েছে।আমরা কি সেই উদ্বাস্তু ভাইদের দূরে সরিয়ে রাখব?
শেষ পর্বে একটা কথা বলতে চাই। কথাটা হলো ভারতীয় জনতা পার্টিতে হিন্দুরা আসুক,কিন্তু কিছুটা যেন ঝাঁড়াই বাছাই হয়।মনে রাখবেন যেসব মানুষ এখন ভারতীয় জনতা পার্টিতে আসবে, মূখ্যত হিন্দুত্বের ওপর ভর করেই আসবে।হিন্দুত্ব এখন হিন্দু মানসে বেশ ভালমতোই গেঁড়ে বসেছে। যেই আসুক,হিন্দুত্বের ওপর ভর তাঁকে করতেই হবে।আর হিন্দুত্ব পূণরায় ত্যাগ করানো খুব সহজ হয়ে উঠবেনা।সুতরাং এখনই অছ্যুৎগিরি ত্যাগ করা হোক। আরও একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই।কথাটা হলো,যাঁরা আমরা বুক চিতিয়ে লড়াই করেছি, ভবিষ্যতে হয়তো তাঁদের আর দল চিনবে না। এটাই নিয়ম । মনে রাখবেন,আমরা কিন্তু কিছু পাওয়ার আশায় লড়াই করিনি।আমরা লড়েছি আদর্শের জন্য। এখনও পর্যন্ত আমরা পূর্ণ সফল নই।সবে আংশিক সফলতা পেয়েছি। আমরা বরং এখন থেকেই সবকিছু উপেক্ষা করে পূর্ণ সফলতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ি।পূর্ণ সফল হওয়ার পর কে দেখল, আর না দেখল- তাতে আর কী’ই বা এসে যায়! তবে দল আদর্শচ্যুত হলে তখন যেন আবার কলম ঝলসে ওঠে।শেষ কথা হলো,নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখা হোক না!