পাশেই খোলা ড্রেন, ভনভন করে উড়ে আসে মশা। হাওয়া দিলেই ছড়ায় বিশ্রী দুর্গন্ধ। পাশ দিয়ে নিয়মমাফিক বয়ে চলেছে নাগরিক জীবন। আর তার গা ঘেঁষেই দাঁতে দাঁত চেপে, মাটি কামড়ে পড়ে আছেন কয়েকশো মানুষ। এভাবেই চলছে, আজ ২৬তম দিন! তিলোত্তমার বুকে যেন এক টুকরো শিউরে ওঠা অমানবিকতার ছবি যেন সেঁটে রয়েছে ২৬ দিন ধরে। শহরের প্রাণকেন্দ্র, ধর্মতলার খুব কাছে, প্রেসক্লাবের সামনে। চলছে অনশন।
তাঁরা ভবিষ্যতের মানুষ গড়ার কারিগর। সম্ভাব্য শিক্ষক-শিক্ষিকা। এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেও দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চাকরি না-পেয়ে, কলকাতা এসেছিলেন দাবি আদায় করতে। মনে মনে ভেবেছিলেন, ন্যায্য অধিকারের লড়াইয়ে ঠিক জিতবেন। জয়ের আভাস না পেয়ে অনশনে বসেছেন তাঁরা। ২৬ দিন পরেও তাঁদের জয় এখনও অনিশ্চিত।
কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেকের অনেক হারিয়ে ফেলা নিশ্চিত হয়েছে এই ক’দিনে। কোচবিহারের এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার দুই তরুণীর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গিয়েছে অনশনের ধকলে। তাঁদের স্বামীরা অসুস্থ স্ত্রী-দের হয়ে বসেছেন অনশনে, শেষ দেখেই ছাড়বেন। বেশ কয়েক জন অনশনকারী ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। রক্তচাপ আশঙ্কাজনক ভাবে নেমে গিয়েছে অনেকের।
তার উপরে নিত্যসঙ্গী ঝড়জল, যা রুখতে ভরসা ত্রিপল। তবু খুঁটিতে বেঁধে নয়, হাতে ধরে থেকে। এক অনশনকারীর কথায়, “বৃষ্টি পড়লে দলা পাকিয়ে স্তূপের মতো পড়ে থাকি আমরা। আমাদের ওপরে ফেলা থাকে ত্রিপল।” এক চাকিপ্রার্থী মায়ের সঙ্গে তাঁর দু’বছরের সন্তানও ছিল ২১ দিন ধরে। শেষমেশ সে অসুস্থ হয়ে পড়ায়, তাকে বাবার কাছে রেখে মা একাই লড়ছেন খিদের সঙ্গে। এখনও পর্যন্ত ৮৩ জন হাসপাতালে বলে জানা গিয়েছে। অসুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন বেশ কয়েক জন। কিন্তু কয়েকশো মানুষ এখনও নাছোড়।
দেখুন অনশন পর্বের ভিডিও।
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, এই অনশন তাঁর এবং সরকারি স্তরে সকলের হৃদয় স্পর্শ করলেও, তাঁরা কিছু করতে অপারগ। কারণ আইনি ভাবে ওয়েটিং লিস্টে থাকা চাকরিপ্রার্থীরা সকলে চাকরি পাওয়ার যোগ্য নন। তিনি আরও দাবি করেছিলেন, শিক্ষকের মতো একটা পেশায় মেধা এবং যোগ্যতা বিসর্জন দেওয়া যায় না। তিনি আশ্বাস দেন, মনীষ জৈনের নেতৃত্বে একটি পাঁচ জনের কমিটি গড়া হবে, যে কমিটি আন্দোলনকারীদের অভিযোগ শুনবে। অভিযোগ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে খতিয়ে তদন্তেরও আশ্বাস দেন তিনি।
অনশনকারীদের তরফে রায়গঞ্জের অর্পিতা দাস টেলিফোনে দ্য ওয়ালকে জানালেন, তাঁরা লিখিত অভিযোগ তৈরি করেছেন। আগামী কাল, মঙ্গলবার যাবেন কমিটির কাছে তা জমা দিতে। তবে ইতিবাচক কোনও পদক্ষেপ না করা হলে তাঁরা অনশনের পথ থেকে সরছেন না বলেই জানিয়ে দিলেন অর্পিতা। “যা-ই হয়ে যাক, ন্যায্য ও প্রাপ্য অধিকার আমাদের দিতেই হবে। না দিলে, তার কারণ পরিষ্কার করে জানাতে হবে। হয় চাকরি, নয় মৃত্যু। আর কিছু ভাবতে পারছি না আমরা।”
কোন কোন অভিযোগ জমা দেবেন তাঁরা?
অর্পিতা জানালেন, তাঁদের মূল অভিযোগ তিনটি।
এক: প্রত্যেকের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রকাশ করে, মেরিট লিস্ট অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ প্যানে প্রকাশ করতে হবে।
দুই: পরীক্ষার ফলপ্রকাশের ১৫ দিন আগে পর্যন্ত থাকা শূন্যপদে নিয়োগের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেই শূন্যপদ এখন কোথায় দাঁড়িয়েছে, ঠিক কত নিয়োগ হয়েছে, যাঁরা নিযুক্ত হয়েছেন তাঁদের প্রাপ্ত নম্বর কত, তার আপডেট দিতে হবে।
তিন:প্রতিটা বিষয়ে কতগুলি পদ শূন্য এবং তার বিপরীতে কত জন ওই বিষয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে অপেক্ষা করছেন, তার অনুপাত প্রকাশ করতে হবে।
এক ঝলকে দেখে নিন অনশনকারীদের তরফে অর্পিতার বক্তব্য।
এর মধ্যেই এসএসসিচাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে সোমবার সন্ধ্যা থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে প্রতীকী অনশনে বসার ঘোষণা করলেন প্রেসিডেন্সির পড়ুয়ারা৷ একই কারণে পাশে থাকার দাবিতে কলেজ স্ট্রিটে বিক্ষোভ দেখাবে বাম ছাত্র সংগঠন আইসা৷ এ ছাড়া মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর ডাকে সোমবার সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যার থেকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত মিছিল হতে চলেছে৷ যোগ দেবেন প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর ও মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারা৷
অনশনকারীরা জানাচ্ছেন, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে ২৬ দিন অনশন করেছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তিনি নিজেই মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে কী করে এত নির্লিপ্ত, কেন তাঁদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসছেন না, সেটাই বিস্মিত করছে অনশনকারীদের।
সূত্রের খবর, অনশনের এই ২৬তম দিনে ২৬ মিনিট বাকরুদ্ধ অনশন পালন করতে চলেছেন অনশনকারীরা৷ মুখে কলো কাপড় বেঁধে এই ২৬ মিনিটের অনশনে অংশ নেবেন বুদ্ধিজীবীরাও৷ ইতিমধ্যেই এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন কবি শঙ্খ ঘোষ, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ অনশনে বসেছেন সাহিত্যিক মন্দাক্রান্তা সেন নিজে।
রাজ্য রাজনীতির সাম্প্রতিক আন্দোলনের ইতিহাস বলছে, টানা ১৯ দিন অনশনের পর কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন পতিদার নেতা হার্দিক প্যাটেল৷ সরকারি চাকরিতে পতিদার সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ ও কৃষকদের ঋণ মুকুবের দাবি জানিয়ে ১৯ দিন ধরে আমরণ অনশনে বসেছিলেন হার্দিক প্যাটেল৷ গত বছর মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ুয়াদের হস্টেলের দাবিতে করা অনশন ওঠে ১৪ দিনের মাথায়৷ চলতি বছর ২৯ জানুয়ারি ১২ দিন পর অনশন কর্মসূচি তুলে নেন কল্যাণী আইআইআইটি পড়ুয়ারা৷
সিঙ্গুরের জমি পুনরুদ্ধারে টানা ২৬ দিন অনশন, ধরনায় ছিলেন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সেই আন্দোলন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম মাইলস্টোন৷ রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত, তাঁকে বাংলার মসনদে পৌঁছে দিতে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিল সেই অনশন৷ উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা বাংলা৷ পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিভিন্ন দল ও ব্যক্তিত্ব৷
অন্য দিকে, অনশনের সুদূর ইতিহাস বলছে, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের সহকর্মী যতীন দাশ টানা ৬৩ দিনের অনশন করে মৃত্যু বরণ করেছিলেন৷ ব্রিটিশ আমলে প্রতিবাদ স্বরূপ তাঁর এই ভাবে মৃত্যুবরণ করার ফলে রাজবন্দিদের উপর অত্যাচার অনেকটা প্রশমিত হয়েছিল বলে শোনা যায়৷
এ ক্ষেত্রে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে পরিস্থিতি এখনও বুঝতে পারছেন না কেউ-ই। চাকরি-প্রার্থীদের দাবি, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের এই অনশন চলবেই৷ এক চাকরি-প্রার্থী জানান, ‘‘আমরা আজ মুখ্যমন্ত্রীর ২৬ দিনের অনশনের রেকর্ড ভেঙে দিতে চলেছি৷ কিন্তু, আমরা রেকর্ড ভাঙাভাঙির খেলায় মাততে চাই না৷ আমরা চাই চাকরি৷ আমরা মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইছি৷ কারণ, মুখ্যমন্ত্রীই পারেন আমাদের সমস্যা সমাধান করতে।’’