শিবরাত্রি স্পেশ্যাল : ষাঁড় কীভাবে হল শিবের বাহন? পড়ুন, শিব পুরাণের আশ্চর্য কাহিনি

যার শিল যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া-এই হল অসুরদের মূলমন্ত্র। তাই সে-বার দেবতাদের কাছে গো-হারান হেরে গিয়ে ময়, তারক আর বিদ্যুৎমালী—এই তিন অসুরভাই প্রতিশোধ নেবার জন্য একেবারে উঠে পড়ে লাগল। ইচ্ছে, দেবতাদের কাছ থেকে বর নিয়ে দেবতাদেরই বাঁশ দেওয়া! শুরু করল ব্রহ্মাকে তুষ্ট করার জন্য কঠোর তপস্যা। সে একেবারে টানা কয়েকশো বছরের তপস্যা! ফলে, ইচ্ছে না-থাকলেও ব্রহ্মার তুষ্ট না-হয়ে আর উপায় রইল না। তিনি তিনভাইয়ের কাছে এসে বললেন যে, তিনি তাদের বরে তুষ্ট হয়েছেন; এবার তারা ইচ্ছেমতো বর চাইতে পারে। ‘ইচ্ছেমতো বর’ চাইতে বললে অসুরদের আনন্দের আর অন্ত থাকে না। তাদের তো একটাই ইচ্ছে, অমরত্ব আদায় করে আদাজল খেয়ে দেবতাদের পেছনে লেগে এন্তার নাকানিচোবানি খাওয়ানো! তাদের এই ইচ্ছের কথা শুনে আঁতকে উঠে ব্রহ্মা বললেন, ক্ষ্যামা দাও বাপুরা, ঐটি হবে না! অমরত্ব তো দিতে পারব না। ও জিনিস চাইলেই তো আর দেওয়া যায় না! তোমরা বরং অন্য কিছু চাও।

অসুরদের একটা জিনিস ভালো, বরটরের ব্যাপারে দেবতারা একবার ‘না’ বললে সেটা নিয়ে আর ঘ্যানর ঘ্যানর করে মানুষের মতো বিরক্ত করে না। তারা অমনি বিকল্প রাস্তায় অমরত্বের কাছাকাছি কিছু একটা চেয়ে নেয়। তাই বড়ভাই ময় বুদ্ধি করে বলল, হে ব্রহ্মদেব, আমরা যেন দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ অধিকার করতে পারি, সমস্ত দেবতার অস্ত্র হরণ করতে পারি আর আমরা তিন ভাই তিনটি শূন্যে ভাসমান পুরী নির্মাণ করতে চাই, সেই তিনটি পুরী এক তিরে কেউ যদি একসঙ্গে ভেদ করতে পারে, তবেই আমাদের মৃত্যু হবে, নয়তো নয়—আমাদের এই বর দিন!

নাঃ, দেবতাদের কপাল থেকে ফাঁড়া আর কাটানো গেল না! কাঁহাতক আর ‘না’ করা যায়! কাজেই ব্রহ্মা ‘তথাস্তু’ বলে হাঁস নিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন।

বর বাগিয়ে তিন ভাইয়ের ফুর্তি তখন দেখে কে! দৈবযোগে শূন্যে নির্মিত হল তিনটি পুরী বা প্রাসাদ। একটি লোহার, একটি রূপোর আর একটি সোনার। রত্নমালায় সাজানো হল সেই তিনখানি প্রাসাদ, মানিকের আলোয় উজ্জ্বল হল প্রতিটি কোণা, ভাসমান উদ্যান ও পুষ্করিণীতে সুসজ্জিত হল তিন প্রাসাদের চৌহদ্দি, লক্ষ লক্ষ দাসদাসী, অসুর সৈন্য, গায়ক-নর্তকীদের বিভঙ্গে ফুটে ফুটে উঠতে লাগল তিন প্রাসাদের ভোগবিলাসের বাহুল্য। ময় নিজে সোনার প্রাসাদটি নিয়ে, বিদ্যুৎমালীকে দিল রূপোর প্রাসাদ আর তারককে দিল লোহার প্রাসাদটি। তিন প্রাসাদকে এক তিরে বিদ্ধ করার মতো বীর ত্রিলোকে কেউ আছে নাকি? কেউ নেই! তাহলে তাদের মারবে কে? কেউ না! তাহলে তো তারা বলতে গেলে অমরই! ভারি নিশ্চিন্ত হয়ে তিন প্রাসাদে তিন ভাই অতুল ভোগে গা ভাসিয়ে দিল।

ভোগের মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, ব্রহ্মার কাছে পাওয়া আদ্দেক বর তো এখনও ব্যবহার করাই হয়ে ওঠে নি! অমনি আক্রমণ করে তারা স্বর্গলোক, ব্রহ্মার বরে বলীয়ান তিন ভাইয়ের সঙ্গে দেবতারা যুদ্ধে পেরে ওঠেন না। বিচ্ছিরিভাবে হেরে গিয়ে তাঁরা স্বর্গ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন অবশেষে। ময়েরা ছিনিয়ে নেয় ইন্দ্রের বজ্র, বিষ্ণুর সুদর্শন, যমের পাশ, অগ্নির স্ফুলিঙ্গ, পবনের গতি, বরুণের প্লাবন; এমনকি শিবের ত্রিশূলও বাদ যায় না। যদিও শিব এই যুদ্ধে অংশ নেননি, তিনি কৈলাসে নিভৃতে ধ্যানে মগ্ন, তবুও তাঁর ত্রিশূল চলে আসে ময়দের হাতে শুধুমাত্র ব্রহ্মার বরেই। অস্ত্রহীন, বলহীন দেবতারা পালিয়ে তো বাঁচলেন, কিন্তু ইন্দ্রের সভার অপ্সরা, গন্ধর্ব, দেবকন্যারা বন্দি হল অসুরদের হাতে, তাঁরা বীভৎসভাবে অত্যাচারিত হতে লাগলেন। তাঁরা সেই অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে দেবতাদের কাছে কাতরকান্নায় প্রার্থনা জানাতে লাগলেন, মুক্ত কর, হে ভগবান আমাদের মুক্ত কর! আমাদের মুক্তি দাও!

দেবতারা তখন অধীর হয়ে এই তিন অসুরের হাত থেকে মুক্তি পাবার আশা নিয়ে উপায় খুঁজতে খুঁজতে হাজির হলেন গিয়ে কৈলাসে। ধ্যানমগ্ন শিবের উপাসনা করে দেবতারা তাঁর ধ্যান ভাঙালেন। জানালেন তাঁদের অস্ত্রহীন নিরুপায়ত্বের কথা। প্রার্থনা করলেন, শিব যেন তাঁদের এই বিপদ থেকে ত্রাণ করেন ত্রাতা হয়ে। শিব দেবতাদের উপাসনায় অত্যন্ত তুষ্ট হয়েছিলেন আগেই। তাই সহজেই দেবতাদের সাহায্য করতে রাজি হয়ে গেলেন। তিনি শুধু জানালেন, তাঁর কাছেও কোন অস্ত্র নেই, তাঁর নিজের কোন বাহন নেই, তাই যুদ্ধে যাবার যানও নেই; দেবতারা যদি এসবের আয়োজন করতে পারেন, তাহলে তিনি তিন পুরের তিন অসুর ত্রিপুরাসুরকে অবশ্যই বধ করে দেবলোক মুক্ত করবেন।

শিব ত্রাতা হতে রাজি হয়েছেন, এর চেয়ে বড় কথা আর কি আছে! অমনি সব দেবতারা লেগে পড়লেন শিবের সামান্য চাহিদা পূরণ করতে। স্বেচ্ছায় পৃথিবী হলেন শিবের রথ, বিভিন্ন দেবতা হলেন রথের চাকা, ছত্র ও ধ্বজ, নারায়ণ হলেন শিবের ধনু ও জ্যা, অগ্নি হলেন বাণ। তখন শিব চড়ে বসলেন সেই রথে, ব্রহ্মাকে বললেন সেই রথের সারথি হতে। ব্রহ্মা সানন্দে সারথির আসনে বসতেই শিবের ভুতপ্রেত, শিব-গণ সেনা সব্বাই যে-যেখানে ছিল মুখে বীভৎস রব তুলে বগল বাজাতে বাজাতে এসে উঠল সেই রথে। রণহুঙ্কারে ভরে উঠল চরাচর, বেজে উঠল শিঙা-ভেরি।

শিবের এই যুদ্ধ যাত্রা শুরু হতেই কম্পন শুরু হল ত্রিভুবনে। শিবপক্ষের রণহুঙ্কার শুনে দেবতাদের পরাজিত করার অহংকারে মত্ত অসুরেরাও রণংদেহী হয়ে উঠল। কোটি কোটি অসুর সৈন্য নিয়ে একা শিবের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিন ভাইয়ের বাহিনী। তাদের নিক্ষিপ্ত বজ্র, সুদর্শনের প্রহারও শিবের অসম্ভব রুদ্ররূপের কাছে ব্যর্থ হল। ব্রহ্মার বরে তিন ভাই তবুও কম যায় না। সেই সমানে সমান যুদ্ধে যেন মেতে উঠলেন শিব। কোনদিকে তাঁর আর হুঁশ রইল না। অস্ত্রের উত্তর প্রত্যুত্তরে যুদ্ধ চলতে লাগল টানা হাজার বছর ধরে। তখন অধৈর্য হয়ে উঠলেন ব্রহ্মা। শিবকে মনে করিয়ে দিলেন, যুদ্ধের উদ্দেশ্য ত্রিপুর ধ্বংস করে দেবকুলকে রক্ষা করা, যুদ্ধ রমণের জন্য নয়!

ব্রহ্মার কথায় শিব লজ্জিত হলেন। তখন ধনুকের জ্যা তে নিদারুণ এক টঙ্কার তুলে দিগন্তব্যাপী অগ্নিময় এক বাণ স্থাপন করে অন্তরের সমস্ত রোষের আগুন তাতে সঞ্চারিত করে শিব নিক্ষেপ করলেন ত্রিপুরের দিকে। সেই বাণের ভীষণ শব্দ তিন লোকে প্রতিধ্বনিত হল, সেই শব্দে চমকে উঠল যেন চরাচর, সকলেই যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল, হঠাৎ মৃত্যু ভয়ে তিন অসুরের শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল এবং তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভাসমান তিনটি পুরী একই অক্ষে এসে হাজির হল। একইসঙ্গে সেই বাণ বিদ্ধ করল তিনটি পুরীকে, আর তক্ষুনি তার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল তিন পুরী। এবং সেই সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়ে গেল তিন অত্যাচারী অসুর ময়, তারক ও বিদ্যুৎমালী!

অসুরদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তির আনন্দে নাচতে শুরু করলেন সমস্ত দেবতা, অপ্সরা ও দেবকন্যারা। গান ধরলেন গন্ধর্বেরা। শুরু হল পুষ্পবৃষ্টি। বিশ্বলোকের আনন্দে শিশুর মতো আনন্দে নাচতে লাগলেন ভুবনভোলা শিব। শেষটায় রথরূপী পৃথিবী আর নৃত্যরত শিবের পদভার সহ্য করতে পারলেন না। তিনি মুক্তি প্রার্থনা করলেন বিষ্ণুর কাছে। কিন্তু বিষ্ণু আনন্দরত বিপদতারণ শিবকে রথ থেকে তো আর নামতে বলতে পারেন না! পরিবর্তে, এই আনন্দের মুহূর্তে বাহনহীন শিবকে অন্য কোন বাহন উপহার দেওয়া যায় কি না ভাবতে লাগলেন। তখন তাঁর মনে পড়ল স্বর্গের গাভী সুরভির বৎস একটি সুন্দর সবল ষাঁড়ের কথা। অমনি তিনি সেই ষাঁড়টিকে আনিয়ে মহা সমারোহে উপহার দিলেন শিবকে। শিব সেই উপহার পেয়ে যার পর নাই খুশি হলেন এবং তাকে বাহন হিসেবে স্বীকার করলেন। তখন হাঁপ ছেড়ে মুক্তি পেলেন পৃথিবী। শিব পুরাণ-এর কাহিনি অনুযায়ী এই ঘটনার পর পরই সতীর সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে হয়েছিল শিবের। আর সেই বিবাহলগ্নে এই নারায়ণদত্ত ষাঁড়ের পিঠে চড়েই শিব বিয়ে করতে গিয়েছিলেন।


পার্থসারথি পাণ্ডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.