২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তাহার প্রকাশিত হয়েছে। তৃণমূলের আবার ইস্তাহার! অনেকেই মুচকি হাসছেন। বাজারে রসিকতাই চালু হয়েছিল তৃণমূল নেত্রী যদি দেশের বিদেশমন্ত্রী হন, তবে ভারতবর্ষের বিদেশনীতি কী হবে! একথা ঠিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসব নীতি-ফিতির ধার ধারেন না। প্রশাসক হিসেবে তার ব্যর্থতা চূড়ান্ত, তার থেকেও বড়ো হলো প্রশাসনের কোনও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা তিনি করেন না। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার অনেকেই আড়ালে-আবডালে বলে থাকেন যে প্রশাসক হিসেবে মমতা ভয়ংকর। তৃণমূল এবার যে ইস্তাহার প্রকাশ করেছে তাতে প্রশাসক মমতার সাফল্যের কিছু শুষ্ক পরিসংখ্যান রয়েছে, মূলত তাঁর ‘শ্রী’ জাতীয় বিভিন্ন প্রকল্পের গুণগান, এগিয়ে বাংলার ঢক্কানিনাদ ইত্যাদি, এগুলির বাস্তবায়নের কী হাল সেটা রাজ্যবাসী ভালোমতনই জানেন।
তার ওপরে রাজ্যে শিল্প নেই। ইস্তাহারে শিল্প-টিল্পের বিস্তর ফিরিস্তি আছে, তবে সেসব যে দৃশ্যমান নয় তা রাজ্যবাসীর চেয়ে ভালো আর কেই বা জানেন। তবে ভাগ্যিস চপ-শিল্প, সিন্ডিকেট-শিল্প, পাড়ার লাফাঙ্গা ক্লাব শিল্প ইত্যাদির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা উল্লেখ নেই— এও ভাগ্য! তবুও তৃণমূলের ইস্তাহার মোটেই ফেলে দেবার মতো নয়। বরং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনও গবেষক ভবিষ্যতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চরিত্র এবং তার পতনের কারণও যদি বিশ্লেষণ করতে চান তবে এই ইস্তাহারটি তার খুব কাজে লাগবে।
ওসব উন্নয়ন-টুন্নয়ন কিংবা কাজের ফিরিস্তি ভুলে যান, ইস্তাহারটি শুরু হয়েছে তীব্র মোদী বিরোধিতা দিয়ে। ইস্তাহারের প্রারম্ভে বড়ো হরফে লেখা ‘আমরা সবাই দেশের পক্ষে মোদীর পক্ষে নই। মানুষের স্বার্থে বিজেপি হটাও, দেশ বাঁচাও।’ এই রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসকের জীবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যবাসীর নাগরিক সুরক্ষা কেড়ে নিয়ে, চিটফান্ডের রমরমায় প্রত্যক্ষ মদত দিয়ে, রাজ্যের বিভিন্ন নির্বাচনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বিপন্ন করে কীভাবে মানুষের স্বার্থরক্ষা করেছেন তা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। সেনাকে অপদস্থ করা, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের জামাই আদরে পশ্চিমবঙ্গে স্থান দেওয়া, সীমান্ত এলাকাকে অনুপ্রবেশকারীদের মুক্তাঞ্চলে পরিণত করা ও সেই কারণে বি এস এফ-কে ক্রমাগত অস্বস্তিতে রাখা এবং এরই ফলস্বরূপ এন আর সি-তে বাধাদান— দেশের পক্ষে মমতা ব্যানার্জির কীর্তি অতুলনীয়। মোদীর পক্ষে তার না থাকার কারণটাও সবাই বোঝেন। মোদী জমানায় আপোশহীন ভাবে তাঁর একের পর এক কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু হয়েছে। মোদী ক্ষমতায় থাকলে মমতার সাড়ে সর্বনাশ। সুতরাং মোদী বিরোধিতা তাঁকে করতেই হবে। মোট ৭২ পাতার তৃণমূলের ইস্তাহারটি তন্ন তন্ন করে পড়ে ফেলেও এমন নতুনত্ব কিছু পাওয়া যায় না, যেগুলি তিনি নির্বাচনী জনসভায় এতদিন প্রলাপের মতো বলে গিয়েছেন, তার থেকে আলাদা করা যায়। তবুও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চরিত্র বুঝতে ইস্তাহারটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
মমতা ব্যানার্জি প্রশাসক হিসেবে অকর্মণ্য হতে পারেন, কিন্তু বিরোধী নেত্রী হিসেবে তিনি সর্বদাই তুখোড়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র কারণ ছিল আপোশহীন সিপিএম বিরোধিতা কমিউনিস্ট শাসকের নগ্নরূপ, প্রয়োজনে তারা কতটা নির্দয় হতে পারে, এমনকী দেশদ্রোহিতার প্রশ্নেও তারা নির্মমভাবে দেশদ্রোহী, এরকম হাজারো গুণসম্পন্ন সিপিএমকে উৎখাত করতে রাজ্যবাসী প্রস্তুত ছিলেন অনেকদিনই। কিন্তু নির্বাচন জালিয়াতির অভিনব পন্থা আবিষ্কার করেছিল সিপিএম—সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত যাকে ‘বৈজ্ঞানিক রিগিং’ বলতেন। বিরোধী কিছু নেতাকে কিনেও নিয়েছিল তৎকালীন শাসক সিপিএম। যাদের তরমুজ বলা হতো। অর্থাৎ বাইরে সবুজ, ভেতরে লাল। সিপিএম নামক জগদ্দল পাথরকে উৎখাত করা যাবে কেউ ভাবেনি। মমতা ব্যানার্জি এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন। তাই তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন উন্নয়নের ভাবনা কেউ ভাবেনি। সিপিএমকে উৎখাত করতে হবে— দলমতনির্বিশেষে সবাই মমতার পাশে এককাট্টা হয়েছিলেন স্রেফ এই আশাতেই।
কিন্তু ক্ষমতায় আসতে সুচতুর মমতা একটি বিশেষ কাজ করলেন, যে কাজের জন্য অধ্যাপক তথা বিশিষ্ট ইজিনিয়ার ও বর্তমান রাজ্যপাল (মেঘালয়) তথাগত রায় তাকে সিপিএমের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী বলে উল্লেখ করেছিলেন। সেই কাজটি হলো মুসলমান সম্প্রদায়কে তুষ্ট রাখার কৌশল। বাম আমলেই এই ধরনের কর্ম বেশ সুচারুভাবে করা হয়েছিল। মমতা তাকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। সিপিএমকে বেশ বুদ্ধিমান বলতে হবে এখানে। তাদের তুষ্টিকরণের এমন একটা সীমারেখা ছিল, যাতে হিন্দুরা না সচেতন হতে পারে। কিন্তু মমতা সব সীমারেখা ভেঙে দিয়েছেন। সিপিএমের আমলে ‘৪৬-৪৭-এর পটভূমি পুনরায় নিঃশব্দে রচিত হচ্ছিল, তৃণমূল আমলে তারই বিপদ-সংকেতে হিন্দুরা এককাট্টা হলো। আর হিন্দুদের এককাট্টা করার পেছনে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিজেপি ও দলনেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর দুর্ধর্ষ ভূমিকা।
এতেই প্রমাদ গুনেছেন মমতা। তার মদতপুষ্ট মুসলমানরা জঙ্গি আচরণে হিন্দুদের যে ক্ষতি গত আট বছর করে এসেছে, বিগত চৌত্রিশ বছরেও এতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ফলে মুসলমানদের সন্তুষ্ট রাখতে মোদী জুজু মমতাকে দেখাতে হবেই, আবার হিন্দুদের কাছেও বার্তা দিতে হবে। তাই কিছুদিন আগে অক্লেশে তিনি বাচ্চাদের পাঠ্যবইয়ে ‘রামধনু’কে ‘রংধনু’ করে দিয়েছিলেন। আজ তাকে রামনবমী পালন করে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে।
তৃণমুলের ইস্তাহারটা পড়লে সকলেই বুঝবেন উগ্র মোদী বিরোধিতা ছাড়া এতে আর কোনও সারবস্তু নেই। মমতার আজ বোঝার সময় এসেছে শুধুমাত্র নেগেটিভ ভোটিং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতা কায়েম করতে দেয় না। সিপিএম এরাজ্য থেকে উৎখাত হয়েছিল মমতার তথাকথিত ‘উন্নয়ন মুখী’ কর্মসূচিতে নয়। কোনও পজিটিভ ভোট সেদিন তৃণমূলের ভোটবাক্সে পড়েনি, সিপিএমের প্রতি গভীর ঘৃণায় মানুষ সেদিন তৃণমূলে ভোট দিয়েছিলেন। প্রশাসক হিসেবে মমতা তখন অপরীক্ষিত। সিপিএমের বিরুদ্ধে এই ‘পলিটিক্স’ই যে মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চাইছেন তৃণমূলের ২০১৯-এর লোকসভা ইস্তাহারে স্পষ্টভাবে দেখা গেল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকরা আগামীদিনে তৃণমূলের এই ইস্তাহারটিকে সমীক্ষায় আনলে অবশ্যই দেখবেন মমতার রাজনীতিক চরিত্রটাই হলো ‘বিরোধিতা’, ‘উন্নয়ন’-এর ছিটেফোঁটাও সেখানে নেই।
সাধারণ ইস্তেহার মানে উন্নয়নমুখী পরিকল্পনাগুলি সাধারণের সামনে রাখা, বিরোধী দল হলে শাসকদলের ত্রুটিগুলিকে তুলে ধরা, ক্ষমতায় এলে প্রতিশ্রুতি রূপায়ণ ইত্যাদি বোঝায়। তৃণমূল তার ইস্তেহারে একটি পরিকল্পনাও দেখাতে পারেনি যেখানে ভারতবর্ষ গড়বার অঙ্গীকার আছে। রাজ্যে তারা কী করেছে, তার পরিসংখ্যান আছে ঠিকই কিন্তু তার সঙ্গে বাস্তবের ফারাকটাও বড়ো বেশি চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে ইস্তাহারের নির্যাস অন্ধ মোদী বিরোধিতা। মমতা জানেন না যে সিপিএমের অপশাসনের সঙ্গে মোদীর সুশাসন মেলানো যায় না, এটা হতে পারে না। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়কে বিজেপি-জুজু দেখাতে না পারলে বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশের স্বপ্নে বড়ো বাধা পড়বে, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার দখলের স্বপ্নও অধরা থেকে যাবে। মমতার মুসলমান প্রেমের বহিঃপ্রকাশের তীক্ষ্ণতা এতই বেশি যে হিন্দুভোট ক্রমশ এককাট্টা হচ্ছে এটা তিনি ভালোমতোই বুঝেছেন। নির্বাচনী ইস্তাহারে তাই সালাম রমজানের শুভেচ্ছা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে তিনি কী কী দিয়েছেন তার সাড়ম্বরে উল্লেখ থাকলেও সেই মাথায় ঘোমটা টানা কঠোর সাম্প্রদায়িকতা যে তিনি এড়ানোর চেষ্টা করেছেন তা নজর করলেই বোঝা যাবে। এখানেই মোদীর জয়, তার সু-প্রশাসনের কৃতিত্ব। সুতরাং মুসলমানদের ‘নেগেটিভ ভোট’-এর আস্থাতেই যে মমতা আরও একবার বাজিমাতের ছক করছেন, এই ইস্তাহার তার দলিলও হয়ে রইল।
কিন্তু এ যে অত্যন্ত কঠিন ঠাঁই, মমতা কি তা বোঝেন না! বোঝেন বিলক্ষণ। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো’, ‘অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি’, ‘বহুত্ববাদ’, ‘মৌলবাদী ও ‘সাম্প্রদায়িক অপশক্তি’ ইত্যাদি শব্দবন্ধনী আমরা কেবল ‘ইস্তাহার’ লিখতে অভ্যস্ত একটি দলের ইস্তাহারেই দেখছি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন সিপিএমের ম্যানিফেস্টোর কথাই বলা হচ্ছে। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে সিপিএমের সঙ্গে লড়াই তাকে ‘মমতা ব্যানার্জি’ করল, তাদের ম্যানিফেস্টোর কিছু ক্লিশে হয়ে যাওয়া, নির্বোধ শব্দচ্চারণকে ধারণ করেই মমতাকে তাদের দলের ইস্তাহারে স্বাক্ষরিত বয়ান দিতে হচ্ছে। দেশদ্রোহীরা আজ বুঝেছে সিপিএম দেউলিয়া, তাই তাদের দেশদ্রোহিতার নয়া ঠিকানা তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূলের ইস্তাহার যেন তারই প্রমাণ দিল।
অভিমন্যু গুহ
2019-04-22