পশ্চিমবঙ্গে তোলাবাজি সাম্প্রতিককালে এক মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাধির সংক্রমণ শুরু বাম রাজত্বের মাঝামাঝি সময় থেকে। প্রথম দিকে এই ব্যাধি সীমাবদ্ধ ছিল প্রভাবশালী কিছু বাম নেতৃত্বের মধ্যে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে ছোটো, বড়ো ও মাঝারি নেতাদের মধ্যে। ফলে যাদের ছিল খড়, মাটি, বাঁশ, টালি মায় টিনের ঘর, তাদের পাকাঘর হয়েছে। কারও বা দোতলা, তিনতলা বাড়ি। যারা বিড়ি খেত, তাদের পকেটে উঠেছে দামি সিগারেটের প্যাকেট। যাদের পায়ে ছিল চপ্পল, তাদের চরণ ঢেকেছে দামি জুতোয়। পোশাক-পরিচ্ছদেও এসেছে চাকচিক্য। জীবনযাত্রায়ও এসেছে বাহুল্য। তোলা বা কাটমানি ছাড়া কেউ কোনো কাজই করতে পারছে না। আর সেই তোলাবাজি, কাটমানি বা ঘুষের দৌলতে নেতারা এক একজন হয়েছে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ। অর্থাৎ তাদের বাড়ি হয়েছে, সম্পত্তি হয়েছে, সাইকেলের পরিবর্তে হয়েছে বাইক বা গাড়ি। ‘প্রলেতারিয়্যাট’ বা সর্বহারা ও শ্রমজীবী মানুষের পার্টি পরিণত হয়েছে ‘বুর্জোয়া’ পার্টিতে। সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা হয়েছেন একনায়কতান্ত্রিক, আর গরিব হয়েছে সর্বহারা। সাধারণ মানুষ সব দেখেছে, সব বুঝেছে। তারা ভণ্ড, প্রতারক ও দুর্নীতিবাজ মার্কসবাদীদের সমুচিত শিক্ষা দিতে তৈরি হতে থাকে। বাম জমানার শেষ দিকে বামমার্গীদের কুশাসন, দুর্নীতি, অরাজকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক হানাহানি ও খুনোখুনি রাজ্যের গণতান্ত্রিক ও সামাজিক পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে। মানুষ হয়ে ওঠে অতিষ্ট। এমতাবস্থায় , তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন এক গণ আন্দোলনে পরিণত হলে শাসকদল ও সরকার নির্মম দমন-পীড়নের আশ্রয় নেয়। সশস্ত্র সিপিএম হার্মাদ ও পুলিশের গুলিতে হতাহত হয় বহু আন্দোলনকারী। মানুষ খুন করে গুম করা হয় অসংখ্য লাশ। সিঙ্গুরের মাঠে শাসকদলের গুন্ডারা তাপসী মালিককেশারীরিক নিগ্রহ করে তার দেহ জ্বালিয়ে দেয়। এহেন রাজনৈতিক অবক্ষয়ের মধ্যে ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত হয়। রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জনগণের ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস জয় পায়। বাম-শাসনের অবলুপ্তি ঘটে। কমিউনিস্ট অপশাসনের হাত থেকে বঙ্গবাসী মুক্তি পায়।
মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল সরকার গঠিত হওয়ার পর দু’এক বছরের মধ্যেই শাসকদল ও সরকারে ঢুকে পড়ে বামশাসনের ‘ভাইরাস। দলে দলে বাম বিধায়ক, নেতা-কর্মী, সমর্থকরা যোগ দিতে থাকে। তৃণমূলে। সরকারি দলের সুবিধা নিয়ে পুরানো ও নব্য তৃণমূলিদের প্রায় সবাই মেতে ওঠে আর্থিক দুর্নীতি বা তোলাবাজিতে। সরকারি প্রকল্পের টাকা নয় ছয় হতে থাকে। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতগুলি হয়ে ওঠে দুর্নীতির আখড়া। শুরু হয় হরিরলুট। সাথী’ ও ‘শ্রীযুক্ত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প খাতে সরকারের দেওয়া জণগণের প্রাপ্য টাকায় বসে ‘কাটমানি’ খাওয়া এবং নির্মাণ কাজ, কুটির শিল্প ও যে-কোনো ব্যবসা করতে গেলে তোলা দেওয়া হয়ে ওঠে বাধ্যতামূলক। তোলাবাজিকে ‘দিদির ভাইয়েরা এমন এক করেকম্মে খাওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যায় যে সৎকারের জন্য গরিব পরিবারগুলিকে দেওয়া সরকারের ২০০০ টাকায়ও ১০ শতাংশ নিতে থাকে কাটমানি। এর চেয়ে অমানবিকতা ও নির্মমতা আর কী হতে পারে? ‘দিদি’ এসবই জানেন। আবার বালি, কয়লা ও পাথর খাদানগুলি থেকে পার্টির মদতে শাসক দলের গুন্ডামস্তানরা অবৈধভাবে বালি-কয়লা-পাথর তুলে চড়া দামে বিক্রি করছে। অবশ্য উপার্জিত টাকার একটা বড়ো অংশ যাচ্ছে দলের ‘রাঘব বোয়ালদের পকেটে। এ ব্যাপারে অবশ্য তৃণমূলনেত্রী চুপ। তাই বিরোধীরা তৃণমূল সরকারকে ‘তোলবাজদের সরকার’ বলে তকমা দিয়েছেন।
২০১৪-র লোকসভা ও ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রচণ্ড জালিয়াতি, কারচুপি, রিগিং এবং বহুক্ষেত্রে ভোটকর্তা ও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ভুল পথে পরিচালিত ও ‘ম্যানেজ করে এবং শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকায় ভোটে জিতেছে। কিন্তু বিগত পৌর ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপক সশস্ত্র সন্ত্রাস, খুনোখুনি ও ভোট ডাকাতি করে জয় পেলেও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার ভোট দিতে পারেনি। বিরোধী দলগুলির শতাধিক কর্মী খুন হয়েছে। ফলে অধিকাংশ মানুষ এই সরকারের উপরে হয়েছে ক্ষুব্ধ। পক্ষান্তরে, কেন্দ্রের মোদী সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প দ্বারা রাজ্যের বহু মানুষ উপকৃত হয়েছে। তাছাড়া তৃণমূলনেত্রীর মাত্রাতিরিক্ত মুসলমান তোষণে বিরক্ত জনতার মধ্যে ঘটেছে সাম্প্রদায়িক বিভাজন। আর এসবের প্রতিফলন ঘটেছে ১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে। এ রাজ্যে বিজেপি ১৮টি আসন জিতে তৃণমূলের ঘাড়ে ফেলছে নিঃশ্বাস। আর তাতেই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নেত্রী প্রলাপ বকছেন। আর রাজ্যের চলমান রাজনৈতিক হিংসা, খুন ও সন্ত্রাস বন্ধ না করে, সৎ সাজার জন্য বিরোধীদের মুণ্ডপাত করে তিনি জেলায় জেলায় গিয়ে নেতাদের জনগণের কাছ থেকে নেওয়া ‘কাটমানি’ ফেরত দিতে বলছেন ক্ষতিগ্রস্ত জনতাও টাকা ফেরত চাইতে নেতাদের বাড়ি চড়াও হচ্ছেন। আগামীতে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে এই প্রক্রিয়া। টাকা ফেরত না পেলে তারা টাকার দাবিতে ছুটে যেতে পারে কলকাতায়—“দিদি’ বা ‘ভাইপো’র কাছে। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। তাই বলতেই হয়, তোলাবাজিতে বামেদেরও হারিয়ে দিয়েছে তৃণমূল।
ধীরেন দেবনাথ
2019-07-06