জানুয়ারিতে পরীক্ষার দিন ফেলেছে তারা। তা নিয়েই এখন মহাফাঁপরে হাজার হাজার পড়ুয়া। চরম উদ্বেগে বিশেষত দক্ষিণ শহরতলি ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কলেজ অধ্যক্ষরাও।

অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার মেনে নির্ধারিত সময়ে স্নাতকের প্রথম সেমেস্টার পরীক্ষা আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তার বদলে জানুয়ারিতে পরীক্ষার দিন ফেলেছে তারা। তা নিয়েই এখন মহাফাঁপরে হাজার হাজার পড়ুয়া। চরম উদ্বেগে বিশেষত দক্ষিণ শহরতলি ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কলেজ অধ্যক্ষরাও।

বাংলার প্রধান উৎসব কী? এই প্রশ্নে অনেকেই হয়তো বলবেন দুর্গাপুজো। কিন্তু গ্রামবাংলার সঙ্গে যাঁদের বিন্দুমাত্র যোগ আছে, তাঁরা জানেন, মকর সংক্রান্তি ঘিরে নবান্ন-পৌষ পার্বণে নাড়ির টান গ্রামের কোটি-কোটি মানুষের। আর গঙ্গাসাগরে তো মিনি ভারতই উঠে আসে পৌষ সংক্রান্তিতে। সে কথা বেমালুম ভুলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মকর সংক্রান্তিতে ও তার আগে-পরে পরীক্ষার দিন ফেলেছেন! এমনকী একাধিক কলেজের অধ্যক্ষ বিষয়টি নজরে আনার পরেও অভিযোগ, শহুরে উন্নাসিকতায় এই সমস্যাকে আমলই দিতে চাইছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা।

প্রথম সেমেস্টারে পরীক্ষার দিন পড়েছে ১৩, ১৫ ও ১৭ জানুয়ারি। যে দিনগুলোতে উৎসব উপলক্ষে গণপরিবহণের সঙ্কটও হয়ে ওঠে তীব্র। এ সব কোনও কিছুকেই গুরুত্ব দিতে নারাজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রসঙ্গত, কলকাতার অধীন কলেজের সংখ্যা আগের থেকে কমলেও এখনও ১৪১টি ডিগ্রি কলেজ রয়েছে রাজ্যের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায়। সে-সব কলেজের অনেকগুলোর অবস্থান গ্রাম বাংলায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় রয়েছে ৩৮টি কলেজ। এক-একটি কলেজে গড়ে হাজারেরও বেশি পড়ুয়া।

এমনিতে এই জেলায় একটি থেকে আর একটি কলেজ বা পরীক্ষা কেন্দ্রের দূরত্ব ২৫-৩০ কিলোমিটারের কম নয়। গণ-পরিবহণও পর্যাপ্ত নয়। আর সেমেস্টারের পরীক্ষা দিতে যেতে হয় অন্য সেন্টারে অর্থাৎ নিজের কলেজ থেকে অন্যত্র। কাকদ্বীপের পড়ুয়াদের যেমন ৩৫ কিলোমিটার দূরে ডায়মন্ড হারবারে পরীক্ষা দিতে হবে।

পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বারোশোরও বেশি। একই সমস্যা সাগর মহাবিদ্যালয়, ধ্রুবচাঁদ হালদার কলেজ, ডায়মন্ড হারবার ফকিরচাঁদ, রায়দিঘি, শিশুরাম দাস, গৌরমোহন, শচীন মণ্ডল, ঢোলা এবং রায়দিঘি বি আর আম্বেদকর কলেজের পড়ুয়াদেরও। অধ্যক্ষরা বুঝতেই পারছেন না, এত পড়ুয়া কী ভাবে উৎসবের দিনে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবেন। অনেক ছাত্র-শিক্ষককে লঞ্চে, নৌকায় যাতায়াত করতে হয়। সাগরমেলার সময় সেগুলোও তেমন মেলে না। অনেক লঞ্চ প্রশাসন নিয়ে নেয় মেলা উপলক্ষে। বাস কার্যত থাকে না। কলেজগুলোতেও পুলিশ ক্যাম্প হয়।

এই সব সমস্যার কথা বিশদে জানিয়ে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহউপাচার্য (শিক্ষা) আশিস চট্টোপাধ্যায় এবং ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ামকের দপ্তরে চিঠি দিয়েছিলেন একাধিক অধ্যক্ষ। শিক্ষামন্ত্রীর জবাব মেলেনি। বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, তাদের কিছু করার নেই। এই মনোভাবকে অনেকে ন্যূনতম সংবেদনশীলতার অভাব হিসাবেই দেখছেন। সেই সঙ্গে বাস্তাব কাণ্ডজ্ঞানও যে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা, সেই অভিযোগও উঠছে।

কাকদ্বীপ কলেজের টিআইসি প্রবীর দাস বলেন, ‘আমাদের কলেজের ১২০০ পড়ুয়াকে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে ডায়মন্ড হারবার ফকিরচাঁদ কলেজে। কী করে ওরা যাবে, ভেবে পাচ্ছি না। বাস থাকে না। আমার ২৮-২৯ বছরের কর্মজীবনে এই প্রথম দেখলাম পরীক্ষা ফেলা হয়েছে পৌষ সংক্রান্তিতে। ২৪ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। প্রতিলিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও পরীক্ষা নিয়ামকের দপ্তরেও পাঠিয়েছি। কোনও সাড়া পায়নি।’ রায়দিঘি কলেজের অধ্যক্ষ শশবিন্দু জানা বলেন, ‘বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সহ-উপাচার্যকে গোটা পরিস্থিতি জানিয়েছি। কিন্তু আশ্বাস মেলেনি। মথুরাপুর স্টেশন থেকে আমাদের কলেজের দূরত্ব ২৩ কিমি। স্টেশন চত্বরে পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলা হয়। সাত দিন ধরে বাস তো দূর, অটো-টোটোও চলে না।’ ধ্রুবচাঁদ হালদার কলেজের অধ্যক্ষ সত্যব্রত সাহুর কথায়, ‘আমাদের তিন-সাড়ে তিন হাজার পড়ুয়া। চার-পাঁচটি কলেজে সিট পড়ে। সহ-উপাচার্যকে (শিক্ষা) সব জানিয়েছি। পাল্টা ওঁদের সমস্যার কথা শুনিয়েছেন।’ ফলে সঙ্কটে পড়ুয়া-শিক্ষকরা। উদ্বেগে অধ্যক্ষরা। কিন্তু বার বার ফোন করেও সহ-উপাচার্য আশিস চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তাঁর ফোন বেজে গিয়েছে।

স্নেহাশিস নিয়োগী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.