কাঁকিনাড়া টিটাগড় জগদ্দল নৈহাটি অঞ্চলে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। জনজীবন সচকিত আর প্রশাসন নির্বিকার। মারা যাচ্ছে দীন দরিদ্র মানুষ। শাসক দল ছেড়ে অন্য রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন স্থানীয় এক ডাকাবুকো নেতা। তাঁকেই এই ভয়ঙ্কর দুর্বিপাকের জন্য দায়ী করছে গণমাধ্যম পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যম রাজ্য সরকারের বশম্বদ বললেই ঠিক বলা হয়। গণমাধ্যমের তৃতীয় পরিসর থাকতে হয়। যুযুধান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি পক্ষ নিলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। সাংবাদিকরা পেশাগত ভাবে পরিচ্ছন্ন থাকতে পারছেন না। তা না হলে টিটাগড় জগদ্দলের নিরীহ মানুষদের মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঘনীভূত হত। দেশ জানত কি অন্যায় অপরাধ অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা বাস করছি।

    ব্যারাকপুরের পুলিশ আধিকারিক বদল হচ্ছে, জামাকাপড় বদলানর মত। কোন পুলিশ কর্তাই শাসক দলের মনোমত হচ্ছেন না – এছাড়া কি কারন থাকতে পারে এই বিচিত্র মিউজিক্যাল চেয়ারের? কোন স্তরে কোন প্রতিবাদ নেই। লোক সভায় এসব নিয়ে বিজেপির সাংসদরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, কেন্দ্র সরকার জানতে চাইছেন – রাজ্য সরকার নির্বিকার। আইন শৃঙ্খলা নাকি রাজ্যের বিষয়, এই কথাই বলে চলেছেন তাঁরা। পোঁ ধরছে অধিকাংশ গণমাধ্যম। রাজ্য সরকার কি আইন শৃঙ্খলা ঠিক মত পরিচালনা করছেন? পরিষ্কার উত্তর – না।

    এই রাজ্যে হাজার হাজার বোমা বিস্ফোরক পাওয়া যাচ্ছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র দাখিলের দিন প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ কর্তার বুকে গুলি লেগে তিনি মারা যাচ্ছেন, শাসক দলের অভ্যন্তরীণ গোলযোগে পড়ে গুলিবিদ্ধ পুলিশ কর্তার মৃত্যু হচ্ছে, রানীগঞ্জে দু দলের মাঝখানে পড়ে পুলিশ অফিসারের হাত উড়ে যাচ্ছে বোমার আঘাতে – অথচ আইন শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয় বলে বসে থাকতে হবে?

    দলত্যাগ করে অন্য দলে নাম লেখানো পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে যাত্রাপালায় পরিণত করেছে। একে বঙ্গীয় রাজনীতির গৌরবজনক উত্তরাধিকারের সঙ্গে কোনভাবেই তুলনা করা যাবে না। কংগ্রেস ত্যাগ করে চিত্তরঞ্জন দাশের ‘স্বরাজ্য দল’ গঠন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ গঠন, এমনকি কংগ্রেস-সমাজতন্ত্রী দলের মধ্যে থেকে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল বা এস ইউ সি গঠনকে এর সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব নয়। কংগ্রেস ভেঙ্গে শ্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলা কংগ্রেস’ কে সামান্য তুলনায় আনা যায় বটে। তবে ইদানীং যে দল বদলের সংস্কৃতি চলছে, তার সঙ্গে বঙ্গীয় রাজনীতির অতীত দিনের দৃষ্টান্ত মেলানো অসম্ভব। এই বিকৃত ব্যবস্থা ষাট সত্তর দশকে ‘আয়ারাম গয়ারাম’ বলে অভিহিত হত। মুদ্রিত গণমাধ্যম তীব্র ভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করত এই অনৈতিক কান্ড কারখানাকে। রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দলত্যাগ বিরোধী আইন আনেন। সেই আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাজনীতি ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা কমেনি – বেড়েই চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সামান্য হলেও ব্যতিক্রম ছিল। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, তৃণমূল কংগ্রেস এই প্রবণতাকে নির্লজ্জ ভাবে প্রয়োগ করে অন্য দল থেকে নিজের দল ভারী করাটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

      পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান পদটি বিপক্ষ দলের নেতাদের পাওয়ার কথা। তৃণমূলে যোগ দেওয়া ড. মানস ভুইঞা বিধায়ক পদটি তখনো ছাড়েননি, অথচ শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোন নীতির বলে তাঁকে পি. এ. সি এর সভাপতি হিসাবে নিয়োগ করলেন? যান্ত্রিক ভাবে দেখলে একে অবশ্য নিয়ম মেনে করা কাজ বলে মানতে হবে। কিন্তু এতে অনীতির চূড়ান্ত হয়েছে । স্পিকার মহাশয় এসব ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। রাণীগঞ্জের বিধায়ক সোহরাব হোসেনের কথাই ধরুন। এই বিধায়ক লোহা চুরির সর্দার, তার অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হল দু বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল। সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে বলা হয়েছে – এরকম ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে বিধায়ক পদ বাতিল হবে। অথচ নানারকম কুযুক্তি দেখিয়ে স্পিকার মহাশয় –  শ্রী বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় পুরো সময় কালটি তাকে রেখে দিলেন। নতুন করে নির্বাচন এল। রাণীগঞ্জের লোহা চোরের স্ত্রীকে বিধায়ক করে জিতিয়ে আনা হল।

      বিরোধী দলের লোক শাসক দলে যোগ দিলে তাকে পতাকা হাতে দিয়ে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানো হবে, আর বিপরীত ঘটনা ঘটলে বলা হবে এসব ঘটনা অনৈতিক। এমন দ্বিচারিতা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে অতলে টেনে এনেছে। এর মূল দায় কিন্তু শাসক শ্রেণির উপরেই বর্তায়। বিষয়টি প্রায় একই ভাবে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। তৃণমূল নেতা শ্রী মুকুল রায় দলত্যাগ করলেন – যোগ দিলেন ভারতীয় জনতা পার্টিতে। তবে তিনি যতদিন রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন, অপেক্ষা করছিলেন। ভাটপাড়ার বিধায়ক অর্জুন সিংও বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করেই নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সাংসদ হয়েছেন। এর পর শুরু হয়েছে দল বদলের বিচিত্র সংস্কৃতি। নানা অঞ্চলে জেলায় শহরে তৃণমূল আর বামপন্থী দল ভেঙ্গে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার ঢল নেমেছে। কাউন্সিলর জেলা পরিষদের সদস্যরা দিল্লি গিয়ে দল বদল করছেন। এরকম ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন।

      ঘটনা যাই হোক সরকার আর দল এক করে দেখলে চলে না। রাজ্য সরকার তাই করছেন। বিরোধী দলে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিথ্যা মামলায় জেরবার করা হচ্ছে, পুলিশ সর্বত্র পক্ষপাতী, কোথাও কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হলেই ‘ক্লোজ’ ব বদলি। একে প্রশাসন বলে না। একে বলে গণতন্ত্রকে হত্যা করা এর প্রতিক্রিয়া ঘটা অনিবার্য । যে দলতি দল ভাঙ্গিয়ে অনৈতিক ভাবে স্ফীত হয়েছে- সে দলটি থেকে দলে দলে দলত্যাগ ঘটা ইতিহাসের অনিবার্য গতি ছাড়া কিছুই নয়।

    এই রণভূমিতে রক্ত অবিরল ধারায় ঝরছেই। মৃত্যু হচ্ছে সাধারণ দীন দরিদ্র মানুষের। কখনো সন্দেশখালির মৎস্যজীবী পরিবার, কখনো জগদ্দল ভাটপাড়ার ফুচকাওয়ালা – অনিবার্য ভাবে শুয়ে থাকছেন তারা। তাদের বীভৎস পরিণতির দৃশ্য আমাদের স্মৃতিতে আর যেন অভিঘাতও তোলে না। মনুষ্যত্বের এমন পরাজয় রাজ্যবাসীর পক্ষে অনিবার্য নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অপরাধ আমরা সময় মতো প্রতিবাদ করিনি, প্রতিবাদ জানাতে ব্যর্থ হয়েছি।

অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.