লোকসভা ভোটের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিকানা এখন উত্তরবঙ্গ। সেখানে তিনি প্রতিপক্ষ তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দিচ্ছেন না। অথচ কালীঘাটে খোদ তাঁর পরিবারেই অন্তর্দ্বন্দ্বের পরিবেশ।
সোমবার সন্ধ্যায় কালীঘাটের পটুয়াপাড়ার জয়হিন্দ ভবনে কলকাতা পুরসভার ৭৩ নম্বর ওয়ার্ড তৃণমূল কংগ্রেসের ঘরোয়া কর্মী সম্মেলন ডাকা হয়েছিল। যেখানে প্রকাশ পেল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ভিতরকার দ্বন্দ্ব। ভাই বনাম ভাইপো!
ওই কর্মী সম্মেলনের শুরুতেই বক্তৃতা করছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে, দক্ষিণ কলকাতার অন্তর্গত ভবানীপুর বিধানসভায় ১৭৬ ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রে এমন ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছিল শাসক দলের। বিষয়টি উল্লেখ করে কোন ওয়ার্ড থেকে কত লিড হয়েছিল বা কত ভোটে তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত বক্সী পিছিয়ে পড়েছিলেন তার ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন কার্তিক। আচমকাই সভায় পিছনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা অভিষেক অনুগামী তথা ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডের যুব তৃনমূলের সভাপতি অতনু পাল বলে ওঠেন, “এই সভায় কর্মীদেরও বলার সুযোগ দিতে হবে।” জবাবে কার্তিক বলেন “এই সভার আয়োজন করা হয়েছে শুধুমাত্র নেতাদের কথা শোনার জন্য।” আবারও অভিষেক অনুগামী অতনু বলেন, “কর্মীদের বলার সুযোগ দেওয়া উচিত।” এ বার কার্তিক বলেন, “কর্মীদের বলার জন্য গড়ের মাঠে ব্যবস্থা করে দেব। এখানে কিছু বলা যাবে না।”
এমনটা শোনার পরেই একে একে জয়হিন্দ ভবন ছাড়তে শুরু করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামীরা। ঘটনাচক্রে, যে অতনু পালের কথায় কর্মিসভায় দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, সেও কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাল্যবন্ধু। দীর্ঘদিন দু’জনে একসঙ্গে রাজনীতিও করেছেন। কিন্তু, কালীঘাটের রাজনীতিতে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে এখন অভিষেক। তৃণমূলের একাংশের মতে, তাই কাকার হাত ছেড়ে এখন ভাইপোর পক্ষ নিয়েছেন অতনু! ফলে একসময়ের বন্ধুর সঙ্গে এখন বৈরিতামূলক সম্পর্ক কার্তিকের।
সোমবারের কর্মসূচিতে যোগ দিতে এসেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক দুলাল সেনও। যাঁকে কার্তিক-অভিষেক দ্বন্দ্বের জেরে ৭৩ নম্বর ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে সরিয়েছিলেন স্বয়ং তৃণমূল সুপ্রিমো। তিনিও অনুগামীদের সঙ্গেই সভাস্থল ছেড়ে চলে যান। যখন অভিষেক অনুগামীরা জয়হিন্দ ভবন ত্যাগ করেছিলেন, মাইক্রোফোন হাতে কার্তিক তাঁদের অনুরোধ করেন, “যাঁরা সভা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা একটু দ্রুততার সঙ্গে বেরিয়ে যান। তাহলে সভা পরিচালনা করতে সুবিধা হয়।” এই ঘটনার সময় কর্মী সম্মেলনের মঞ্চে বসে পুরো বিষয়টি দেখছিলেন দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূল সভাপতি দেবাশিস কুমার, মেয়র পারিষদ বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়, ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রতন মালাকার ও ৭২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর ভাই সন্দীপ বক্সী। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামীরা সভা ছেড়ে চলে গেলে বক্তৃতা করতে ওঠেন দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূলের সভাপতি দেবাশিস কুমার। ঘটনার রেশ ধরেই তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দলে মত পার্থক্য থাকতেই পারে। তবে মনান্তর যেন কখনই না হয়। আমাদের লক্ষ্য, আমাদের নেত্রীকে সব আসনে জিতিয়ে দিল্লি পাঠানো। তাই মতান্তরের প্রভাব যেন কোনওভাবেই ফলাফলকে প্রভাবিত না করে।” একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়ও।
এই ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডেই থাকেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ওয়ার্ডের ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশন তাঁর ভোট কেন্দ্র। কিন্তু লোকসভা ভোটের সময় নিজের ওয়ার্ডে পারিবারিক দ্বন্দ্বের ঘটনা মুখ্যমন্ত্রীর অস্বস্তি বাড়াতে পারে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। যা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রচারের বড় হাতিয়ার হতে পারে। ঘটনাচক্রে সোমবারের সভায় রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী ও প্রার্থী মালা রায় আসার কথা থাকলেও, তাঁরা উপস্থিত ছিলেন না।