শুরুটা হয়েছিল পাড়ার মোড়ে ‘সততার প্রতীক’ কাটআউট টাঙিয়ে। ভাবখানা এমন ছিল যেন স্বর্গের দেবদূতদের আসর থেকে পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রথম কোনো সততার প্রতিমূর্তি নেমে এলেন। তার আগে এ রাজ্যে আর কোনো সৎ রাজনীতিকের জন্ম হয়নি। অথচ তিনি, মানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজনীতির আঙিনায় পা রাখার আগেই এখানকার মানুষ ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়, ত্রিদিব চৌধুরী, অতুল্য ঘোষ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরিপদ ভারতী প্রমখ রাজনীতিককে দেখে ফেলেছেন। এবং এও দেখেছেন, এই আদ্যন্ত সৎ রাজনীতিকরা নিজেদের নামের পাশে ‘সততার প্রতীক’ উল্লেখ করে প্রচারে নামেননি। রাজ্যের রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম রাজনীতিক, যিনি ‘সততার প্রতীক’ কাট আউট টাঙিয়ে নিজের সততাকে প্রচার করতে নেমেছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নিজের সততাকে এমনভাবে বিপণনযোগ্য করে তোলেন কারা? তারা কি প্রকৃত অর্থেই সৎ, নাকি তাদের সততা একটি ভানমাত্র ?বলতেই হচ্ছে স্বঘোষিত ‘সততার প্রতীকরা আসলে নিজেদের দষ্কর্মগুলি ঢাকতেই সৎ সাজার ভান করেন। ভান করেন। নিজেদের অন্ধকার দিকটি আড়াল করার জন্য। সততার প্রতীকমমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালো দিকটি উঘাটিত হতেও বেশি দিন সময় লাগেনি অবশ্য।‘সততার প্রতীক’ কাট আউট টাঙিয়ে প্রচার করার কিছুদিন পরেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডক্টরেট ডিগ্রিটি আসলে জাল। এটি প্রমাণ হয়ে। যাওয়ার পরে অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নামের আগে ‘ডক্টর’ যেমন ব্যবহার করেননি, তেমনই সততার প্রতীক কাটআউট টাঙিয়ে প্রচারটাও বন্ধ করেছেন।
এখন এত বছর পর, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আট-আটটি বছর অতিক্রম করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আবার দেখা যাচ্ছে সৎ সাজার ভান করতে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পর এখন মমতা বলতে শুরু করেছেন তার দলের যারা কাটমানি খেয়েছেন, তাদের কাটমানির টাকা ফেরত দিতে হবে। মমতার এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে জেলায় জেলায় তার দলের ছোটো, বড়ো, মেজো নেতারা স্থানীয় মানুষের হাতে ঘেরাও হচ্ছেন। কাটমানি ফেরানোর দাবি জোরদার হয়ে উঠেছে। কাটমানি ফেরত দিতে বলে মমতা এমন ভান করেছেন, যেন তিনি বিষয়টি কিছুই জানেন না। হঠাৎ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়ে তিনি বিষয়টি মেলেছেন। আসলে সৎ সাজার ভান করে তিনি নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে আড়াল করতে চাইছেন। কিন্তু সৎসাজার ভান করলেও ভবি ভুলবার নয়। কাটমানি ফেরত দেওয়ার কথা ঘোষণা করে তিনি যতই তার দলের মেজো সেজো নেতাদের ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চান না কেন, কিছু প্রশ্ন তাঁকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকবেই। এখানে আরও একটি বিষয়ও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য যে, এই প্রথম এই দেশের কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তার দলের দুর্নীতির কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন। এখন প্রশ্ন হলো, হঠাৎ রাতারাতি এভাবে কাটমানি ফেরত দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন কেন মুখ্যমন্ত্রী, সরকারে থাকার আট বছর পরে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কাটমানি ফেরত দেওয়ার ঘোষণায় কেউ কেউ আহ্লাদিত হলেও হতে পারেন। ভাবতেও পারেন, তৃণমূল কংগ্রেস দলটার বাকি সকলে অসৎহলেও, একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সততার পরাকাষ্ঠা। এই ভেবে আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইমেজ বিল্ডিংয়েও নিয়োজিত হতে পারেন তারা। কিন্তু এসব ভাবার আগে তাদের আর একটু ভাবার অনুরোধ করি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই আট বছরের শাসনকালের ভিতরই তোলাবাজরা গিয়ে এলগিন রোডে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বাসভবনে হানা দিয়েছে। সমস্ত রাজ্য তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনায়। শুধুমাত্র মমতা জানেন না— একথা কি মেনে নেওয়া যায় ? বাগুইআটি-কেষ্টপুর অঞ্চলে সিন্ডিকেটের এলাকা দখলের লড়াই খুনোখুনির পর্যায়ে পৌঁছেছিল। মমতার দলেরই দুই নেতা একে-অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন । মমতা জানেন না? তোলাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে এই রাজ্য থেকে শিল্পপতিরা পাততাড়ি গুটিয়েছেন— মমতা জানেন না, একথা বিশ্বাস করতে হবে? সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে মমতার সাংসদ, বিধায়করা জেল খেটেছেন। এর কী ব্যাখ্যা দেবেন মমতা? কার স্বার্থে তিনি সারদাকাণ্ডে অভিযুক্তদের আড়াল করতে গিয়েছিলেন? আসলে এই কাটমানি ফেরতের কথা বলাটাও তার সততার প্রতীক হোর্ডিং টাঙানোর মতোই স্টান্ট। যে মমতা প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন তার দলে কেউ ঘুষ খায় না, সেই মমতাই যখন কাটমানি ফেরত দেওয়ার কথা বলেন, তখন বুঝতেই হবে ইদুর এতদিনে কলে পড়েছে।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যদি এই রাজ্যে আঠারোটি আসন দখল করতে না পারতো– একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাহলে কখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাটমানি ফেরত দেওয়ার কথা বলতেন না। বরং তার ভাই-বেরাদরদের কাটমানি এবং তোলাবাজির আসর জাঁকিয়ে বসত এই রাজ্যে। এখন বলছেন, কেননা বুঝতে পারছেন, আট বছরের মাথাতেই তার এবং তার দলের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে এসে পৌঁছেছে। মমতার এই কাটমানি ফেরত দেওয়ার হুংকারের পিছনেও একটি রাজনৈতিক কৌশল কাজ করেছে। মনে রাখবেন, কাটমানি ফেরত দেওয়ার কথা বলার ঠিক একদিন আগে নবান্নে মমতা দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে। নবান্ন সূত্রেরই খবর, এই বৈঠকটাই ছিল ২০১৯-এর এই বিপর্যয়ের পর ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে কীভাবে মমতার ভাবমূর্তি আবার উজ্জ্বল করা যায় তার কৌশল নির্মাণের। নবান্ন সূত্র জানাচ্ছে, ওই বৈঠকে বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের কাটমানি এবং তোলাবাজির বিষয়টি ওঠে। বিষয়টি তোলেন স্বয়ং প্রশান্ত কিশোর। প্রশান্ত কিশোর মমতাকে বলেন, এই তোলাবাজি এবং কাটমানির অভিযোগই তৃণমূলের ক্ষতি করেছে। ওই বৈঠকের পরেই মমতা কিন্তু কাটমানি ফেরত দেওয়ার কথা বলেছেন। আরও লক্ষ্যণীয় প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে ওই বৈঠকের পরেই মমতা কিন্তু তার সেই আক্রমণাত্মক ভঙ্গি পাল্টে ফেলে অনেকটাই নমনীয় হয়েছেন। বোঝাই যায়, প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে রাজনৈতিক কৌশল হিসাবেই কাটমানি ফেরতের কথা এখন বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর ভিতর তার আন্তরিকতা খুঁজতে যাওয়ার অর্থ বোকামি। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। মমতা যে কাটমানি ফেরানোর ডাক দিলেন, সে ডাকে তার দলের রাঘব বোয়ালরা সাড়া দেবেন তো? ফেরত দেবেন তোরা কাটমানি? দার্জিলিঙের ডেলোর বাংলোয় বৈঠকের পর মমতার দলের যে রাঘব বোয়ালরা সুদীপ্ত সেন আর গৌতম কুণ্ডুর থেকে দু’হাতে টাকা লুটেছিলেন, তারা টাকা ফেরত দেবেন তো? সুদীপ্ত সেন এবং গৌতম কুণ্ডু দুজনেই যদি এখন টাকা ফেরত চান তাহলে কী হবে? প্রতিমাসে তেরোটি গাড়ির কনভয় নিয়ে মমতার দলের যে সর্বশক্তিমান নেতা পুরুলিয়া-আসানসোলের কয়লা মাফিয়াদের কাছ থেকে টাকা আনতে যান তিনি কাটমানি ফেরত দেবেন তো? বন্দর অঞ্চলের যে নেতাকে কাটমানি না দিলে বন্দরে কাজ করা যায় না, বা উত্তর চব্বিশ পরগনায় যে বিধায়ক গোরু পাচারের টাকা খান—তারা টাকা ফেরত দেবেন তো? হরিশ মুখার্জি রোডে মমতার দলের যে নেতা প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছেন তার তোলাবাজির টাকা কে ফেরত দেবে? গত আটবছরে জনৈক রঞ্জিত ঘোষের স্ত্রী ও তার পরিবার যেভাবে ২১টি জমি-বাড়ি কিনে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পত্তি বানিয়েছেন—তারা তোলাবাজির টাকা ফেরত দেবেন তো? এই প্রশ্নগুলি এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা নিজের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোকজনদের আড়াল করতে মমতা যেভাবে মেজো-সেজো নেতাদের ফাঁসিয়ে দিয়েছেন, তারাই নিজ নিজ পিঠ বাঁচাতে এইসব প্রশ্ন। অচিরেই করতে থাকবেন। কারা কারা কোথায় কীভাবে তোলার বখরা খেয়েছেন— তা এই নেতাদের থেকে আর ভালো কেউ জানেন না। কয়লা মাফিয়াদের কাছ থেকে তোলার টাকা এই মেজো-সেজো নেতাদের হাত হয়েই বড়ো মাথার কাছে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যেই পুরুলিয়ার এক তৃণমূল নেতা দলের অন্দরেই হুমকি দিয়ে। রেখেছেন— ‘আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা হলে আমি কান-মাথা ধরে টান দেন। তখন গোটা দলটাই জেলে যাবে।
প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শে কাটমানি ফেরত দেওয়ার রাজনৈতিক চালটি চেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ সুবিধা হবে বলে মনে হচ্ছে না। বরং, তিনি কাটমানি ফেরত দেওয়ার কথা বলে দলের অন্দরে একমূষল পর্বের সূচনা করে দিয়েছেন। অচিরে, এই কাটমানি প্রসঙ্গেই দলীয় নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করবেন। আর সে আক্রমণের হাত থেকে কাচের ঘরে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও রেহাই পাবেন না। আসলে পচনটা অনেকদিন আগে মাথাতেই ধরেছে। এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বাঙ্গে। মনে পড়ছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সেই ভুবন ও তার মাসির গল্প। খুব অল্প বয়সেই চুরি বিদ্যায় হাত পাকিয়েছিল ভুবন। ভুবনের চুরি বিদ্যার কথা জেনেও তার মাসি তাকে কখনো শোধরানোর চেষ্টা করেনি। শেষে ভুবন পুলিশের জালে ধরা পড়ল। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলো ভুবন। আদালতে দাঁড়িয়েই ভুবন বিচারককে বলেছিল—আমার ইচ্ছেমাসির সঙ্গে একবার কথা বলে যাই। আদালতের অনুমতিতে ভুবনের মাসিকে ভুবনের সামনে আনা হলো। ভুবন মাসিকে বলেছিল— ছোটোবেলা থেকে তুমি যদি আমাকে শাসন করতে আজ তাহলে আমার এই দশা হতো না। বলে মাসির কান কামড়ে ছিড়ে নিয়েছিল ভুবন।
শাসন যদি করতেই হয়, তাহলে প্রথমেই শাসন করা উচিত ছিল মমতার। এখন তো ভুবনের কান কামড়ে ছিঁড়ে নেওয়ার পালা। এখন মমতাকে কান বাঁচাতে হবে।
রন্তিদেব সেনগুপ্ত
2019-07-06