তখন প্রগতিশীলতা মানেই ছিল ব্রাহ্ম হয়ে যাওয়া, কিন্তু বিদ্যাসাগরকে ব্রাহ্ম হতে দেখি নি আমরা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজ নারায়ণ বসু, অক্ষয় কুমার দত্ত প্রমুখ ব্রাহ্ম মনীষীর সঙ্গে তাঁর চির ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও তিনি হিন্দুই থেকে গেছেন। বরং প্রিয়পাত্র শিবনাথ শাস্ত্রী ব্রাহ্ম হয়ে গেলে তা তাঁকে বিশেষভাবে পীড়িত, ব্যথিত করেছিল।

বিদ্যাসাগরের লেখা চিঠিপত্রের শীর্ষে অবশ্যই স্থান পেত ‘শ্রীহরি শরণম্’। এটা দেখবার মত ব্যাপার। শুধুই কী আচার পালন!

হিন্দুধর্মের প্রতি অকারণ বিদ্বেষ ও কটূক্তি তিনি কখনোই মেনে নেন নি। একসময় সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারক একটি মামলার রায়দানের সময় প্রসঙ্গ-বহির্ভূতভাবে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে কটূ কথা বলেছিলেন, অশালীন কথা বলেছিলেন; তার প্রবল প্রতিবাদ করেছিলেন বিদ্যাসাগর, গর্জে উঠেছিলেন তিনি। কলকাতায় রাজা রাধাকান্ত দেবের প্রাসাদে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায় নেতৃত্ব দিলেন বিদ্যাসাগর। পাঁচ হাজার গণ্যমাণ্য মানুষের সাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি পাঠালেন ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ সেক্রেটারিয়েটে। চিঠির গুরুত্ব অনুভব করে ব্রিটিশ সেক্রেটারিয়েট ভারত সরকারকে নির্দেশ দিল, সুপ্রিম কোর্টের সেই বিচারকে সতর্ক করে দিতে হবে। জয় হল বিদ্যাসাগরের, জয় হল হিন্দুর।

হিন্দুধর্মে যে দশটি মানবিক গুণ থাকলে যিনি যথার্থ ধার্মিক হতে পারেন, তার সমস্ত গুণই বিদ্যাসাগরের মধ্যে আমরা দেখতে পাই — ধৃতি, ক্ষমা, দম, অজেয়, শৌচ, ইন্দ্রিয় নিগ্রহ, ধী, বিদ্যা, সত্য, অক্রোধ। যদি তাই হয় তবে তিনি অবশ্যই হিন্দু-ধার্মিক।

বিদ্যাসাগর গীতার উপদেশ অনুসারে চলবার কথা উচ্চারণ করেছেন। তাঁর স্নেহধন্য ও পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার অমূল্য চরণ বসু (১৮৬২–১৮৯৮; ১৮৮৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল স্কুল থেকে এম.বি উত্তীর্ণ) একবার বিদ্যাসাগরের ধর্মবোধ ও কর্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “গীতার উপদেশ অনুসারে চললেই ভালো হয়।”

কোনো এক ভয়াবহ লঞ্চডুবিতে প্রায় ৮০০ জন আরোহীর মৃত্যু হলে তিনি সখেদে বলে উঠেছিলেন, “দুনিয়ার মালিকের কি এই কাজ?”

শ্রীরামকৃষ্ণ বারবার বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করলে, ঠাকুরের ভক্তেরা অভিমত প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যাসাগর ঈশ্বর মানেন না, তিনি নাস্তিক। শ্রীরামকৃষ্ণ মত প্রকাশ করে বলেন, ঈশ্বরের আশীর্বাদ না থাকলে কোনো মানুষ এমন জায়গায় পৌঁছাতে পারেন না। তিনি কলকাতার বাদুড় বাগানে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন।

নানান সমাজ সংস্কারের কাজে তিনি শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ও তার সুলুকসন্ধান করেছিলেন, গভীরে গিয়েই পাঠ করেছিলেন শাস্ত্রীয় আপ্তবাক্য। কিন্তু তবুও তিনি নিরীশ্বরবাদী। বলা হয়ে থাকে বুদ্ধের পর বিদ্যাসাগরই প্রথম ভারতীয় মনীষা যিনি ঈশ্বর নিয়ে চিন্তা করেন নি। গৌতমবুদ্ধ যেখানে হিন্দুদের দশাবতারের একজন হয়ে উঠলেন তবে কেনই বা ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ঈশ্বরচন্দ্র’ হয়ে উঠবেন না?

যিনি কর্মফলের আশা না করে নিষ্কাম কর্ম করে গেছেন এবং অক্ষয় মনুষ্যত্বের অধিকারী ছিলেন; গীতার উপর আস্থা রেখেছিলেন, তিনি তো কর্মযোগী হিন্দু সন্ন্যাসীই হবেন! তাই নয় কী?

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

(বিদ‌্যাসাগরের প্রয়াণ দিবসে (২৯ জুলাই) তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.