সিন ওয়ান- ১১ এপ্রিল তখন সবে ঘণ্টা দেড়েক ভোট হয়েছে। টেলিভিশন ক্যামেরা আর বুম দেখতে পেয়ে ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি কোচবিহারের তৃণমূল জেলা সভাপতি তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। বলেন, “অনেক বুথে রিপোল করতে হবে।”

সিন টু- ১১ এপ্রিল সকাল সাড়ে দশটা। দার্জিলিং-এর চক বাজারে সভা করতে যাওয়ার আগে, বাগডোগরা বিমানবন্দরের লাউঞ্জ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন রবিবাবুকে। জিজ্ঞেস করেন, “কীরে কেমন ভোট হচ্ছে?” যে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ অন্য সব ভোটে সক্কাল সক্কাল মার্জিন বলে দিতেন, তিনিই খানিকটা উদ্বিগ্ন গলায় দিদিকে বলেন, “দিদি বিএসএফ খুব ডিস্টার্ব করছে।”

কাট টু ২৪ এপ্রিল- ভোটের ময়না তদন্ত করতে বসে রবীন্দ্রনাথ ঘোষের নিজের এলাকা নাটাবাড়ি বিধানসভার বৈঠক উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তৃণমূল সূত্রের খবর, সমস্ত অঞ্চল সভাপতিদের থেকে মার্জিন জানতে চান জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। কিন্তু কেউই রবিবাবুকে আশার কথা শোনাতে পারেননি। আর এতেই ক্ষেপে যান মন্ত্রী। সূত্রের খবর, প্রায় দশ জন অঞ্চল সভাপতিকে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়ে জেলা সভাপতি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন “আপনারা এ বার আসতে পারেন (দল থেকে)।” যা দেখে অনেকেই মনে করছেন, ভোটের পর তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা মনে করছে, কোচবিহার আসন জেতা শুধু শক্ত নয়। খুবই শক্ত।

দশজন অঞ্চল সভাপতিকে পদত্যাগের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি, একাধিক নেতাকে হুঁশিয়ারির সুরে বলে দেওয়া হয়েছে, ২৩ মে-র পর দেখে নেওয়া হবে। নাটাবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রের গুড়িয়াহাটি -১ , দেওয়ানহাট , জিরানপুর , বলরামপুর – ১ , বলরামপুর -২ , আন্দারান ফুলবাড়ি-২  , নাটাবাড়ি -১ , নাটাবাড়ি -২ ও ধলপল গ্রাম পঞ্চায়েতের সভাপতিদের পরিষ্কার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ । জিরানপুর অঞ্চলের সভাপতি বিমান দেব জানিয়েছেন, যেহেতু তাঁর অঞ্চলে সেই পরিমানের লিড হবে না, তাই তিনি ইস্তফাপত্র দিয়ে এসেছেন । অন্যদিকে বলরামপুর – ১ নং অঞ্চলের সভাপতি নীরেন নারায়ণ জানান , তাঁর এলাকায় গোষ্ঠী কোন্দল তীব্র । এখানে কেউ কাউকে নেতা মানেন না । তার উপর বিজেপির প্রভাব বেড়েছে অনেকটাই । বিজেপির প্রচারে বিভ্রান্ত হয়েছেন অনেকেই । ফুলবাড়ি -২ অঞ্চলের সভাপতি ক্ষেত্রনারায়ণ বর্মা বলেন, “উন্নয়নের নিরিখে ভোট হয়নি । সম্ভাব্য ফলাফলের আভাস পেয়ে  ক্ষেপে গিয়েছেন জেলা সভাপতি। আর তাই সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছেন।”

রবীন্দ্রনাথবাবু পোস্টমর্টেম বৈঠকের কথা মেনে নিলেও, পদত্যাগ করানোর কথা স্বীকার করেননি। জেলা তৃণমূলের সহ সভাপতি জলিল আহমেদ বলেন, “জেলা সভাপতি সঠিক কাজ করেছেন । পদে থাকলে কাজ করতেই হবে । আর রেজাল্ট দিতে না পারলে সরে যেতে হবে।” তৃণমূলের একটি সূত্রের মতে, গোটা কোচবিহার লোকসভার যে রিপোর্ট জেলা সভাপতির কাছে পৌঁছেছে, তাতে এটাই উঠে এসেছে যে, সিতাই ছাড়া আর কোনও বিধানসভায় লিড হওয়া মুশকিল।

কোচবিহারে এ বার তৃণমূলের প্রেস্টিজ ফাইট। দল থেকে বহিষ্কৃত নিশীথ প্রামাণিককেই প্রার্থী করেছিল বিজেপি। একদা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-ঘনিষ্ঠ নেতা ঘুম ছুটে দিয়েছেন শাসক দলের। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, তৃণমূল নেতারা আসলে বুঝতেই পারছেন না ইভিএম-এ কী হয়েছে। তাঁদের মতে, গত কয়েকটি নির্বাচনে উত্তরবাংলার এই জেলায় ভোট বলে কিছু হয়নি। যা লড়াই, সংঘর্ষ হয়েছে, সবটাই তৃণমূল বনাম তৃণমূল। মাদার বনাম যুব। এই নিশীথের দাপটেই রবীন্দ্রনাথ গোষ্ঠীকে সিঁটিয়ে থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন।  এ বার সেই নিশীথই গেরুয়া শিবিরের তুরুপের তাস। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তো মাথাভাঙার জনসভা থেকে বলেই এসেছিলেন, “তোমারই শিল, তোমারই নোড়া, তোমারই ভাঙব দাঁতের গোড়া।” রাজনৈতিক মহলের মতে, তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষার প্রতিফলন যদি সত্যিই বাস্তবে পড়ে, তাহলে বিজেপি-র ঠোঁটে চওড়া হাসি আসাটাই স্বাভাবিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.